ইউ পি এ-২ সরকারের তৃতীয় জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের প্রাক্কালে কোয়ালিশন-এর নেত্রী ও কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী তাঁর দলকে সতর্ক করে বলেছেন, আগামী সাধারণ নির্বাচনের আর মাত্র দু’বছর বাকি। সুতরাং প্রতিশ্রুতি বিতরণের পালা শেষ, এ বার কাজ করে দেখাতে হবে। তবে, রাজনীতির চৌহদ্দির বাইরে সাধারণ মানুষ যা বুঝছে তা হল, দেশের অবস্থা সম্পর্কিত যা কিছু পরিমাপ করা যায়, তা সবই নিম্নমুখী, যথা শিল্প উৎপাদন, টাকার মূল্য, শেয়ার বাজার সূচক, ভোগ্যপণ্যের বাজার, সর্বোপরি, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার। একটা জিনিস কেবল তরতর করে বেড়ে চলেছে দ্রব্যমূল্য। ইউ পি এ-১ আগমনের সময় থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত জিনিসপত্রের পাইকারি দাম বেড়েছে তেষট্টি শতাংশ। মার্চ ২০০৯ থেকে মার্চ ২০১২ এই তিন বছরে ভোগ্যপণ্য সূচক উঠেছে গড়ে বছরে এগারো শতাংশ। সঙ্গে বেড়েছে আর্থিক ঘাটতি, গত পাঁচ বছরে অভাবনীয়, ৩১২ শতাংশ।
সনিয়া গাঁধী বলেছেন, এ বার ‘প্রতিশ্রুতি’ পূরণের সময় এসেছে। কিন্তু মানুষ ভাবছে, ‘ভিক্ষা চাই না, দয়া করে কুকুর সামলান’। অর্থাৎ, প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি না হয় পরে দেখা যাবে, আপাতত মনমোহন সিংহ মন্ত্রিসভার সরকার চালানোর যোগ্যতা নিয়ে যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, তা নিরসন করুন। অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় কিছু দিন ধরেই কৃচ্ছ্রসাধনের কথা শোনাচ্ছেন, যেমন, সরকারি তহবিল থেকে বিদেশ ভ্রমণের খরচ কমাতে হবে। অর্থমন্ত্রী নিজে অবশ্য চিরকালই বিদেশ ভ্রমণে অত্যন্ত মিতব্যয়ী। কিন্তু একা রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলই মিতব্যয়িতার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছেন জুলাই, ২০০৭ সালে তাঁর পদাভিষেকের থেকে এই বছরের শুরু পর্যন্ত বিদেশ ভ্রমণ খাতে ২০৫ কোটি টাকা খরচ করে। মনে হয় না, প্রণববাবুর কৃচ্ছ্রসাধনের বাণী বেশি দূর পৌঁছেছে।
সরকারের কর্মপন্থা মানুষের চোখে সন্দেহজনক হয়ে পড়ার আসল কারণ তার কথা ও কাজের মধ্যে প্রভেদ। গত বছর বাজেটের দৃপ্ত ঘোষণা, আগামী বছর আর্থিক ঘাটতি নেমে আসবে মোট উৎপাদনের ৪.৬ শতাংশে। এক বছর বাদে দেখা গেল তা দাঁড়িয়েছে ৫.৯ শতাংশে। এখানে বলে রাখা ভাল, ব্যাপারটি মোটেই সংখ্যাতাত্ত্বিক কচকচি নয়। আর্থিক ঘাটতির দায়ে সরকার ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেয়, যার পরিণামে সাধারণ মানুষের জন্য সুদের হার বাড়ে, অর্থাৎ কমে যায় নতুন ব্যবসা বা চাকরির সম্ভাবনা। টাকার মূল্য নেমে যাওয়াও সরকারের বিলীয়মান বিশ্বাসযোগ্যতার উদাহরণ। গত অগস্ট থেকে ডলারের তুলনায় টাকার মূল্য নেমেছে ছাব্বিশ শতাংশ, যা এশিয়ার মধ্যে জাতীয় মুদ্রার দ্রুততম অবমূল্যায়ন। প্রাক-কোম্পানি ভারতে অর্থবান মানুষ টাকা রাখত আকবরি মোহরে। কারণ, তা সোনা দিয়ে তৈরি। তাদের কিছুমাত্র বিশ্বাস ছিল না সদাযুদ্ধরত ও প্রায়শই দেউলিয়া আঞ্চলিক কর্তাদের বিতরিত তাম্রমুদ্রায়। একই কারণে আজ যে সক্ষম, সে টাকা গচ্ছিত রাখছে ডলারে বা পাউন্ডে, অথবা সোনার বাটে। মনে হয়, মহাত্মা গাঁধী বেঁচে থাকলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন করতেন নোট থেকে তাঁর ছবিটি সরিয়ে নেওয়ার জন্য।
