এক জন দেহ দান করলে অন্তত পাঁচ জন মানুষ পেতে পারেন সুস্থ জীবন।
তা হলে কেন আমাদের এত সংশয়? উত্তর খুঁজছেন
ডা. কুণাল সরকার |
এ মাসের গোড়ায় খবরে এসেছিল অষ্টাদশী মেয়েটির কথা। পথদুর্ঘটনায় মর্মান্তিক আহত হয়ে মারা গিয়েও সে বেঁচে রয়েছে আরও পাঁচ জনের মধ্যে। তাঁর দু’টি কিডনি, দু’টি চোখ এবং লিভার পেয়েছেন পাঁচ জন অসুস্থ মানুষ।
মেয়েটির হৃৎপিণ্ডও কাজে লাগতে পারত, কিন্তু তার জন্য তৎক্ষণাৎ কোনও রোগী চিহ্নিত করা যায়নি। মনে পড়ছিল বছর পঁচিশের সেই তরুণীর কথা, হৃৎপিণ্ডের কর্মক্ষমতা প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসায় যে খাট থেকে উঠে চার পা-ও হাঁটতে পারে না। তাকে স্বাভাবিক পরমায়ু ফিরিয়ে দেওয়ার একমাত্র উপায় হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট অন্যের হৃৎপিণ্ড তার শরীরে প্রতিস্থাপন করা। হৃৎপিণ্ড দিতে পারেন এমন ব্যক্তিই যাঁর শরীর বেঁচে রয়েছে কিন্তু মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছেঅর্থাৎ ‘ব্রেন ডেড।’ এমনটা ঘটলে মস্তিষ্কের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও কিন্তু দেহের প্রত্যঙ্গগুলি সচল থাকে। ‘ব্রেন ডেড’ মানুষের থেকে হার্ট, কিডনি, প্যানক্রিয়াস, লিভার, কর্নিয়া প্রভৃতি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারলে ছয়-সাত জন মানুষ সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে পারেন।
স্পেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে ‘ব্রেন ডেড’ মানুষের প্রত্যঙ্গ ব্যবহারের জন্য আত্মীয়দের সম্মতি লাগে না। ডাক্তাররাই তাঁদের প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য নিতে পারেন। স্পেনে প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের হারও তাই অনেক বেশি। তবে ইউরোপের অন্যান্য দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোগীর আত্মীয়দের সম্মতি নিয়েই তা করা হয়। কিন্তু সেখানেও সচেতনতা বেশি বলে প্রতিস্থাপনের হার খারাপ নয়।
আমাদের দেশে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯৪ সালে মানব প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্পর্কিত আইন পাশ করার পর সব রাজ্যগুলি সেই অনুসারে নিজস্ব আইন পাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গ একটু দেরিতে হলেও ‘ব্রেন ডেড’ সার্টিফিকেট দেওয়ার আইনসঙ্গত পদ্ধতি তৈরি করেছে। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে চিকিৎসকরা দুই ধরনের বাধা পাচ্ছেন। এক, রোগীর আত্মীয়দের অনিচ্ছা। আর দুই, আইনি পরিকাঠামোর সমস্যা।
রোগীর আত্মীয়দের অনাগ্রহ কেন, তা বোঝা শক্ত নয়। ব্রেনের এত জটিল সমস্যার চিকিৎসা সম্ভব, আমার রোগীর চিকিৎসা হবে না কেন এমন প্রশ্ন স্বাভাবিক। আসলে, মস্তিষ্কের কিছু বিশেষ জায়গার ক্ষতি হয়ে থাকলে রোগীকে ফেরানোর মতো কোনও চিকিৎসা জানা নেই। রোগী বাস্তবিকই ‘ব্রেন ডেড’ কি না, তা কোনও এক জন ডাক্তার নির্ধারণ করতে পারেন না। একাধিক বিশেষজ্ঞ তাঁদের নিরপেক্ষ মতামত দিলে তবেই রোগীকে ‘ব্রেন ডেড’ ঘোষণা করা যায়। কোনও ভুলভ্রান্তি যাতে না থাকে, তার জন্য ডাক্তারদের মতামতের পরেও একাধিক পরীক্ষা করা হয়।
