আগামী মাসে ‘মিস্টার এশিয়া’, ডিসেম্বরে ‘মিস্টার ওয়ার্ল্ড’ খেতাব জয়ের জন্য লড়তে নামছেন মণিপুরের খুনদ্রাকপাম প্রদীপকুমার। গত ১১ বছর ধরে এইচআইভির মারণ জীবাণু বহন করছেন শরীরে। তবু মনকে ভাঙতে দেননি। বরং ভাঙনের উল্টোপথে হেঁটে গড়ে তুলেছেন সৃদৃঢ়, পেশীবহুল শরীর। এড্সএর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি রাজ্যের ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর’। কিন্তু যে রাজ্য অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী মেরি কমকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিও রাখে না, সেই রাজ্য প্রদীপকুমারের দিকে যে সাহায্যের হাত বাড়াবে না, তা বলাই বাহুল্য। তাই মারণ রোগের সঙ্গে লড়াই করে দুনিয়ার কাছে মণিপুরের নাম উজ্জ্বল করলেও, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নামার আগে পর্যাপ্ত খাদ্য ও পুষ্টির অভাবে অনিশ্চয়তার জীবন কাটাচ্ছেন প্রদীপকুমার।
১১ বছর আগে মাদকাসক্ত প্রদীপকুমার সিরিঞ্জের মাধ্যমে হেরোইন নিতে গিয়ে এইচআইভি-র মারণ জীবাণু ঢুকিয়ে ফেলেন নিজের শরীরে। কুস্তি, ভারোত্তন ছেড়ে মনমরা প্রদীপ বাড়িতে বাগান করা শুরু করেছিলেন। কিন্তু দু’বছর পরে নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই শুরু হয়। ঈগল জিমে, রমেশ মায়েংবামের অধীনে ফের শুরু করেন শরীরচর্চা। সঙ্গে চলতে থাকে প্রতিদিন তিনবার অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল ওষুধ ও নিয়ম করে খাওয়াদাওয়া। কঠোর অধ্যাবসায়ের ফল মেলে ২০০৭ সালে। অল মণিপুর বডিবিল্ডিং অ্যাসোসিয়েশনের দেহসৌষ্ঠব প্রতিযোগিতায় সিনিয়র বিভাগে প্রদীপ ‘মিস্টার মণিপুর’ নির্বাচিত হন। জাতীয় প্রতিযোগিতায় পান ষষ্ঠ স্থান। এরপর প্রচার মিলল, সম্মান মিলল, কিন্তু অর্থ মেলেনি। ছিল না রোজগারও। পরিবারই পাশে দাঁড়ায়। এরপর, দুই বছর আগে ত্রিচূড়ে আন্তঃরাজ্য দেহ সৌষ্ঠব প্রতিযোগিতায় দেশের মধ্যে তৃতীয় হন তিনি। গত বার মিস্টার ওয়র্ল্ড প্রতিযোগিতায় মেলে অষ্টম স্থান। প্রদীপের জীবন নিয়ে ছবি তৈরি করেছেন অরিবাম শ্যাম শর্মা। পশ্চিমের দেশগুলিতে তা উচ্চ প্রশংসিতও। কিন্তু রাজ্য সরকারের কোনও হেলদোল নেই। |
খুনদ্রাকপাম প্রদীপকুমার। —নিজস্ব চিত্র |
রাজ্যের প্রতিভাদের অবহেলা করা কার্যত ওক্রাম ইবোবি সরকারের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালে, পঞ্চমবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে প্রকাশ্য সমাবেশে মেরিকে বক্সিং অ্যাকাডেমির জন্য ২ একর জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী ওক্রাম ইবোবি সিংহ। ডিএসপি মেরিকে এএসপি পদে উন্নীত করার কথাও ঘোষণা করেন ইবোবি। কিন্তু তা হয়নি। এ বছর অগস্টে, মেরি অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জয়ের পর ফের মুখ্যমন্ত্রী জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আরও ঘোষণা করেন, ডিএসপি থেকে একলাফে মেরিকে এসপি (ক্রীড়া) হিসেবে পদন্নোতি দেওয়া হবে। কিন্তু চলতি মাস অবধিও ডিএসপির বেতনই হাতে পাচ্ছেন তিনি। লাঙ্গল গেম্স ভিলেজের কাছে, অস্থায়ী শিবির খাটিয়েই মেরির অ্যাকাডেমি চলছে। মেলেনি জমিও।
প্রদীপের ক্ষেত্রেও একই ছবি। ২০০৯ সালেই রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ বিভাগে তাঁর চাকরির কথা ঘোষণা করে দেন ক্রীড়ামন্ত্রী। কিন্তু আজও সেই চাকরি মেলেনি। এই অবস্থায়, আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে লুধিয়ানায় ৮ম সিনিয়র মিস্টার এশিয়া প্রতিযোগিতা ও ডিসেম্বরে মিস্টার ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় নামতে চাওয়া ৪৩ বছরের প্রদীপ অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। রাজ্যের ৩৮,০১৬ জন এডস রোগীর লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া সেনাপতির জন্য এখন মাসে ৪০ হাজার টাকার দেশি-বিদেশী ওষুধ ও খোরাকি কিনতে হয়। রাজ্য এডস নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ প্রদীপকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর করলেও জুন মাসের পর থেকে মাসিক ৮ হাজার টাকার ভাতা বন্ধ করে দিয়েছে। স্কুলে ঠিকা ভিত্তিতে শরীর শিক্ষকের কাজ করছিলেন। অসম্মানের জেরে তাও ছেড়েছেন। প্রদীপের অবস্থা দেখে রাজ্যের এইচআইভি বহনকারী বিধবারা একজোট হয়ে তাঁর জন্য অর্থ সংগ্রহে নেমেছেন। পাশাপাশি, ‘জয়েন্ট ব্রাদার্স’ নামে একটি সংস্থা প্রতিযোগিতার প্রস্তুতির জন্য তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে দেড় লক্ষ টাকা।
তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রদীপকুমার বলেন, “এই প্রতিযোগিতার জন্য অনেকদিন ধরে নিজেকে তৈরি করেছি। তাই যে কোনও মূল্যে প্রতিযোগিতার আসর অবধি পৌঁছতে চেয়েছি। নিজের নতুন করে কিছু পাওয়ার নেই। কিন্তু রাজ্য ও দেশের এডস রোগীদের কাছে আমার লড়াইটাকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। অন্যের দয়ায় এতখানি এগোতে পেরেছি। আমি ও আমার পরিবার নিঃস্ব। মিস্টার ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার পরে আর আমি এই পথ মাড়াব না।” ক্যানসারকে হারিয়ে দেওয়া যুবরাজের লড়াই যদি অনেকের কাছে বাঁচার রসদ হয়, প্রদীপকুমারের ‘কামব্যাক’ও সেই পর্যায়েই পড়ে। যুবরাজের পাশে দাঁড়িয়েছে বিসিসিআই-সহ গোটা দেশ। কিন্তু একা প্রদীপ আপাতত রণক্লান্ত, অসহায়। |