ওই যে তাঁরা, ওই যে পথে...
হাজরা
স্বপ্ন সত্যি হবে, আশায় ছিলেন ভবানীপুরের অপর্ণা, রুমি, পৌলমীরা।
বাজিগরকে সামনে থেকে দেখার সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। তাতেই মুষড়ে পড়লেন হাজরা মোড়ে মঙ্গলবার সাতসকাল থেকে ঠায় দাঁড়ানো কয়েক হাজার তরুণ-তরুণী।
বেলা ১১টায় মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল, তাঁরা আসছেন। গর্জে উঠেছিল হাজরা মোড়ের কয়েক হাজার জনতা। কলকাতা নাইট রাইডার্স দল পৌঁছতেই সেই গর্জনে কানে তালা লাগার জোগাড়। সবার চোখ খুঁজছিল এক জনকেই। কিন্তু তিনি নেই।
ভিড় জমছিল সকাল সাতটা থেকেই। আশুতোষ মুখার্জি রোডের দু’ধার তো বটেই, হোর্ডিংয়ের খাঁচা, মেট্রো স্টেশনের ছাদেও উঠে পড়েন যুবকেরা। বেলা গড়িয়েছে, পাল্লা দিয়ে ভিড় বেড়েছে পথে। এক দিকে উদ্বেল জনতা, অন্য দিকে একাধিক সাংসদ-বিধায়ক-মন্ত্রী। সামলাতে কার্যত নাজেহাল পুলিশ।
শাহরুখের দেখা না পেয়ে হতাশ জনতা অবশ্য দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছেন। টিম-বাস থেকে নেমে বিজয়ীরা ট্রেলারে উঠতেই দু’দিক থেকে জনতা ছুটে নেমেছে রাস্তায়। ছয় থেকে ষাট সবাই হাজির!
কারও হাতে কেকেআর-এর পতাকা, কেউ মুখ রাঙিয়েছেন প্রিয় দলের রঙে। ছিল বাঁশি, তাসাপার্টিও। সমর্থকদের দিকে পাল্টা ফুল ছুঁড়ে দিয়েছেন নাইটরাও।
হাজরা মোড় ছেড়ে ট্রেলার যত এগিয়েছে, পাশ দিয়ে ছুটেছেন সমর্থকেরাও। কেউ ‘বিসলাদা, বিসলাদা (মনবিন্দর সিংহ বিসলা)’ বলে চেঁচিয়েছেন, কেউ বা ব্যস্ত খেলোয়াড়দের ছবি মোবাইলবন্দি করতে! শাহরুখকে না দেখতে পেয়ে অনেকে তড়িঘড়ি রওনা হয়ে যান ইডেনের দিকে।

যদুবাবুর বাজার
ফুটপাথের সব্জিবিক্রেতা মহিলা থেকে মাছের আড়তদার বেচাকেনা শেষ করে কেউই ঘরমুখো হওয়ার কথা ভাবছেন না। সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রাস্তার দিকে।
সকাল থেকেই গোটা এলাকা যেন মেতে উঠেছে উৎসবে। নোনা-ধরা দেওয়ালের বাড়িগুলোর জানলায় ‘কিং খান’-এর অপেক্ষায় সারি সারি মুখ। ছাদ-বারান্দাতেও তিলধারণের জায়গা নেই। বহু পুরনো যদুবাবুর বাজার-বাড়ির ছাদেও উদগ্রীব দর্শক থেকে শুরু করে পেশাদার চিত্র-সাংবাদিকের ভিড়।
রাস্তায় উপচে পড়া অল্পবয়সীর দল মাইকে নাগাড়ে বেজে চলা ‘চক দে ইন্ডিয়া’ বা আইপিএল-এর ‘থিম’ সুরের তালে পা মেলাচ্ছে। ঘরকন্নার কাজ ফেলে-আসা মা-মাসিদের ছাতার নীচে কচিকাঁচারা। দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূলের বানানো মঞ্চের উপরেও ভিড়। সরু গলিঘুঁজি পেরিয়ে ‘বাজিগর’কে এক ঝলক দেখতে আসা বাঁধভাঙা জনতাকে সামলাতে হিমশিম পুলিশকর্মীরা। দলীয় কর্মী বা পুলিশের বারবার বারণ সত্ত্বেও কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না কাউকে। ৭১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলকর্মীরা জানিয়েছিলেন, গোলাপবৃষ্টিতে বরণ করা হবে নাইটদের। পৌনে ১২টা নাগাদ নাইটবাহিনী যখন আশুতোষ মুখার্জি রোড ধরে যদুবাবুর বাজারে পৌঁছল, তখন ভিড়ে কার্যত অবরুদ্ধ গোটা এলাকা। বিজয়ীদের ট্যাবলো মঞ্চের কাছাকাছি আসতেই ফুল ছুড়ে সংবর্ধনা দেওয়া হল। ‘বাদশা’কে দেখতে না পেলেও কেকেআর-বাহিনীকে গানের তালে হেলে-দুলে নাচতে দেখে আপ্লুত আট থেকে আশি।
খেলোয়াড়রা এলাকা ছাড়ার পর নজরে এল, ভিড়ের চাপে কখন যেন ভেঙে গিয়েছে মঞ্চটা!

