দুর্বল ডানায় ভর করেই ওরা চক্কর দিয়ে ফেলেছে অনেকটা আকাশ। ওদের ডানায় রৌদ্রের গন্ধ।
সব্যসাচী মিত্র, অনির্বাণ দে ও পিঙ্কি মণ্ডল ক্যানসারে আক্রান্ত। তিন জনেরই বাবার যৎসামান্য রোজগার। কিন্তু সব কিছু ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে তিন জনই পেরোল মাধ্যমিকের চৌকাঠ। বিস্তর কেরামতি দেখাল আরও দুই ছাত্র। কখনও খেয়ে, কখনও না-খেয়ে সুব্রত মণ্ডল প্রমাণ করেছে, দিনমজুর বাবার প্রতিভাধর ছেলের ঘরানা এখনও মুছে যায়নি বাংলার মাটি থেকে। মধুসূদন কুইলা বনের পথিক। জঙ্গলে শালপাতা কুড়োনোর ফাঁকেই সে দেখে রেখেছে, আকাশটা অনেক বড়।
সব্যসাচী মিত্র এবং অনির্বাণ দে বনগাঁ হাইস্কুলের ছাত্র। বনগাঁ শহরের কোড়ালবাগানের বাসিন্দা সব্যসাচীর (মাধ্যমিকে ৪২০) শিরদাঁড়ায় ক্যানসার ধরা পড়ে ২০১০-এ। হাসপাতালে চিকিৎসা চললেও চালিয়েছে পড়াশোনাও। বাবা বিশ্বনাথ মিত্র সব্জি বিক্রি করেন। কয়েকবছর আগে মেয়ের বিয়ে এবং তার পরে ছেলের এই রোগের চিকিৎসার খরচ চালাতে ইতিমধ্যেই কয়েক লক্ষ টাকা ধার হয়ে গিয়েছে। দুশ্চিন্তার মধ্যে মঙ্গলবার তাঁর মুখে হাসি ফোটাল ছেলের মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করার খবর। সব্যসাচীর লক্ষ্য, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। যদি অসুখ বাধা হয়? প্রত্যয়ী ছাত্রটি বলে, “যা হবে, দেখা যাবে।”
সব্যসাচীর বন্ধু অনির্বাণ (মাধ্যমিকে ৩৬০) পাশের মাঝেরপাড়ার বাসিন্দা। ২০০৯-এ তার বুকে ক্যানসার ধরা পড়ে। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে তার কেমোথেরাপি চলছে। চিকিৎসকদের বারণ সত্ত্বেও মাধ্যমিকের ফল জানার জন্য রবিবার সে হাসপাতাল থেকে বাড়ি চলে আসে। বাবা অনুপমবাবু লন্ড্রি চালান। অনির্বাণের লক্ষ্য, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। |
পিঙ্কি মণ্ডলের বাবা নেই। অভাবী সংসারে বন্ধই হতে বসেছিল পড়াশোনা। স্কুলের শিক্ষিকা ও সহপাঠীরা বর্ধমানের হিরাপুরের এই মেয়েকে (মাধ্যমিকে ২৩১) স্কুলে ফিরিয়েছেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁদের সাহায্যেই ক্যানসারকে মাঠের বাইরে রেখে মাধ্যমিক ডিঙিয়েছে পিঙ্কি। মঙ্গলবার ফল প্রকাশের পরে পিঙ্কি অবশ্য কৃতিত্ব দিয়েছে ‘ভারতী দিদিমণি’কেই। তার কথায়, “দিদিমণি বলেছিলেন, লড়াইয়ে জিততে হবে। আমি শুধু তাঁর কথা মতো চলেছি।” আর ভারতী দেব বলেন, “লড়াইটা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”
জঙ্গলে শালপাতা কুড়িয়ে বিক্রি করে মধুসূদন কুইলা। সঙ্গে থাকেন মা। মাধ্যমিকে ৫৫৪ পেয়েছে মধুসূদন। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম ব্লকের তুফুরিয়া গ্রামের মধুসূদনের জন্য গর্বিত নয়াগ্রাম বাণী বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক বিকাশকুমার মণ্ডল। বলেন, “আমরা তৃপ্ত। স্কুল লাইব্রেরি থেকে বই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে লম্ফের আলোয় পড়েছে মধুসূদন।” মধুসূদন একাদশে বিজ্ঞান পড়তে চায়। হতে চায় শিক্ষক। মধুসূদনের ‘নিরক্ষর’ মা মানসীদেবী বলেন, “আমার পরিশ্রম সার্থক।”
বীরভূমের নলহাটির বানিওড় গ্রামের দিনমজুর পরিবারের ছেলে সুব্রত মণ্ডল। নম্বর পেয়েছে ৬৬৫। বাবা মোহনরায় মণ্ডল বলেন, “কোনও দিনই ছেলেকে সব বই কিনে দিতে পারিনি। স্কুলের শিক্ষক ও গ্রামের অনেকেই সাহায্য করেছেন।” বানিওড় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আশিসকুমার মণ্ডলের প্রত্যয়, “সুব্রত অনেক দূর যাবে।”
|
নিজস্ব চিত্র
(প্রতিবেদন: কিংশুক গুপ্ত, অরুণ মুখোপাধ্যায়, সুশান্ত বণিক এবং সীমান্ত মৈত্র) |