সরকার যায়। সরকার আসে।
দুর্গাপুরের বাতাস ছেয়ে থাকে ভারী বিষকণায়।
জলসঙ্কট ছাড়া আর যে সমস্যা শহরের মানুষকে ধীরে-ধীরে শেষ করছে, তা দূষণ। অথচ পুরভোটের চার দিন আগেও কোনও দল সে ভাবে দূষণের বিরুদ্ধে ‘সোচ্চার’ নয়।
২০০১ সাল থেকে দুর্গাপুরে যখন একের পর এক বেসরকারি কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছিল, তখন উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের কথা শহরবাসী যত ভেবেছিলেন, দূষণ নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামাননি। সে সময়ে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে তৃণমূল প্রার্থী অপূর্ব মুখোপাধ্যায় কয়েক বার এই নিয়ে সরব হন। কিন্তু শ্রোতারা তত ‘আগ্রহ’ না দেখানোয় তিনিও আর বেশি উচ্চবাচ্য করেননি।
অপূর্ববাবুর দল এখন রাজ্যে ক্ষমতায়। আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদও (এডিডিএ) তাঁদেরই হাতে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। গত এক দশকে একের পর এক গড়ে ওঠা যে স্পঞ্জ আয়রন কারখানাগুলি অধিক মুনাফার লোভে দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ব্যবহার করে না বলে অভিযোগ, সেগুলি বহাল তবিয়তেই চলছে। বিধানসভা ভোটের প্রচারে তৃণমূল ও কংগ্রেস নেতারা বারবার বলেছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে ওই কারখানার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু নতুন সরকারের বছর ঘুরে গেলেও তেমন কিছু ‘ব্যবস্থা’ হয়নি। এক বার রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী কয়েকটি বেসরকারি কারখানায় হঠাৎ হানা দিয়েছিলেন। এর বেশি প্রায় কিছুই হয়নি। |
ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন, এখনও রাত বাড়লেই ঘরের জানলা বন্ধ করে দিতে হয়। শ্বাসকষ্টে ভুগছেন অনেকেই। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কেরা। গাছের পাতার উপরে কালো আস্তরণ। গত বছর বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারের সময়েই ভোটারেরা অপূর্ববাবুকে চেপে ধরেছিলেন, “দাদা, কিছু একটা করুন। আর পারছি না!” অপূর্ববাবু আশ্বাস দিয়েছিলেন, “আমরা ক্ষমতায় এলে শিল্পের প্রকৃতি ও পরিবেশ বিবেচনা করে শিল্পায়ন হবে।” তিনি জিতেছেন। বছর ঘুরে গিয়েছে। কিন্তু সগড়ভাঙার আশিস কুম্ভকার থেকে তেঁতুলতলা কলোনির নির্মল মণ্ডলেরা একই অভিযোগ করে চলেছেন। তাঁদের কথায়, “বিধানসভা ভোটের আগে যা বলেছিলাম, এখনও তাই বলছি। ক্ষমতাসীন দলের কাছে ফের আবেদন রাখছি, দ্রুত কিছু করা হোক।”
আসন্ন পুরভোটে অপূর্ববাবু শহরের অন্যতম ‘অভিজাত’ এলাকা সিটি সেন্টার (২২ নম্বর ওয়ার্ড) দাঁড়িয়েছেন। সেখানেও দূষণ আছে। তবে ঝাঁ চকচকে শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, হোটেল, অট্টালিকার আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে দূষণের অভিযোগ। অতএব প্রচারে বেরিয়ে তিনি যত নাগরিক পরিষেবা নিশ্চিত করার কথা তুলছেন, দূষণ নিয়ে প্রায় কিছুই বলছেন না। অন্য ওয়ার্ডে জনসভা করতে গিয়েও নয়। রেলমন্ত্রী মুকুল রায় বা রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র এসেও সে প্রসঙ্গে যাননি। কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী-দীপা দাশমুন্সি বা সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্রেরাও কথা তোলেননি।
একমাত্র শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সোমবার সিটি সেন্টারে এক সভায় বলেন, “বাম আমলে দলীয় স্বার্থে একের পর এক দূষণ সৃষ্টিকারী কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। আমরা তা চাই না। আমরা পরিবেশ বান্ধব শিল্পের পক্ষে।” কিন্তু পার্থবাবুও দূষণ সৃষ্টিকারী কারখানাগুলির উদ্দেশ্যে কোনও হুঁশিয়ারি দেননি। সিটি সেন্টারের প্রবীণ বাসিন্দা বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিৎ বসুদের খেদ, “আগের মতোই দূষণ হচ্ছে। অথচ বিষয়টি নিয়ে নতুন সরকারও তেমন ভাবনা-চিন্তা করছে বলে মনে হচ্ছে না।” প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক তথা এ বারের পুরভোটের প্রার্থী বিপ্রেন্দু চক্রবর্তীর দাবি, “আমরা বামপন্থীরা লাগাতার আন্দোলন করে এই সমস্যাকে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষেত্রে আংশিক সাফল্য পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা সজাগ।” তাঁর আবার অভিযোগ, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসর পরে শাসকদল বা জোটের পক্ষ থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণের দাবিতে কোনও আন্দোলন নজরে আসেনি।
রাজনৈতিক এই তরজায় অবশ্য বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই শহরবাসীর। তাঁরা দেখছেন, ভাবছেন, ভোটও দেবেন। |