প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থাপনার কাজটি কিন্তু কেবল ডাক্তারেরই নয়, তার জন্য প্রয়োজন হয় ‘ট্রান্সপ্লান্ট কোঅর্ডিনেটর’ এবং ‘কাউন্সেলার’। কাউন্সেলাররা শোকার্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলার কাজটি অনেক বেশি সাফল্যের সঙ্গে করতে পারেন। এক বার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলে বিভিন্ন ডাক্তারদের কয়েকটি ‘ট্রান্সপ্লান্ট টিম’ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিস্থাপনের জন্য অস্ত্রোপচার শুরু করে দেয়।
কিন্তু যা হতে পারত, তার অতি সামান্যই বাস্তবে হয়। মৃত্যুর পর প্রায় যে কোনও মানুষের চোখ দান করা যায় অন্যদের। অথচ বছরে মাত্র হাজার পাঁচেক কর্নিয়া প্রতিস্থাপন আমরা করে উঠতে পারি। তিন-চার লক্ষ চোখ দান করলেও হয়তো কুলিয়ে ওঠা যাবে না। হাজার পাঁচেক কিডনি প্রতিস্থাপন হয় বটে, কিন্তু তার অতি সামান্য অংশ আসে মৃত ব্যক্তির থেকে। হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের অবস্থা আরও শোচনীয়, গত কয়েক বছরে ১৫-২০টির বেশি প্রতিস্থাপন হয়নি।
আমাদের দেশে প্রতিস্থাপনের হার দ্বিগুণ করা সম্ভব যদি মৃতের আত্মীয়দের এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করার একটি যথাযথ ব্যবস্থা থাকে। সরকারি বা বেসরকারি, যে কোনও হাসপাতালে প্রত্যঙ্গ দানের পরিকাঠামোর দরকার। এস এস কে এম হাসপাতাল এ রাজ্যে দৃষ্টান্ত। সেনা হাসপাতালগুলি প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের কাজ খুব ভাল করে চলেছে। মৃতদেহ থেকে প্রত্যঙ্গ গ্রহণ যে ক’টি এখন হচ্ছে, সেই অল্পসংখ্যক প্রতিস্থাপনও সম্ভব হত না যদি সেনা হাসপাতালের অক্লান্ত চেষ্টা না থাকত।
কিন্তু আইন বা সরকারি নিয়মের সমস্যাও এ কাজে একটা বড় বাধা। স্বাস্থ্য প্রশাসন যেন মৃতদেহ থেকে প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কিডনি প্রতিস্থাপন এখন আর অত জটিল নয়। কিন্তু হার্ট, লাংস, লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য কী কী বিধি মানতে হবে, কী অনুমোদন দরকার হাসপাতালের, তার নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি হয়নি। আমরা কয়েক বছর ধরে এ বিষয়ে চেষ্টা করেও জট ছাড়িয়ে উঠতে পারছি না। অন্যান্য রাজ্যে একাধিক প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য যে নিয়মবিধি রয়েছে, সেই কাঠামোটা আমরা অনুসরণ করতে পারি না কেন?
তামিলনাড়ুর কথা এখানে বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক। সে রাজ্যে সরকারি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছে যে, ‘ব্রেন ডেথ’ হয়ে থাকলে চিকিৎসকদের তা আত্মীয়দের জানাতেই হবে, যাতে রোগীর আত্মীয়রা প্রত্যঙ্গ দানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যে সব রাজ্যে এমন নির্দেশ নেই, সেখানে হাসপাতাল বা নার্সিং হোম রোগীর হৃৎপিণ্ডের কাজ বন্ধ না-হওয়া পর্যন্ত আত্মীয়দের মৃত্যুর কথা জানাচ্ছে না। ফলে তামিলনাড়ুতে যেখানে বছরে একশোরও বেশি ‘ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লান্ট’ (মৃতদেহ থেকে প্রতিস্থাপন) হচ্ছে, বহু রাজ্যে বছরে একটা কি দুটো হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে আজ অবধি তিনটি ক্ষেত্রে এমন ঘটেছে।
জীবন থেকে জীবনের দীপ জ্বালাতে হলে এক দিকে যেমন আইন বাঁচাতে হবে, অন্য দিকে তেমনই বাঁচাতে হবে সময়। দাতা পাওয়া গেলে ১০-১২ ঘন্টার মধ্যে প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। শনি-রবি-পুজোর ছুটির তোয়াক্কা করলে প্রতিস্থাপনের কাজকে সাবালক অবস্থায় নিয়ে আসা যাবে না। |