দিল্লি বোর্ডে মেয়েদের যে ‘জয়যাত্রা’ চলছিল, তা যেন কিছুটা থমকে গেল মাধ্যমিকে এসে! যার জন্য মূলত গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের প্রতি সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্যের দিকেই আঙুল উঠেছে।
আইসিএসই-সিবিএসই’তে এ বারও পাশের হারে টক্কর দিয়ে ছাত্রদের পিছনেও ফেলেছে মেয়েরা। এমনকী, দিল্লি বোর্ডের বিভিন্ন পরীক্ষায় সম্ভাব্য মেধা-তালিকাতেও মেয়েদের উপস্থিতি প্রবল। মঙ্গলবার মধ্যশিক্ষা পর্ষদ প্রকাশিত মাধ্যমিকের মেধা-তালিকাতেও ছাত্রীর সংখ্যা নজর এড়িয়ে যাওয়ার নয়। কিন্তু সার্বিক পাশের হারের নিরিখে মেয়েদের অবস্থানটা একটু ম্রিয়মান।
এ বার মাধ্যমিকে পাশের হার ৮১.০৬%। মোট ১০,০৫,৫৩৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৫,১৯,২০৫ (অর্ধেকেরও বেশি)। কিন্তু ছাত্রদের ক্ষেত্রে পাশের হার যেখানে ৮৫.৭২%, ছাত্রীদের তা ৭৬.৫১%। গত বছরও এই দু’টি ছিল যথাক্রমে ৮৪.৮৫% ও ৭৬.৩৩%।
বছর গড়ালেও মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে কাম্য পরিবর্তন আসছে না কেন?
মেয়েদের প্রতি ‘বৈষম্যমূলক’ আচরণই এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন শিক্ষক, সমাজসেবী, সমাজতত্ত্ববিদদের বড় অংশ। তাঁদের মতে, মূলত শহরাঞ্চলে এবং সমাজের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত শ্রেণি থেকে আইসিএসই-সিবিএসই স্কুলে পড়াশোনা করতে আসে ছেলে-মেয়েরা। ধরে নেওয়া যায়, এমন অধিকাংশ বাড়িতে ছেলে-মেয়ের ফারাক করা হয় না। মেয়েরা পড়াশোনার সমান সুযোগ পায়। ফলে পাশের হারে তো বটেই, মেধাবী মেয়েদের প্রথম সারিতে উঠে আসার পথেও বিশেষ বাধা নেই। সে জায়গায় মাধ্যমিকে বসা মেয়েদের বিশাল অংশ গ্রামাঞ্চলের নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। যাদের অনেকের কাছে পড়াশোনা করাটাই ‘চ্যালেঞ্জ!’
প্রতীচী ট্রাস্টের প্রকল্প-আধিকারিক কুমার রাণা যেমন বলেন, “অনেক বাড়িতে এখনও প্রশ্ন ওঠে, মেয়েরা সকাল-সকাল স্কুলে চলে গেলে বাসন মাজবে কে? মেয়েদের প্রাইভেট টিউটরের কাছে পাঠাতে অনীহা, আবার বাড়িতে পড়া দেখানোর কেউ নেই! অপুষ্টি তো আছেই।” তাঁর আক্ষেপ, “শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও অনেকে ভাবেন, মেয়েদের বুদ্ধি কম। তাই মেয়েদের পড়ানোয় তাঁদের আগ্রহও কম।”
এবং মাধ্যমিকের ফলাফলে এই সামাজিক বৈষম্যেরই প্রতিফলন পড়েছে বলে কুমারবাবুর দাবি। মাধ্যমিকের জেলা-ভিত্তিক পরিসংখ্যানও বলছে, যেখানে অপুষ্টি বেশি, সেই পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোয় ছাত্রীরা পাশের হারে ছেলেদের অনেকটা পিছনে। ব্যবধানটা মুর্শিদাবাদে অন্তত ১৬%, মালদহ-পুরুলিয়ায় ১৪%, জলপাইগুড়িতে ১৩%। সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্রের কথায়, “অপুষ্টি শুধু খাদ্যের অভাবজনিত নয়। মেয়েকে সামান্য একটা সাইকেল কিনে দেওয়া নিয়েও পরিবারে যে কত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়! ফলে ওরা মনের পুষ্টিও পায় না।” বীরভূমের বরাহ শ্রীগৌরাঙ্গ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা বিদিশা ঘোষ জানাচ্ছেন, এ বছর তাঁদের স্কুল থেকে মাধ্যমিকে প্রায় একই রকম নম্বর নিয়ে পাশ করেছে দুই ভাই-বোন। কিন্তু অভিভাবকেরা মেয়েকে জানিয়েছেন, একাদশে শুধু ভাই-ই ভর্তি হবে!
এ হেন পারিবারিক পক্ষপাতের সুরাহা কী? অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকার বলেন, “আইন করে সমাধান সম্ভব নয়। মানুষকেই বুঝতে হবে, ছেলে-মেয়েতে ফারাক নেই। তবে বিহারে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার জন্য যেমন সাইকেল দেওয়া হয়েছে, এ রাজ্যও তেমন কিছু করতে পারে।” সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়ের বক্তব্য: সামাজিক বাধা, লিঙ্গবৈষম্য দূর করার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের স্কুলে পরিকাঠামো উন্নয়নও জরুরি।
শিক্ষাদানের ভার যাঁদের, তাঁরা কী বলছেন? ছাত্রীদের, বিশেষত গ্রামবাংলার ছাত্রীদের সমস্যা সম্পর্কে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি চৈতালি দত্তও ওয়াকিবহাল। তিনি জানান, মহিলা কমিশনের তরফে নানা প্রচারের ব্যবস্থা হয়েছে। তবে তাতে যে সমস্যা ঘুচবে না, সেটাও তিনি স্বীকার করেন। “মেয়েরা যাতে যোগ্যতার স্বীকৃতি পেতে পারে, সে জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা দরকার। এ নিয়ে সর্বশিক্ষা মিশনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।” মন্তব্য চৈতালিদেবীর। |