এক্সাইড মোড়
অফিসের ‘বস’ থেকে ‘জুনিয়র’ দুপুরের ঠা ঠা রোদে সবাই একাকার। রাস্তায় নেমে এসেছেন সকলেই। এক্সাইড মোড়ের কাছে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের ডিভাইডারে তখন তিলধারণের জায়গা নেই। ছোট ছোট গাছগুলোর দফারফা। কিন্তু কে তার তোয়াক্কা করে? সবাই যতটা পারেন মুখ বাড়িয়ে রাস্তার দিকে। বহুতলের জানলা থেকেও মাথা বার করে অগুনতি মানুষ। কখন আসেন তিনি?
কিন্তু এলেন না কিং খান। ট্রেলারে গৌতম গম্ভীর-সহ কেকেআরের খেলোয়াড়েরা। একটু দমে গেলেও মোবাইলে ছবি তোলার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু। মূলত অফিসকর্মীদেরই ভিড় ছিল এক্সাইড মোড়ে। এক বিজ্ঞাপন সংস্থার মহিলা-কর্মী বললেন, “এক ঘণ্টার জন্য অফিস পুরো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। সবাই রাস্তায় নেমে এসেছেন শাহরুখ আর গম্ভীরকে দেখতে।” বহুক্ষণ ধরে রোদ্দুরে ঠায় রাস্তার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েক জন মহিলা। শাহরুখকে ভাল করে দেখবেন বলে হাওড়ার মন্দিরতলা থেকে সকাল ১০টাতেই চলে এসেছিলেন তাঁরা।
এক্সাইড মোড়ের কাছে ট্রেলারের দেখা মিলল বেলা ১২টা নাগাদ। দূর থেকে দেখেই গর্জে উঠল অপেক্ষমাণ জনতা। চারপাশে তখন মোবাইল ক্যামেরার ‘ক্লিক ক্লিক’ শব্দ। ট্রেলারের পিছনে টিম বাস। বাসের জানলা কালো কাচে ঢাকা। ভিতরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হতাশ জনতা তবু সেদিকেই হাত নাড়তে লাগলেন। বাস চলে গেল মহাকরণের দিকে।

মহাকরণ
বারান্দা, কার্নিশ, ছাদ কোথাও একচিলতে জায়গা নেই। শুধু থিকথিকে মাথা। মরিয়া কয়েক জন ছাদের কোণে বসানো কংক্রিটের সিংহের পিঠে চড়ে বসেছেন। ছবিটা সকালের মহাকরণের। মূল প্রবেশদ্বারের পাশে অনুষ্ঠান মঞ্চ। সেখানে ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা। মঞ্চে বাজছে রবীন্দ্রসঙ্গীত।
বেলা ১১টা ১০। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢুকলেন মহাকরণে। পরনে ‘কলকাতা নাইট রাইডার্স’-এর জার্সির সঙ্গে মিলিয়ে হালকা বেগুনি আঁচলের শাড়ি। শাড়ির সরু পাড় বরাবর টানা তিনটি বেগুনি স্ট্রাইপ।
দুপুর সাড়ে বারোটা। রাস্তার দু’ধার ঠাসা ভিড়ে হঠাৎ ‘আসছে’, ‘আসছে’ চিৎকার। হালকা ছাই আর সাদা রঙের দুটো ‘সিটি ক্রুজ’ বাস এসে থামল মহাকরণের সামনে। সোনালি রঙের কাপ হাতে প্রথমে নামলেন গৌতম গম্ভীর। তার পরে অন্য খেলোয়াড়েরা। স্বাগত জানাতে ততক্ষণে নেমে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মুকুল রায়, টলিউড তারকা জিৎ, দেব-রা। মঞ্চে প্রত্যেকের গলায় কাঁথাকাজের উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন মমতা। জনতার চোখ তখনও খুঁজছে এক জনকেই। কোথায় তিনি?
দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট। সাদা রঙের গাড়ি থেকে নামলেন কিং খান। সঙ্গে জুহি চাওলা ও জয় মেটা। জনতা তখন প্রায় ফেটে পড়ছে বাঁধভাঙা উচ্ছাসে।
তুমুল চিৎকারের মধ্যে শাহরুখ-জুহিকে পাশে নিয়েই মমতা বললেন, “বাংলা গর্বিত। এঁরা বিশ্বজয় করে এসেছেন। আমাদের তরফ থেকে অনেক অভিনন্দন।” পাল্টা অভিনন্দন জানিয়ে শাহরুখ বললেন, “দিদি, কলকাতা এবং গোটা পশ্চিমবঙ্গকে ধন্যবাদ।” ততক্ষণে পুলিশকে টপকে মঞ্চের সামনে হাজির উৎসাহী জনতা। অগত্যা, ভিড় ঠেলেই বাসের দিকে এগোলেন মুখ্যমন্ত্রী ও শাহরুখ। পৌনে একটা নাগাদ জনসমুদ্র কেটে তাঁদের নিয়ে বাস এগোল ইডেনের দিকে।