এ বার রাজনীতির প্রসঙ্গে আসি। দেশের বর্তমান দুর্দশার কথা উঠলেই সরকার দু’টি যুক্তি খাড়া করেন গ্রিস ইউরো অঞ্চল থেকে চম্পটোদ্যত হওয়ার দরুন অস্থিরতা, এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ জোটসঙ্গী, যাঁরা যে কোনও প্রস্তাবে ‘না’ বলতে সদা উদ্যত। অসার যুক্তি। গ্রিসের অস্থিরতার জন্যই ভারতীয় শেয়ার বাজারে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক লগ্নি আসছে না, এটা সত্য নয়। তা ছাড়া, ভারতীয় বহির্বাণিজ্য মার্কিন ডলারে চিহ্নিত, ইউরো দ্বারা নয়। আর বেয়াড়া জোটসঙ্গী প্রসঙ্গে ইউ পি এ-র চুপ থাকাই বাঞ্ছনীয়, কারণ জোট পরিচালনাও গভর্ন্যান্স-এর একটি অঙ্গ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন এক বছর আগে, ইউ পি এ-২ সরকারের বয়স তখন দু’বছর। ওই আগের দু’বছরে কেন্দ্রের ওপর মমতার এই দাপট ছিল না। কারণ তখনও পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হয়নি, তাই রাজ্যে ক্ষমতায় আসার জন্য কংগ্রেসের সমর্থন তাঁর খুবই দরকার ছিল। ফলে ওই সময়টাতে দরকারি সংস্কারগুলি করে নেওয়ার সুযোগ কংগ্রেসের ছিল। এই জানলাটুকুর মধ্যে কেন পাশ হয়নি পেনশন ও বিমা-সংক্রান্ত সংস্কারবাদী আইন? কেন খুচরো ব্যবসায়ে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি আইন বিধিবদ্ধ করা যায়নি? প্রথমোক্ত সংস্কারটি সম্ভব হলে সরকারের ঘাড় থেকে কমত পেনশনের বোঝা এবং বিমায় দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগের অর্থ ব্যবহৃত হতে পারত পরিকাঠামো উন্নয়নে। শেষোক্তটি সম্ভব হলে হয়তো অদক্ষ ফড়েদের বিদায়ঘণ্টা বাজত। ষোলো টাকায় আপনাকে আলু কিনতে হত না এবং আত্মহত্যা করতে হত না আলুচাষিকে।
২০০৯ সালে কংগ্রেস জিতেছিল ২০৬টি আসন, যা ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনও একক দলের পক্ষে সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। ২০০৪ সালে কংগ্রেসের আসন ছিল মোটে ১৪৫। ফলে তখন সরকার বাঁচানোই ছিল আসল কাজ। তবে প্রথম ইউ পি এ সরকারে জোটসঙ্গীদের প্রতি কংগ্রেসের মনোভাব ছিল অনেক স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক। মনমোহন বুশের সঙ্গে অসামরিক পারমাণবিক চুক্তি সই করতে চলেছেন। সি পি এম নেতা প্রকাশ কারাট বললেন, তা কিছুতেই বরদাস্ত করব না। মনমোহন বলে পাঠালেন, ‘সো বি ইট’। চুক্তিও সই হল, বাম সমর্থনও হল প্রত্যাহৃত। এখন কারাটের মতো এখন মমতাও বিদেশ নীতিতে নাক গলাচ্ছেন, যা ঘটেছে তিস্তার জলবন্টন নিয়ে। কই, এ ক্ষেত্রে তো মনমোহন বলতে পারলেন না, ‘সো বি ইট’?
