শিক্ষক-পড়ুয়ার এ এক ‘অন্য’ ছবি। যে ছবি সংঘাতের নয়, বরং সৌহার্দের। পারস্পরিক ভালবাসার। কলেজে কলেজে শিক্ষক বা অধ্যক্ষ নিগ্রহ এ রাজ্যে ঘটেই চলেছে। ছাত্র সংসদের ভোট ঘিরেই হোক, কিংবা পরীক্ষায় নকল করতে দেওয়ার দাবিকে ঘিরেসব ক্ষেত্রেই আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছেন শিক্ষকেরা। এমন পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রমী ছবি দেখা গেল চন্দননগর খলিসানি মহাবিদ্যালয়ে।
কলেজে অধ্যক্ষ নেপঙ্কর হাজরা ‘পারিবারিক কারণে’ চলে যেতে চান রানিগঞ্জে, তাঁর বাড়ির কাছাকাছি অন্য কলেজে। কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্ত রুখতে মঙ্গলবার দিনভর অধ্যক্ষকেই ঘেরাও করে রাখলেন ছাত্রছাত্রীরা। ক্লাস বন্ধ রেখে ঘেরাওয়ে সামিল হন শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মীরাও। এমনই অধ্যক্ষের জনপ্রিয়তা। কোনও ম্যাজিক নয়। স্রেফ কাজ করে আজ কলেজে গ্রহণযোগ্যতা এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছেন নেপশঙ্করবাবু যে, তাঁর বদলি রুখতে এককাট্টা এসএফআই ও তৃণমূল ছাত্র পরিষদও।
রাতারাতি কিন্তু ‘সাফল্য’ আসেনি। নেপঙ্করবাবু খলিসানি কলেজে যোগ দিয়েছিলেন ২০০৬ সালে। ১৯৯৪ থেকে কলেজে স্থায়ী অধ্যক্ষ ছিলেন না। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষেরাই কাজ চালাতেন। কলেজে অশান্তি লেগেই থাকত। ক্লাস বন্ধ, পড়াশোনার ক্ষতি সব মিলিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা। কলেজের শিক্ষক সংসদের সম্পাদক অজন্তা চক্রবর্তী বলেন, “এক সময় এমন হয়েছিল, ছাত্রছাত্রীদের বসার জায়গা পর্যন্ত নেই। |
নেপঙ্করবাবু এসে সরকারি সাহায্যে নতুন ভবন তৈরি করলেন। শিক্ষা-সংস্কৃতি, শৃঙ্খলা সব দিক দিয়ে আমাদের কলেজ এখন অনেক এগিয়ে।” ছাত্রছাত্রীরাও বলছেন, “উনি দায়িত্বে আসার পরে ধীরে ধীরে সব সমস্যা উধাও।” কলেজে প্রায় ১২০০ ছাত্রছাত্রী। ছাত্র সংসদে ক্ষমতাসীন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। ভোটে গণ্ডগোলের কোনও আঁচই পড়েনি কলেজে। বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রিঙ্কু চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ভোটের আগে স্যার বুঝিয়েছিলেন, সব খেলায় হার-জিত আছে। তেমনই ভোটেও কোনও এক পক্ষ জিতবে। তা নিয়ে অন্য পক্ষের গোলমাল করা কাম্য নয়। ফলে কোথা দিয়ে কী ভাবে ছাত্র সংসদের ভোট হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না!” ছাত্র সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক পিন্টু সাঁতরা বলছেন, “স্যার আমাদের মুসকিল-আসান। দু’দলের সমস্যা মেটাতেন উনি। স্যার চলে গেলে আমাদের কী হবে?” এসএফআইয়ের কলেজ ইউনিটের সম্পাদক ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “উনি ভাল মানুষ। অধ্যক্ষ হিসাবেও তুলনাহীন। উনি সব সময়ে সহৃদয় ভাবে আলোচনা করেন।”
এই পরিস্থিতিতেই নেপঙ্করবাবুকে ঘিরে সবার এক রা ‘যেতে নাহি দিব।’ এ দিন ছাত্র-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী পোস্টার-প্ল্যাকার্ড হাতে বদলি ঠেকাতে স্লোগান দিয়েছেন। নেপঙ্করবাবুর বক্তব্য, “পাঁচ বছর পরে নতুন কলেজে যাওয়ার সুযোগ এসেছে। সুযোগ হারাতে চাই না। পারিবারিক সমস্যার জন্যই বাড়ির কাছাকাছি কলেজে চলে যেতে চাইছি। কিন্তু এই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা ছাত্র-ছাত্রী, সকলের সঙ্গে এই ছ’বছরে যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাতে খুব আপ্লুত।” ‘স্যারের’ এই যুক্তিতেও অনঢ় ছাত্রছাত্রীরা। তাঁদের বক্তব্য, “ওঁকে সপরিবার খলিসানিতে থাকার বন্দোবস্ত করে দেব। যাওয়া চলবে না।” নেপঙ্করবাবু বলেন, “কলেজের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পেরেছি। সকলের ভালবাসায় থাকতে পারলে আনন্দ হবে। কী করব, ভেবে দেখি।”
দোটানায় অধ্যক্ষ। আপাতত এটাই ‘সাফল্য’ পড়ুয়া-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের। |