নিয়ন্ত্রণের বাসনা যে কতখানি উদগ্র হইতে পারে, কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী কপিল সিব্বল তাহার আরও একটি উদাহরণ পেশ করিলেন। নিয়ম বাঁধিয়া দেওয়া হইল, ২০১৩ সাল হইতে গোটা দেশে একটিই জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স পরীক্ষা থাকিবে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িতে হইলে সেই পরীক্ষার মাধ্যমেই ভর্তি হইতে হইবে। কেন এই ব্যবস্থা, তাহা জিজ্ঞাসা করিলে মন্ত্রিমহোদেয় নিশ্চিত ভাবেই কোনও না কোনও যুক্তি দর্শাইতে সক্ষম হইবেন। কিন্তু, তাহার কোনওটিই যথার্থ কারণ হইবে না। মন্ত্রীর এই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাসনার দীর্ঘ ইতিহাস রহিয়াছে। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রকে কার্যত একটি এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা করিবার প্রচেষ্টার ইতিহাস। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। দেশ স্বাধীন হইবার পর সংবিধান রচনার কাজ যখন চলিতেছে, তখন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ঘোর আপত্তি জানাইয়া বলিলেন, শিক্ষাকে কোনও ক্রমেই রাজ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা, অর্থাৎ রাজ্যের এক্তিয়ারে আনা, চলিবে না। শিক্ষা যদি প্রত্যক্ষ কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকে, বা নিদেনপক্ষে যদি কেন্দ্রীয় সরকার পরামর্শদাতার কাজ করে, একমাত্র তবেই সমগ্র দেশে একটি বৌদ্ধিক সমস্বত্ব অবস্থা সম্ভব। আজাদের আপত্তিতেই কারিগরী ও বিজ্ঞাননির্ভর শিক্ষা বা উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের ন্যায় বিষয়গুলি কেন্দ্রীয় তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়। আজাদ কোন সময়ে, কোন প্রেক্ষিতে এই মত পোষণ করিয়াছিলেন, সেই প্রশ্নগুলি বাদ দিলেও একটি কথা স্পষ্ট বোঝা সম্ভব রাজ্যের হাতে নিয়ন্ত্রণ ছাড়িতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ঘোর আপত্তি ছিল। যুগ বদলাইয়াছে, মানসিকতা বদলায় নাই। কপিল সিব্বলরা এখনও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের মাহাত্ম্যের ধ্বজা বহন করিয়া চলিতেছেন। দেশ জুড়িয়া অভিন্ন জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স পরীক্ষার ব্যবস্থা করাও সেই মানসিকতাপ্রসূত।
সমগ্র দেশে একটি জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স চালু করিবার কোনও যৌক্তিকতা নাই তো বটেই, আদৌ কেন রাজ্য স্তরেও জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স-এর ন্যায় পরীক্ষা থাকিবে, তাহাই প্রশ্ন। কোনও এক অলীক যুক্তিতে ধরিয়া লওয়া হয়, জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স না থাকিলে বুঝি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলির পক্ষে ছাত্র ভর্তি করা সম্ভব নহে। কোন ছাত্র কোন মানের, তাহা বুঝিবার নাকি আর মাপকাঠি নাই। তাহাই যদি হইবে, তবে যে ছাত্ররা ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়িয়া সাধারণ শাখায় লেখাপড়া করিতে মনস্থ করেন, তাঁহারা কলেজ নির্বাচন করেন কী উপায়ে, আর কলেজগুলিই বা ছাত্রদের যোগ্যতা কোন মাপকাঠিতে পরিমাপ করে? জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স নাই বলিয়া অতি সাধারণ মানের ছাত্র সেরা কলেজে পড়িবার সুযোগ পাইয়া গেল, আর দারুণ বুদ্ধিমান ছাত্রের কলেজই জুটিল না, এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটে কি? যে কলেজ যেমন মানের ছাত্রের যোগ্য, সেই কলেজ যে তেমন ছাত্রই পাইবে, তাহা বাজারের নিয়মই নিশ্চিত করিয়া দেয়। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যতিক্রম হইবার কোনও কারণ নাই। তবে, জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স ছাড়া যদি রাজনৈতিক কর্তাদের একান্তই মন না উঠে, তবে এই পরীক্ষাটিকে ‘স্যাট’ বা ‘জিআরই’-র তুল্য করিয়া তোলাই বিধেয়। এই পরীক্ষাটির ফল একটি নির্দেশকমাত্র হইবে। কোন কলেজ এই ফলকে কতখানি গুরুত্ব দিবে, তাহা একান্ত ভাবেই সেই কলেজের উপর নির্ভর করিবে। এই ব্যবস্থায় দেশের ভিন্ন প্রান্তের ছাত্রদের যোগ্যতার একটি তুল্যমূল্য বিচারের অবকাশ থাকিবে। কিন্তু, শুধুমাত্র এই ফলের ওপর নির্ভর করিয়া কলেজগুলিকে ছাত্র ভর্তি করিতে বাধ্য করিবার পরিকল্পনাটি অবশ্য-পরিত্যজ্য। এবং, অবিলম্বে। |