শেয়ার বাজার ও শিল্পমহল তৈরি ছিল স্বাগত জানানোর জন্য। কিন্তু বাস্তবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঋণনীতি সুদের হার কমানোর পথে না- হেঁটে তাদের ঠেলে দিল আরও বেশি দুশ্চিন্তা ও হতাশার অন্ধকারে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে সুদ কমাবে, এ বার সে ব্যাপারে একরকম নিশ্চিতই ছিল সংশ্লিষ্ট মহল। কিন্তু কার্যত বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে চড়া মূল্যবৃদ্ধির কারণ দর্শিয়ে ঋণনীতির মধ্য ত্রৈমাসিক পর্যালোচনায় সুদ অপরিবর্তিতই রাখল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ফলে অখুশি শিল্পমহল, শঙ্কিত শেয়ার বাজার, হতাশ গাড়ি-বাড়ি কিনতে ঋণের মুখাপেক্ষী সাধারণ মানুষ।
যদিও রফতানি ঋণের ভিত্তিতে ব্যাঙ্ককে বাড়তি তহবিল জুগিয়ে ঘুরপথে ৩০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি নগদের সংস্থান করেছেন শীর্ষ ব্যাঙ্কের গভর্নর ডি সুব্বারাও। তবে সুদ কমালে তা আর্থিক বৃদ্ধিতে ইন্ধন জোগানোর বদলে মূল্যবৃদ্ধির চাপ বাড়াত বলে মন্তব্য করেন তিনি। অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও বলেছেন, মূল্যবৃদ্ধিকে মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত। প্রসঙ্গত, পাইকারি মূল্য সূচকের ভিত্তিতে মে মাসে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধি ছুঁয়েছে ৭.৫৫%। ভোগ্যপণ্যের খুচরো দামের ভিত্তিতে তা ১০.৩৬%।
আশায় ভর করে ঋণনীতি পেশ করার ঠিক আগে সকালেই সেনসেক্স চড়চড় করে ১৬০ পয়েন্ট বেড়ে ১৭ হাজার টপকে গেলেও সুদ না-কমার খবরে তা এক ঝটকায় পড়ে যায় ৩০২ পয়েন্টেরও বেশি। বাজার বন্ধের সময় সেনসেক্স দাঁড়ায় ১৬,৭০৫.৮৩ পয়েন্টে, যা আগের দিনের থেকে ২৪৪ পয়েন্ট কম। তবে ফিচ-এর ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কার খবর বাজার বন্ধ হওয়ার পরে নেওয়া বলে এ দিন তার প্রভাব পড়েনি। আগামী কাল তা সেনসেক্সকে টেনে নামাতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রত্যাশা পূরণ না-করায় এবং ফিচ-এর হুমকির জেরে ডলারে টাকার দামও পড়েছে হু হু করে। ৫৩ পয়সা পড়ে দিনের শেষে তা বন্ধ হয় ৫৫.৯৩ টাকায়।
রফতানি ঋণের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে আরবিআই যে তহবিল জোগায়, এত দিন তা ছিল ওই ঋণের ১৫%। এ বার তা হল ৫০%। ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞ এবং ইউকো ব্যাঙ্কের প্রাক্তন এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর বি কে দত্ত বলেন, এতে নগদ জোগানের সঙ্কট কিছুটা কাটবে। এর ফলে যে-তিনটি সুবিধা মিলবে, সেগুলি হল:
• অর্থনীতিতে এখন নগদের জোগানে যে ৮০-৮৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে, তা কমে দাঁড়াবে ৫০ হাজার কোটি, যেটা স্বাভাবিক। ৩০ হাজার কোটি টাকার এই বাড়তি পুঁজির জোগান নগদ জমার অনুপাত ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমানোর সমান।
• ব্যাঙ্কগুলি রফতানিকারীদের বাড়তি ঋণ দিতে উৎসাহিত হবে।
• রফতানি ঋণের ভিত্তিতে শীর্ষ ব্যাঙ্কের মঞ্জুর করা ওই তহবিল (রিফাইনান্স) থেকে সাধারণ ভাবে ঋণ দেওয়া যাবে শিল্পকেও। এবং তা তারা পেতে পারবে তুলনায় কম সুদে। কারণ নিয়ম অনুযায়ী এই তহবিল থেকে ঋণে সুদের হার রেপো রেটের (৮%) তুলনায় ৩.৫ থেকে ৪ শতাংশের বেশি হয় না। ফলে শিল্প ঋণে কিছু ক্ষেত্রে সুদ দাঁড়াবে ১১.৫ থেকে ১২%। বর্তমানে ১৭-১৮% সুদেই ঋণ নিতে হয় শিল্পকে। হতাশার মধ্যেও শিল্পকে কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছে সুব্বারাওয়ার এই সিদ্ধান্ত।
|
একনজরে |
• আশঙ্কা চড়া মূল্যবৃদ্ধির
• অপরিবর্তিত রেপো (৮%), রিভার্স রেপো (৭%), নগদ জমার অনুপাত (৪.৭৫%), ব্যাঙ্ক রেট (৯%)
• ব্যাঙ্কের রফতানি ঋণে তহবিল জোগান বাড়িয়ে ঘুরপথে ৩০ হাজার কোটি নগদের সংস্থান
• সেনসেক্স নামল ২৪৪
• হুঁশিয়ারি ফিচ-এর
• ডলারে টাকা পড়ল ৫৩ পয়সা |
|
তবে শুধু মূল্যবৃদ্ধি কমানোর লক্ষ্যে এগিয়ে আর্থিক বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছে শিল্পমহল। সিআইআইয়ের ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যখন আর্থিক বৃদ্ধি ক্রমাগত কমছে, তখন এ ধরনের নীতি একপেশে।” ফিকি বলেছে, “জোগানে ঘাটতিকে মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে কবুল করেছ আরবিআই। তা সত্ত্বেও, রেপো রেট না-কমানোটা আশ্চর্যের। অ্যাসোচ্যামের মতে, “সুদ কমালে শিল্পোৎপাদন বাড়ায় উৎসাহ জুগিয়ে তা আর্থিক বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করত।” এ দিকে, রীতিমতো হতাশ আবাসন ও গাড়ি শিল্প। গাড়ি-বাড়ি ঋণে সুদ এখনই না কমলে বড়সড় ধাক্কার আশঙ্কায় রয়েছে সংস্থাগুলি। প্রায় ৭০% ক্রেতাই গাড়ি কেনেন ঋণ নিয়ে। কিন্তু এই ঋণে সুদ এতটাই চড়া যে, বিশেষ করে ছোট গাড়ির বাজার পড়তির দিকে। সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ান অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স-এর ডিজি বিষ্ণু মাথুরের অভিযোগ, এই সিদ্ধান্ত শিল্পের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিতে পারে। সুদ না-কমলে গাড়ি শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। মে মাসের হিসেব বলছে, যাত্রী-গাড়ি বিক্রি বৃদ্ধির হার ইতিমধ্যেই তলানিতে ঠেকেছে। |