দেশের অর্থনীতি সংক্রান্ত ভাবনাটি কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রধানত মহাত্মা গাঁধীর চিন্তাসূত্র মেনে তৈরি হয়েছিল। গাঁধী আধুনিক অর্থনীতিকে বেশ সন্দেহের চোখে দেখতেন। তিনি মনে করতেন, আসলে শিল্পায়িত হতে না পারার জন্য ভারতীয় অর্থনীতির এমন দুর্দশা হয়েছে, তা নয়, বরং শিল্পায়নের চেষ্টাই ভারতের সর্বনাশ ডেকেছে। গাঁধী মনে করতেন, স্বয়ম্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি, কুটির শিল্পই ভারতের যথার্থ ভবিষ্যৎ। ফলে, কংগ্রেসের মধ্যে প্রধান মত ছিল, দেশ স্বাধীন হলে আধুনিক শিল্প নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে। এ দিকে, কংগ্রেসের ‘তরুণ তুর্কি’রা এই মতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁরা মনে করতেন, শিল্পায়নের পথই উন্নয়নের পথ। এই মতের পথিকদের মধ্যে যেমন জওহরলাল নেহরু ছিলেন, তেমনই ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ফলে, কংগ্রেসের মধ্যে অর্থনীতির প্রশ্নে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। নেহরুরা জানতেন, আধুনিক অর্থনীতির পথে হাঁটতে গেলে যাত্রারম্ভটা অন্তত জোরের সঙ্গে করা প্রয়োজন। ১৯৩৮ সালে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন হল হরিপুরায়। সেই অধিবেশনে কংগ্রেসের সভাপতি (তখন বলা হত রাষ্ট্রপতি) সুভাষচন্দ্র বসু একটি ‘ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি’ তৈরি করার প্রস্তাব করলেন। সেই কমিটির কাজ হবে দেশের শিল্প-সম্ভাবনা বিচার করা, তার পথনির্দেশ করা। |
উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র? মানুষের ভিড়ে জওহরলাল নেহরু। |
অর্থাৎ, শিল্পের পথে এগোতে গেলে যে পরিকল্পিত ভাবে এগোতে হবে, রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে, এই ধারণাটি দেশ স্বাধীন হওয়ার অন্তত দশ বছর আগে থেকেই ছিল। শিল্পায়নের মাধ্যমে যে ‘নতুন ভারত’ তৈরি করা যাবে, নেহরু তাতে আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করতেন। এবং, মনে করতেন, তা পরিকল্পনার মাধ্যমেই সম্ভব। তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার নাগরিককে সমান চোখে দেখার। দ্বিতীয় পরিকল্পনা নিয়ে যখন তিনি সম্পূর্ণ ভাবে মেতে আছেন, তখন দেশের রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের তিনি এক চিঠিতে লিখছেন, ‘কল্যাণরাষ্ট্র কোনও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের কল্যাণচিন্তা করবে না, তার সাধনা সমগ্র দেশের কল্যাণ। কল্যাণরাষ্ট্রের দায়িত্ব হল সকলের জন্য উৎপাদনশীল ও অর্থপূর্ণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। দেশে যে গভীর (আর্থিক) বৈষম্য রয়েছে, তার বিলুপ্তিসাধন’। সেই কাজের দায়িত্ব বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি মুখ্যমন্ত্রীদের পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁরা যেন ভারতের এক প্রান্তের সঙ্গে অন্য প্রান্তের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কথা জোর দিয়ে বলেন। দেশের এক অংশের স্বার্থের সঙ্গে যে অন্য অংশের স্বার্থ বিশেষ ভাবে জড়িত, এই কথাটি মানুষকে বোঝানো গেলেই ‘ভারতের অনেকগুলি বড় সমস্যা, যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা বা সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার বিরুদ্ধে লড়া সম্ভব হবে। আমরা যত সর্বভারতীয় ছবিটির কথা ভাবব, যত দেখব যে সেই ছবিতে সবার স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে, এবং দেশের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আমরা একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছি, আমাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার প্রবণতাও ততই কমবে। আমরা প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিভেদ এবং এ রকম অন্যান্য বিচ্যুতির পথে কম হাঁটব।’ অর্থাৎ, যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে রাজনৈতিক ভাবে এককেন্দ্রিক একটি ব্যবস্থাকে স্বাধীনতার মুহূর্তে অপরিহার্য বোধ হয়েছিল, নেহরু সেই পরিস্থিতির সমাধানসূত্র খুঁজেছিলেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে।
এবং, শুধুমাত্র শিল্পায়ন নয়, কৃষির ক্ষেত্রেও নেহরু প্রচলিত পথ ছেড়ে বেরিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের পথে হাঁটার কথা ভেবেছিলেন। দ্বিতীয় পরিকল্পনায়, অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই কাজটি হয়নি। যেন একটা প্রত্যাশাই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, অর্থনীতির বহুল পরিচিত লুইস মডেল পাঠ্যপুস্তক ছেড়ে ভারতে নেমে আসবে। যেখানে কৃষিক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত শ্রমিক গিয়ে শিল্পে যোগ দেবে, ফলে সর্বত্র উৎপাদনশীলতা বাড়বে। তা হয়নি। কিন্তু, নেহরুর আমলেই ভারতে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, সেটা ভুললেও চলবে না। মোট কথা, তিনি উন্নয়নকে একটা আধুনিক চেহারায় দেখতে পেরেছিলেন, এবং সেই পথে হাঁটতে সংকল্প করেছিলেন।
