প্রবন্ধ...
অর্থনীতির যে সমস্যা অর্থনীতিবিদরা দেখতে পান না
মি পেশায় অর্থনীতিবিদ। কিন্তু এখন অর্থনীতিতে ঠিক কী গণ্ডগোল চলছে, সেটা কোনও অর্থনীতিবিদই স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছেন কি না, তা নিয়ে আমার রীতিমত সংশয় রয়েছে। তাঁদের প্রশ্ন করে দেখুন, তাঁরা সংস্কারের অভাবের কথা বলবেন (পেনশন, বিমা, অসামরিক বিমান পরিবহণ, রিটেল ইত্যাদিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকে এখনও প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি, পেট্রোলিয়াম পণ্যের দামও সংস্কারের অপেক্ষায় রয়েছে, ভর্তুকিও), বিপুল সরকারি খরচ ও ক্রমবর্ধমান রাজকোষ ঘাটতির কথা বলবেন, কর ব্যবস্থার সংস্কার অর্থাৎ ডিরেক্ট ট্যাক্স কোড (ডি টি সি) এবং গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (জি এস টি) চালু করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের প্রসঙ্গ তুলবেন। অর্থনীতিবিদরা ডলারের সাপেক্ষে টাকার দামের ওঠা-পড়ার কথাও বলবেন। তাঁরা আর যে কথাগুলো বলবেন, সেগুলো আসলে রোগ নয়, রোগের উপসর্গমাত্র যেমন, অর্থনীতিতে বৃদ্ধির হার শ্লথ হয়েছে, দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ কমছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতের বাজার থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছেন। আমি বলছি না যে এই কথাগুলো ভুল। কিন্তু, শুধু এইটুকু দিয়েই অর্থনীতির সমস্যাকে ব্যাখ্যা করায় মুশকিল আছে। জোট রাজনীতি যে সংস্কারের পথে হাজার বাধা সৃষ্টি করে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু, কংগ্রেসের মধ্যেও আর্থিক সংস্কার নিয়ে প্রচুর বাধা রয়েছে। কাজেই, শুধুমাত্র ডি এম কে, তৃণমূল কংগ্রেস বা সমাজবাদী পার্টির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে মানুষকে ভুল বোঝানোর একটা চেষ্টা রয়েছে। যেমন, গ্রিসের পরিস্থিতির জন্যই ভারতীয় অর্থনীতির এই টালমাটাল অবস্থা, এই কথাটাও ভুল বোঝানোর চেষ্টামাত্র।
শরিকদের সঙ্গে যোগাযোগহীন? প্রণব মুখোপাধ্যায়, মনমোহন সিংহ ও সনিয়া গাঁধী।
সব সংস্কারই যে দিল্লিতে হয়, তা তো নয়। বহু সংস্কার রাজ্যগুলিতেও হয়। কিন্তু, আপাতত কেন্দ্রের দিকেই তাকানো যাক। জোটের জটে নাকি অনেক আইন আটকে যায়। ১৯৯১ সাল থেকে কেন্দ্রে অনেকগুলি জোট (এবং সংখ্যালঘু) সরকার ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু তাতে তো সংস্কার থমকে যায়নি। জোটের প্রধান শরিকের কর্তব্য ছোট শরিকদের সঙ্গে কথা বলা। তাকে বিভিন্ন রাজ্যের সরকারের সঙ্গে কথা বলতে হবে, এমনকি বিরোধীদের সঙ্গেও আলোচনার পরিসর খুলে রাখতে হবে। সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার (ইউ পি এ) দ্বিতীয় দফায় কংগ্রেস এই জায়গাটাতেই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। যে ভদ্রলোক আর কয়েক দিনের মধ্যেই রাজনীতির পাট চুকিয়ে রাইসিনা হিলস-এর বাসিন্দা চলেছেন, তিনি ছাড়া আর ক’জন কংগ্রেস নেতার বিভিন্ন দলের সঙ্গে এমন ভাবে আলোচনা করার মতো গ্রহণযোগ্যতা আছে? দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকার যে কোনও কাজ করতে পারেনি, তার এটাই কারণ দলের মন্ত্রীরা জনসমক্ষে বিসম্বাদ করেছেন, এবং সব মিলিয়ে মোট ১৮৩টি এমপাওয়ার্ড গ্রুপ অব মিনিস্টারস রয়েছে।
