বর্ষা এখন রয়েছে দেশের অর্ধেকটা জুড়ে। কিন্তু তার ‘গজেন্দ্রগমন’ এবং ‘অস্থিরমতি’ রীতিমতো চিন্তায় ফেলে দিয়েছে অর্থনীতিবিদ এবং বাজার বিশেষজ্ঞদের একাংশকে।
দক্ষিণবঙ্গে ১১ দিন দেরিতে বর্ষা ঢুকেছে বটে, কিন্তু আকাশ কালো করে, ঘন ঘন বাজ পড়ে বৃষ্টি তো হচ্ছে না? ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিও বা নেই কেন? আসলে বর্ষা এলেও সে এখন দুর্বল। বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণাবর্ত কবে শক্তিশালী হবে তার উপরেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। একই ভাবে দেশের যে সব অঞ্চলে ইতিমধ্যেই বর্ষা এসে গিয়েছে সেখানেও বর্ষা অপুষ্ট। তাই জুন মাসে দক্ষিণবঙ্গ সহ গোটা দেশেই বর্ষার ঘাটতি আর মিটবে না বলেই আশঙ্কা করছেন দিল্লির মৌসম ভবনের আবহবিদেরা।
জুন মাসের এই সময়টায় বর্ষা পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল গোটা পূর্ব ভারত ছাড়িয়ে উত্তর-পশ্চিমে। বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যেই খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গোটা দক্ষিণ ভারত, মধ্য ভারত এবং উত্তর-পূর্ব ভারতেও বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক মাত্রা থেকে অনেকটাই নীচে। আর এই ঘাটতি বৃষ্টিতে দেশ জুড়ে কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনে সঙ্কট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ এবং বাজার বিশেষজ্ঞেরা। বাজারে ইতিমধ্যেই ডাল, চাল, গম, বজরা, তৈলবীজের দাম বেড়েছে। বৃষ্টির অভাবে খাদ্যসশ্য উৎপাদন কম হতে পারে সেটা ধরে নিয়েই এক শ্রেণির ব্যবসায়ী মাল মজুত শুরু করেছেন বলেও অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। মরসুমের শুরুতেই এ বার স্বাভাবিক বর্ষার পূর্বাভাস দিয়েছিল মৌসম ভবন। |
দেশে ঘাটতি বৃষ্টি
(১ থেকে ১৬ জুন) |
অঞ্চল |
কত বৃষ্টি হল
(মিলিমিটার) |
কত হওয়ার কথা
(মিলিমিটার) |
ঘাটতি
(শতাংশ) |
সারা দেশ |
২৯.২ |
৫০.৬ |
৪২ |
উত্তর-পশ্চিম |
৯.০ |
১৯.০ |
৫২ |
মধ্য ভারত |
১৩.৬ |
৩৮.৮ |
৬৫ |
দক্ষিণ ভারত |
২৫.২ |
৫৮.২ |
৫৭ |
পূর্ব, উত্তর-পূর্ব |
১০৫.৫ |
১২৬.০৯ |
১৭ |
(১ থেকে ১৮ জুন) |
রাজ্যে ঘাটতি |
অতি বৃষ্টি |
জেলা |
কত ঘাটতি
(শতাংশ) |
জেলা |
কত বেশি
(শতাংশ) |
উত্তর দিনাজপুর |
৯৯ |
জলপাইগুড়ি |
৯০ |
নদিয়া |
৮২ |
দার্জিলিং |
৪০ |
দক্ষিণ ২৪ পরগনা |
৮১ |
কোচবিহার |
৮০ |
মালদহ |
৭১ |
|
দক্ষিণ দিনাজপুর |
৫৯ |
|
উত্তর ২৪ পরগনা |
৪৯ |
|
বর্ধমান |
৪৮ |
|
হুগলি |
৪৫ |
|
মুর্শিদাবাদ |
৪০ |
|
|
কিন্তু জুনের গোড়া থেকে এ পর্যন্ত বর্ষার স্বাভাবিক ছন্দ দেখা যায়নি। গোটা দেশে স্বাভাবিকের তুলনায় (১ থেকে ১৬ জুনের হিসাব) ৪২ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টিপাতের ঘাটতির পরিমাণ ৫৮ শতাংশ। এর বিপরীত চিত্রও অবশ্য রয়েছে। দক্ষিণবঙ্গে যখন বর্ষা ঢুকেও শক্তি পাচ্ছে না, উত্তরবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়িতে তখন অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অতিবৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টি, দুই প্রাকৃতিক অবস্থাই চাষের ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। তবে অনাবৃষ্টির ব্যাপকতা বন্যার চেয়ে অনেকটাই বেশি। বন্যা হলে জল নেমে যাওয়ার পর ফের চাষ শুরু করা যায়। কিন্তু অনাবৃষ্টিতে স্বাভাবিক চাষের কোনও সম্ভাবনাই থাকে না বলে কৃষি বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষার স্বাভাবিক ছন্দের উপরেই দেশের কৃষির বেশিরভাগটা নির্ভরশীল। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না পেলে এক দিকে যেমন খারিফ শস্যের চাষ মার খাবে, তেমনই মুশকিলে পড়বে রবিচাষও। কারণ, বর্ষার জল বিভিন্ন জলাধারে এবং ভূস্তরে সঞ্চিত হয়। শীতের মরসুমে সেই জল দিয়েই সেচের কাজ চলে। বিশেষত, দক্ষিণ ভারতে, যেখানে নদীগুলি মূলত বৃষ্টির জলে পুষ্ট সেখানে পর্যাপ্ত বর্ষা না হলে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত। কৃষিবিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারতে মোট কৃষিযোগ্য জমির ৫৮ % বৃষ্টির উপর নির্ভর করে। ভুট্টা, মুগ, সয়াবিন, রেড়ি এবং প্রায় ৬০% তুলোচাষও বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল।
বর্ষার খামখেয়ালিপনায় ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অংশে মার খেয়েছে চাষের কাজ। অল ইন্ডিয়া ভেজিটেবল গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রের খবর, “গত দু’সপ্তাহে সব্জির উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মার খেয়েছে।” দেশের যে অঞ্চলগুলিতে খারিফ চাষ করা হয়, সেখানে গত কয়েক দিনে বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের অর্ধেক। মৌসম ভবনের তথ্য বলছে, পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে গত সাত দিনে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৩ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। দক্ষিণ ও মধ্য ভারতে এর পরিমাণ যথাক্রমে ৪৪ এবং ৫৪ শতাংশ। পূর্ব ভারতে বৃষ্টিপাত ঠিক মতো না হওয়ায় চাল উৎপাদন অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে।
বর্ষার উপরে শুধু কৃষি নয়, সরকারের প্রশাসনিক নীতি-নির্ধারণ এবং বৃহত্তর অর্থনীতিও নির্ভর করে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নির্দিষ্ট সময়ে বর্ষার আসা-যাওয়ার প্রভাব সমাজের সকল ক্ষেত্রেই পড়ে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপরেও অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি। বর্ষা পর্যাপ্ত না হলে খরা তৈরি হয়। সেই খরা যেমন রাজনৈতিক ফায়দা তোলার হাতিয়ার, তেমনই সাধারণ জীবনের ক্ষেত্রেও তার প্রভাব রয়েছে। খরার প্রভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ঘাটতি তৈরি হয়। শুধু তাই নয়, পানীয় জলের সরবরাহেও তৈরি হয় সমস্যা। কৃষিপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত সংস্থাগুলিকেও সমস্যার মুখে পড়তে হবে বলে অর্থনীতিবিদদের অভিমত।
অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার বলেন, “ভারতের কৃষি অর্থনীতিতে বর্ষা একটি বড় নিয়ন্ত্রক। দেশের সেচের অধিকাংশটাই এখনও বর্ষার উপর নির্ভর করে। তাই বর্ষা অতিরিক্ত কম বা বেশি হলে কৃষি উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।’’ তাঁর মতে, দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর হওয়ায় কৃষি উৎপাদনের উপর একটি বড় অংশের লাভ বা ক্ষতি নির্ভর করে। তবে পশ্চিমবঙ্গে বর্ষার কিছুটা অস্বাভাবিকতা এখনই কোনও বিপর্যয় ডেকে আনতে বলে মনে করেন না বাজার বিশেষজ্ঞ এবং কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জের ভাইস-প্রেসিডেন্ট অরিন্দম সাহা। তিনি বলেন, “উত্তরবঙ্গে ভাল বৃষ্টি হওয়ায় সেখানে পাট ভাল হবে বলেই মনে হচ্ছে। আর বর্ষার যে দেরিটা হয়েছে তাতে দক্ষিণবঙ্গে চাষের কাজে বড় মাপের বিপর্যয় হবে বলে মনে হয় না।”
কিন্তু দক্ষিণবঙ্গে ঢুকেও কেন বৃষ্টি দিচ্ছে না বর্ষা? আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ জানাচ্ছেন, “সব কিছু নির্ভর করছে বঙ্গোপসাগরের উপরে থাকা ঘূর্ণাবর্তটির উপরে, বর্ষার ভাগ্যনিয়ন্তা এখন সেটাই। ওই ঘূর্ণাবর্ত নিম্নচাপে পরিণত হলে বর্ষা অতিসক্রিয় হয়ে পড়বে। না হলে নামেই বর্ষা। বৃষ্টি তেমন হবে।” |