আসলে ইউ পি এ-২ যে ধরনের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ‘আবোল তাবোল’-এর ছন্দে তাকে এই বলে বন্দনা করা যায়, ‘আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া/ নিয়মহারা হিসাবহীন।’ সনিয়া ও তাঁর দলবল আর্থিক সংস্কার সম্পর্কে সন্দেহগ্রস্ত। ফলে ইউ পি এ-১ ও পথই মাড়ায়নি। তবে সনিয়া-মনমোহনের কপাল ভাল, তাঁদের প্রথম জমানায় জর্জ বুশ ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রপতি এবং অ্যালান গ্রিনস্প্যান মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ফেডারাল রিজার্ভ-এর প্রধান। তাঁদের যৌথ বদান্যতায় ডলার তখন হাওয়ায় উড়ছে, সেই সঙ্গে টাকাও। তারই জেরে নয় শতাংশ আয়বৃদ্ধির মুখ দেখল ভারত। তার পর ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে লেমান ব্রাদার্স লগ্নি ব্যাঙ্কের পতনের মধ্য দিয়ে যখন নেমে এল বিশ্বজোড়া মন্দার ছায়া। হু হু করে নেমে এল তেলের দাম। দেশের বাজারে যেমন পড়ল চাহিদা, তেমনই পড়ল মূল্যস্ফীতি। মে ২০০৯ সালে ইউ পি এ-২ যাত্রা শুরু করল। জুন, ২০০৯ সালে এক বার মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক অঙ্কে পৌঁছেছিল। একেই বলে কপাল!
এ বার শুরু হল ‘সৃষ্টিছাড়া’ রাজনীতি। মনে হল, ২০৬ যখন পেয়েছি, তখন এ বার একাই তিনশো’র অঙ্ক শুরু হোক, এবং এখনই। তৎক্ষণাৎ এল ‘সৃষ্টিছাড়া’ অর্থনীতি। কৃষক স্বার্থের নাম করে লাগামছাড়া ঋণমকুব। ২০০৬ সালে ‘অফিস অব প্রফিট’ কাণ্ডে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সনিয়া গাঁধীর নিজস্ব ন্যাশনাল অ্যাভাইসরি কাউন্সিল। ২০১০ সালে আবার ঢাকঢোল পিটিয়ে ফিরে এলেন সেই দরিদ্রবান্ধব এন জি ও বীররা। কোষাগার শূন্য, অথচ শুরু হল শিক্ষার অধিকার এবং খাদ্যের অধিকার সংক্রান্ত এমন সব আইন যা রূপায়িত করা কার্যত অসম্ভব। তত দিনে টু জি, সি ডব্লিউ জি, আদর্শ হাউজিং ইত্যাদি নানাবিধ কেলেঙ্কারিতে সরকারের মুখচ্ছবিটি ঘোর কালিমালিপ্ত। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব তো আর ২০০৯-১৪’র দুনিয়ায় নেই। তাঁরা দু’হাতে বাজে খরচ করতে করতে সরাসরি পৌঁছতে চান ২০১৪ সালের সোনালি সূর্যোদয়ে। এ কথা ভাবার তাঁদের না আছে অনুমতি, না অভিপ্রায় যে সনিয়া তাঁর বাল্যকালে ইউরোপ জুড়ে যে কল্যাণমুখী রাষ্ট্রচেতনার অভ্যুদয় দেখেছিলেন, তার সাফল্যের কারণ বহু দশক ধরে সে সব দেশের সম্পদবৃদ্ধি। আজ ক্রয়ক্ষমতার সাযুজ্য ধরে ভারতের জনপিছু উৎপাদন ৩,৫০০ ডলার, আর ইতালির ৩০,৫০০। গরিব দেশের সরকার নোট ছাপিয়ে টাকা ছড়ালে যা হয়, তা-ই হচ্ছে এ দেশে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি।
সেই জন্য কংগ্রেস আজ নিঃসঙ্গ। দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারের তৃতীয় জন্মবার্ষিকীতে সনিয়া খুব ঘটা করে সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিংহ যাদবকে পাশে বসিয়ে খাওয়ালেন। পর দিনই মুলায়ম বলেছেন, কংগ্রেস আসলে কালো টাকার ছাপাখানা, ‘স্ক্যাম ভেন্ডিং মেশিন’। কংগ্রেসের ‘সৃষ্টিছাড়া’ রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েই রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকারের দোহাই পেড়ে কেন্দ্রকে নাস্তানাবুদ করছেন শুধু জোটসঙ্গী মমতাই নন, জয়ললিতা ও নবীন পট্টনায়কের মতো অ-বিজেপি শক্তিশালী আঞ্চলিক প্রধানেরাও।
ইউ পি এ-১ হল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভাগ্যদেবীর বর। আর ইউ পি এ-২ হল, সুকুমার রায়কে অনুসরণ করেই বলি, ‘খুড়োর কল’। কাঁধে লাগানো ডান্ডা। দেখা যাচ্ছে তার মাথায় ঝুলছে চপ-কাটলেট। ওই তো ২০১৪, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা, রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা! মরুক গে ২০০৯ সালের ‘ম্যানডেট’। ‘মন বলে তায় খাব খাব, মুখ বলে তায় খেতে/ মুখের সঙ্গে খাবার ছোটে পাল্লা দিয়ে মেতে’। |