প্রথম দফাতেই বা ইউ পি এ সরকার সংস্কারের পথে কতখানি হাঁটতে পেরেছিল? তথ্যের অধিকার আইন এবং জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনকে যদি সংস্কারের পর্যায়ভুক্ত করেন, তবে সংস্কারের তালিকায় ওই দুটি নামই আছে। ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স এবং বিভিন্ন সড়ক যোজনা এই সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল। আসল ফারাক অন্যত্র সরকার নীতিপঙ্গুত্বে ভুগছে, এই কথাটি ইউ পি এ সরকারের প্রথম দফায় সর্ব ক্ষণ বোধ হয়নি। দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারের ব্যর্থতা যে শুধু আইন প্রণয়নে, তা নয়। জোট রাজনীতি ও আইন প্রণয়নের অন্তর্নিহিত বিরোধেই আটকে পড়ে আমরা একটা ভুল করছি। এই সরকার প্রশাসনিক ভাবে ব্যর্থ, প্রায়োগিক ভাবে ব্যর্থ। ইউ পি এ সরকারে যে ক্ষমতার স্পষ্ট দুটি পৃথক কেন্দ্র রয়েছে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দফতরের হাতে যে চূড়ান্ত ক্ষমতা নেই তা এই ব্যর্থতার জন্য আংশিক ভাবে দায়ী।
সরকারি কর্তা, আমলাদের দিকে যদিও তাকানো প্রয়োজন। তাঁরা যত সিদ্ধান্ত করেন, তার সব তো আর বস্তুনিরপেক্ষ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের নিজস্ব মতামত, সিদ্ধান্তের অবকাশ থেকে যায়। দেখা গিয়েছে, বহু ক্ষেত্রেই আমলারা ভুল, দেশের স্বার্থের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত করেছেন। যেমন, যে সব প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর একমাত্র অধিকার থাকা উচিত ছিল দেশের মানুষের, সেই সম্পদ, আমলাদের সিদ্ধান্তে, বেসরকারি হাতে চলে গিয়েছে, যাচ্ছে। তথ্যের অধিকার আইন ঠিক এই জায়গাটাতেই অত্যন্ত জরুরি। এই আইনটি তৈরি হওয়ায় অনেক সিদ্ধান্তই আগের চেয়ে ঢের স্বচ্ছ হয়েছে। কোনও সিদ্ধান্ত যদি জনস্বার্থে, সৎ উদ্দেশ্যে, স্বচ্ছ ভাবে গৃহীত হয়, তা হলে এই আইনকে ভয় পাওয়ার কারণ নেই।
কিন্তু, সব সিদ্ধান্তই কি একেবারে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে, বিষয়-নিরপেক্ষ ভাবে করা সম্ভব? আদৌ না। যদি তাই হত, তা হলে অভিজ্ঞ আমলাদের কোনও প্রয়োজনই থাকত না। কম্পিউটারে তথ্য ভরে দিলে কম্পিউটারই সিদ্ধান্ত করতে পারত! কাজেই, অভিজ্ঞ আমলাদের প্রয়োজন রয়েছে তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই হবে। আমার মতে, আমাদের প্রত্যেকের ১৯৮৮ সালের প্রিভেনশন অব করাপশন অ্যাক্ট পড়া উচিত। এই আইনটি মুখ্যত অসৎ উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই তৈরি যে সব ক্ষেত্রে কোনও আমলা তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করেন চলতি ভাবে আমরা যাকে দুর্নীতি বলে জানি। কিন্তু, এই আইনের একটি বিশেষ ধারা রয়েছে ধারা ১৩ (ঘ)(৩) যে ধারাটি ব্যক্তিগত দুর্নীতির বিষয়ে নয়। এক জন সরকারি কর্তা হিসেবে আমি যদি এমন কোনও সিদ্ধান্ত করি যার ফলে কোনও তৃতীয় পক্ষ লাভবান হবে, তবে আমার কাজটি অপরাধের পর্যায়ভুক্ত (ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট) হবে। এক জন আমলা যে সিদ্ধান্তই করুন না কেন, তাতে কারও না কারও লাভ অবশ্যই হবে। মুশকিল হল, কোনও আমলা যদি একেবারে সৎ উদ্দেশ্যে, সব কিছু বিবেচনা করেও কোনও সিদ্ধান্ত করেন, সেই সিদ্ধান্তটি ভবিষ্যতে কার জন্য কী ভাবে লাভজনক হবে, সিদ্ধান্ত করার সময় তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। কাজেই, কোনও সিদ্ধান্তের ভবিষ্যৎ তাৎপর্য যাতে কোনও সরকারি কর্তাকে বিপাকে না ফেলে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যুগ্ম সচিব বা তার চেয়ে উঁচু পদে কর্মরত, এমন ১২২ জন আই এ এস অফিসারের বিরুদ্ধে গত পাঁচ বছরে সি বি আই ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে। অসৎ উদ্দেশ্যে