কিন্তু, সেটা যে শুধুমাত্র কেন্দ্রই করতে পারে, প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে কাজটি করা সম্ভব নয়, এই বিশ্বাস কোথা থেকে এল? এই প্রশ্নের নিঃসংশয় উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে, কয়েকটা অনুমান সম্ভব। প্রথম কথা হল, ১৯৩৮-এ কংগ্রেসের মধ্যে আধুনিক শিল্পের প্রতি যে বিরূপ মনোভাব ছিল, ১৯৪৭-এ তা হঠাৎ উবে যায়নি। উবে যাওয়া সম্ভবও ছিল না। ফলে, নেহরু জানতেন, শিল্পায়নের পথে উন্নয়নের চেষ্টা করলে তাঁকে বাধার সম্মুখীন হতেই হবে। সেই বাধা অতিক্রম করার একমাত্র অস্ত্র ছিলেন তিনি নিজে। দলে তাঁর প্রভাব ছিল প্রশ্নাতীত। ফলে, তিনি জানতেন, তিনি স্বয়ং যদি একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে শিল্পায়নের যজ্ঞে নেতৃত্ব দেন, তবে হাজার অসন্তোষ সত্ত্বেও তাঁকে বাধা দেওয়ার মতো জোর বিশেষ কারও হবে না। দ্বিতীয় কথা, নেহরুর কাছে এই রকম বড় কর্মকাণ্ডের একটা আলাদা আবেদন ছিল। তিনি রাজনীতির দৈনন্দিন টানাপোড়েনের বাইরে বেরিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একটা বড় পরিকল্পনার শরিক হতে পছন্দ করতেন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে এই ভাল লাগার কথা তিনি বারে বারেই বলেছেন। ফলে, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনীতিকে পরিচালনা করার জন্য যে যোজনা কমিশন তৈরি হল, তা যে তাঁর ব্যক্তিগত আওতায় থাকবে, সেটা প্রায় পূর্বনির্ধারিতই ছিল। উল্লেখ করা প্রয়োজন, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনীতির উন্নয়ন বা যোজনা কমিশন তৈরি করার প্রসঙ্গগুলি সংবিধান রচনার সময় কার্যত আলোচিতই হয়নি। যোজনা কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও নয়। নেহরু যে এই প্রতিষ্ঠানটিতে কার্যত ব্যক্তিগত দখলে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, তার পিছনে এই তথ্যটির গুরুত্ব কম নয়।
তবু, যখন এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কাজ শুরু হচ্ছে, তখন একটা চেষ্টা হয়েছিল একে একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ফেলার। জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি করা হয়েছিল, সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তার সদস্য। প্রতিটি রাজ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রক তৈরি হল। ঠিক হল, প্রতিটি রাজ্য নিজের নিজের পরিকল্পনা জমা দেবে সব মিলিয়ে তৈরি হবে দেশের যোজনা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, যোজনা তৈরি করার মতো দক্ষ আমলা, মন্ত্রী প্রায় কোনও রাজ্যেই নেই। বিস্তারিত অর্থনৈতিক সমীক্ষা করার মতো অর্থবল বা জনবলও নেই। অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন যোজনা কমিশনে বিশেষজ্ঞের ছড়াছড়ি, টাকারও অভাব নেই। এই প্রাথমিক অসাম্যেই কার্যত স্থির হয়ে গেল, যোজনার সমস্ত সিদ্ধান্তই কমিশন করবে, রাজ্যগুলির কাজ হবে তা মেনে চলা। বস্তুত, কোন রাজ্যের জন্য কত টাকা বরাদ্দ হবে, এবং কোন রাজ্যের কত টাকা প্রয়োজন তা স্থির করার অধিকারও চলে গেল যোজনা কমিশনের হাতে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বালাই থাকল না।
আরও একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। নেহরু ভারতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য সোভিয়েত মডেল বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর সেই পছন্দের পিছনে সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত আকর্ষণ যেমন ছিল, তেমনই ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মডেলের একটি বিকল্প খুঁজে নেওয়ার রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাও ছিল। সেই কারণের প্রসঙ্গ থাক। কিন্তু, এক বার সোভিয়েত মডেল বেছে নিলে তার পর আর যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোনও স্থান থাকে না। সেই মডেল চরিত্রগত ভাবেই এককেন্দ্রিক সেই কেন্দ্র থেকেই অর্থনীতির গতিপথ নিদিষ্ট হয়ে যায়। বাকিদের কাজ হল, সেই পথে অবিচলিত থাকা। কাজেই, সোভিয়েত পরিকল্পনার মডেলে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি করা অবান্তর। কাজেই, ভারতে অর্থনৈতিক এককেন্দ্রিকতাও আকস্মিক নয়, ভুঁইফোঁড় নয়। তার একটা যুক্তিপরম্পরা রয়েছে, কার্য-কারণ সম্পর্ক রয়েছে। সেই যুক্তি মানব কি না, সেটা ভেবে দেখার। প্রশ্ন করার, যে যুক্তি থেকে এই এককেন্দ্রিকতার সূচনা হয়েছিল, তা আজকে কতখানি প্রযোজ্য? এখনও কি নেহাত অভ্যাসের বশে এই পুরনো ব্যবস্থাকে বয়ে বেড়াচ্ছে না ভারতীয় গণতন্ত্র? |