জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ততার চরম সীমায় নিয়ে যেতে না চাইলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র নড়তে নারাজ তৃণমূল। ফলে এই প্রশ্নে এখনও তারা কংগ্রেসের কড়া সমালোচক। অন্য দিকে, দলীয় হাইকম্যান্ডের নির্দেশ পাওয়ার পরেও এই বিষয়ে তৃণমূলকে ছেড়ে কথা বলতে নারাজ কংগ্রেসের রাজ্য নেতারা। ফলে দু’পক্ষে ভাঙন এড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও পারস্পরিক চাপানউতোরের উত্তাপ কমেনি।
এ দিন তৃণমূলের বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আক্রমণ না করলেও রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুলতান আহমেদ তাঁর কঠোর সমালোচনা করেন। প্রণববাবু ‘নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য কারও কথা ভাবেন না’ বলে মন্তব্য করেন সুব্রতবাবু। তিনি অভিযোগ করেন, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, অজিত পাঁজা, এ বি এ গনি খান চৌধুরীর মতো নেতাদেরও একদা নানা ভাবে ‘হেনস্থা’ করেছেন প্রণববাবু। সুলতান মন্তব্য করেন, কারও ‘সুখবর’ থাকলে তিনি তা তাঁর বাবা-মা বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের জানান। কিন্তু প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার কথা শুনেই ফোন করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসুর মতো সিপিএম নেতাদের। কেননা, প্রণববাবু তাঁদের নিজের ‘ভাই’ বলেই মনে করেন! সুলতানের আরও বক্তব্য, প্রণববাবুকে রাষ্ট্রপতি পদে জয়ী করতে এক শিল্পপতি নানা জায়গায় ‘ব্রিফ’ নিয়ে ঘুরছেন। বৈঠকে বর্ষীয়ান সাংসদ সোমেন মিত্র, সুব্রত বক্সি ও রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় দলনেত্রীর অবস্থানের সমর্থনে বক্তৃতা দেন। সোমেনবাবু জানান, কালামই ‘উপযুক্ত’ প্রার্থী। মমতার সিদ্ধান্ত সঠিক।
কালাম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দৌড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ায় তাঁরা ‘গভীর বেদনাহত’ বলে নিজের ফেসবুকে একটি ‘পোস্ট’ করেছেন মমতা। সেখানে তিনি নাম না-করে এক শ্রেণির রাজনীতিককে কঠোর আক্রমণ করেছেন। বৈঠকেও নাম না করে মুলায়ম সিংহ যাদবকে এক হাত নিয়েছেন মমতা। জানিয়েছেন, সমর্থন করার কথা বলে কেউ যদি রাতের অন্ধকারে পিছনের দরজা দিয়ে কারও সঙ্গে বৈঠক করতে চলে যায়, তা হলে কী করা যাবে! মমতার মতে, রাষ্ট্রপতি পদে এ পি জে আব্দুল কালামই যে সব চেয়ে ‘উপযুক্ত’, তা দেশের মানুষই বলবেন। তৃণমূলের সংখ্যা কম ছিল। তাই তাঁরা লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি। কিন্তু তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তৃণমূল সূত্রের দাবি, কালামকে প্রার্থী করার ব্যাপারে তাঁরা হাল ছাড়ছেন না বলেও বৈঠকে জানান মমতা। সুদীপবাবু বলেন, “কালাম রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হলে দেশের মঙ্গল হত। এখনও কয়েক দিন বাকি আছে। আমাদের প্রচেষ্টা জারি থাকবে।”
বৈঠকে মমতা জানান, সনিয়ার কাছে প্রণববাবুর নাম নিয়ে আপত্তি জানানোর পাশাপাশি তিনি কোনও দলিত নেত্রীকে (লোকসভার স্পিকার মীরা কুমার) রাষ্ট্রপতি পদের জন্য বিবেচনা করতে আবেদন জানান। মমতার আরও দাবি, সনিয়ার পছন্দের যে নামগুলি তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তা সনিয়াই তাঁকে প্রকাশ্যে বলতে বলেছিলেন। তৃণমূল নেত্রীর প্রশ্ন, তার পরেও কংগ্রেসের তরফে প্রতিদিন তাঁর ‘শিষ্টাচার’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে! অথচ যে ভাবে শরিক দলের সঙ্গে আলোচনা শেষ না-হতেই কংগ্রেস (প্রণববাবু) রাজ্যের বিরোধী দলের (সিপিএম) সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, তা কী ধরনের ‘শিষ্টাচার’!
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূলের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চাননি মমতা। জানিয়েছেন, পরে আবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দলের এক রাজ্যসভা সাংসদ বলেন, “নেত্রী বলেছেন, এই ভোটের সঙ্গে অনেক কিছু জড়িয়ে আছে। তৃণমূল সততার পথেই রয়েছে। তা-ই থাকবে। এখনও অনেক সময় রয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কাকে সমর্থন করা হবে, তা পরে ঠিক করা হবে।”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য, অধীর চৌধুরী, মৌসম বেনজির নূর, শঙ্কর সিংহ, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মনোজ চক্রবর্তীরা এ দিন তৃণমূল এবং মমতাকে যথেষ্ট ‘চড়া সুরে’ই রাজনৈতিক আক্রমণ করেছেন। রাজারহাট এবং টালিগঞ্জে অধীর যেমন বলেন, “কালামকে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা করছেন, সেটাকে বলে, যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই। কালাম বলছেন, প্রার্থী হবেন না! আর মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, কালামকে রাষ্ট্রপতি করতে হবে! মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি থেকে কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলেন। এখন কলকাতা থেকে পালিয়ে ফেসবুকে আত্মগোপন করেছেন। আগে মানুষের হৃদয়ে থাকতে চাইতেন। এখন ফেসবুকে থাকতে চান!” |