কোনও সিদ্ধান্ত করেছেন, এমন সরকারি কর্তাদের শায়েস্তা করতে গিয়ে সৎ আমলাদেরও জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এখন ভারতের ক্ষমতার অলিন্দে দুর্নীতির হাওয়া বইছে এই অবস্থায় কোনও আমলারই আর রক্ষাকবচ নেই। কারও বিরুদ্ধে এক বার মামলা হল মানে কত ভাবে যে নাজেহাল হতে হবে, তার ইয়ত্তা নেই। সেই আমলা যদি শেষ পর্যন্ত বেকসুর খালাসও পান, তার আগে অবধি আইনজীবীর দক্ষিণা জোগাতে হবে, দীর্ঘ সময় ধরে চলা মামলায় বার বার হাজিরা দিতে হবে। ভুললে চলবে না, এই আমলারা দেখছেন যে মন্ত্রীরাও কোনও সিদ্ধান্ত করতে সাহস করছেন না খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেই সিদ্ধান্তহীনতার রোগ ছড়াচ্ছে। এক সময় ভারতের সিভিল সার্ভিসকে ইস্পাতের কাঠামো বলা হত। সেই কাঠামো একেবারে ভেঙে পড়েছে। রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ কমিয়ে আনা তুলনায় অনেক সহজ কাজ পাঁচ বছরেই সেই কাজটি করে ফেলা সম্ভব। কিন্তু, সিভিল সার্ভিসে যে ঘাটতি তৈরি হল, তা পুষিয়ে নিতে হয়তো ২০ বছরেরও বেশি সময় লাগবে।
এর পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণ, অরণ্য এবং পরিবেশ বিষয়ক ছাড়পত্রের কথাও বিবেচনা করা প্রয়োজন। এই আইনগুলি এবং তার সম্ভাব্য সংশোধনী বিষয়ে (খনি সংক্রান্ত আইন ও সংশোধনী সমেত) আমি ব্যক্তিগত ভাবে কী মনে করি, সেই প্রশ্নটা আপাতত উহ্য থাক। কথা হল, ছাড়পত্র নেওয়া যদি বাধ্যতামূলকই হয়, তবে দুটো জিনিস একেবারে বেঁধে দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমটি হল, ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করা হলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ধরা যাক ৩০০ দিন সিদ্ধান্ত করতে হবে। সরকার যদি ৩০০ দিনের মধ্যে কোনও একটি বিশেষ প্রকল্পকে ছাড়পত্র দেওয়া বা না দেওয়া বিষয়ে সিদ্ধান্ত না করতে পারে, তবে ধরে নিতে হবে যে সরকার ছাড়পত্র দিয়েছে। দ্বিতীয়টি হল, এক বার কোনও প্রকল্পকে ছাড়পত্র দেওয়া হলে ভবিষ্যতে আর সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা চলবে না। আইনের স্বচ্ছতার অভাবের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আদালতের হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে।
ইউ পি এ সরকারের প্রথম দফা এবং দ্বিতীয় দফার মধ্যে পার্থক্য কী? আমার মতে, মূল পার্থক্য দুটো এক, সিভিল সার্ভিস-এর ব্যবস্থাটি কার্যত ভেঙে পড়া; এবং দুই, বিভিন্ন ছাড়পত্রের বিষয়ে স্বচ্ছতার অভাব। তথাকথিত ‘সর্বজনীন বৃদ্ধি’-র গল্প নিয়ে আমার আপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু সেই সমস্যাটি সরকারের প্রথম দফাতেও ছিল। সরকারের দ্বিতীয় দফায় এই দুটি সমস্যা যুক্ত হয়েছে এবং কার্যত তার থেকেই সরকারের নীতিপঙ্গুত্ব, প্রশাসন-ঘাটতি, প্রায়োগিক-ঘাটতি আরম্ভ হয়েছে। এই সরকারের সম্বন্ধে আমাদের মনোভাব যে নেতিবাচক, তার কারণ এগুলোই। লেখার গোড়াতেই বলেছিলাম, পেশাদার অর্থনীতিবিদরা এই কারণগুলো সহজে বুঝতে পারেন না। ফলে, অর্থনৈতিক সমীক্ষাগুলোতে এই কারণগুলি উঠে আসে না। কিন্তু, কোনও অভিজ্ঞ আই এ এস অফিসারের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, তিনি আমার সঙ্গে একমত হবেন।
এই সমস্যাগুলো মেটানো অনেক বেশি কঠিন। তাই, অন্য অর্থনীতিবিদদের তুলনায় ভারত নিয়ে আমি ঢের কম আশাবাদী।

অর্থনীতিবিদ। দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর সঙ্গে যুক্ত। মতামত ব্যক্তিগত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.