ইডেন
যে আশা মেটেনি হাজরা, ভবানীপুর বা ভিক্টোরিয়ার সামনে, তা মেটাতেই কাতারে কাতারে মানুষ ছুটে গেলেন ইডেন গার্ডেন্সের সামনে।
দুপুর সওয়া দু’টো। শাহরুখ খান ইডেন গার্ডেন্সে ঢুকে পড়েছেন শুনে ক্লাব হাউসের সামনের রাস্তায় কয়েক হাজার মানুষ ব্যারিকেড ভেঙে দৌড়তে শুরু করলেন এক নম্বর গেটের দিকে। বঙ্গবাসী ময়দানের সামনে বাঁশের ওয়াচ টাওয়ারের মাথায় দাঁড়িয়েছিলেন জনা সত্তর যুবক। শাহরুখকে চোখের দেখা দেখতে তাঁরাও দৌড়লেন দু’নম্বর গেটের দিকে। পরিস্থিতি দেখে লালবাজারের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক অফিসার ছুটতে শুরু করলেন এই বলে, “আর কিচ্ছু করার নেই। গেট খুলে দাও। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ। না হলে লোকে চাপা পড়ে মরবে।”
গেট খুলে দেওয়ার অপেক্ষা করেননি কেউ। এক লহমায় দু’নম্বর গেট ভেঙে আছড়ে পড়ল জনতার ঢল। ছিটকে গেল রাস্তায় লাগানো গার্ড রেল। লুটিয়ে পড়ল গাছের টব, ফালাফালা ‘কেকেআর’-এর ব্যানার।
পুলিশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শাহরুখকে দেখতে সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উদ্দাম জনতা ছুটল ‘আপার টায়ারে’। ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়লেন কিছু পুলিশকর্মী। সাংবাদিকরাও ছিটকে গেলেন নিমেষে।
বিকেল সওয়া চারটে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষ। রাজ্যের মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব দু’নম্বর গেট দিয়ে বেরোলেও গাড়িতে উঠতে পারলেন না। ক্লাব হাউস, এক ও দু’নম্বর গেটের বাইরে কাতারে কাতারে মানুষ দাঁড়িয়ে কিং খানকে বিদায় জানাতে। সঙ্গে কান ফাটানো চিৎকার। ফের ব্যারিকেড ভেঙে রাস্তায় নামতে চান সকলে। কিং খান হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে যাওয়ার পরেও নড়ল না ভিড়।
পাক্কা বাইশ মিনিট অপেক্ষা করে শেষপর্যন্ত ভিড় ঠেলেই নিজেদের লালবাতি লাগানো গাড়িতে উঠতে হল রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ দুই পদাধিকারীকে।

তথ্য সংগ্রহ: কুন্তক চট্টোপাধ্যায়, অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়, আর্যভট্ট খান, পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
ও শমীক ঘোষ। ছবি: অশোক মজুমদার, রাজীব বসু, সুমন বল্লভ, বিশ্বনাথ বণিক ও উৎপল সরকার।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.