রবিবাসরীয় গল্প
রাক্ষস
বার শেষে ও? এখানেও? ওকে আসতেই বা বলেছিল কে, আর এই রেসে নামতেই বা বলেছিল কে? সবেতেই তো লাস্ট! আমার মানসম্মানটার কথা কি কোনও দিনও ভাববে না? কেরামতি করে কে বলেছিল এ সব করতে? কী প্রমাণ করতে চায় ও? ইমপ্রেস করতে চায় তোকে? বোঝাতে চায় কত বড় বীরপুরুষ?’ দাদু কথাটা বলে হাতের লাঠিটাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল বড় সোফাটায়।
আমি মাথা নিচু করে নিলাম কিছুক্ষণের জন্য, তার পর তাকালাম মাঠের দিকে। সবার শেষে থাকা সাইকেলটা নড়বড় করতে করতে এগোচ্ছে ফিনিশিং লাইনের দিকে...

তিন দিন আগে


‘দিনগুলো, কেমন চাকার মতো,
অযথা আমাকে
পিষে যায়...।’

‘ওই কর, সারাদিন মুখে কবিতার বই গুঁজে বসে থাক।’
দাদুর অসন্তোষের কারণটা আমি ঠিক বুঝতে না পেরে বইটা গুটিয়ে সোজা হয়ে বসলাম, ‘কী হল?’
‘কী হল মানে?’ দাদু বিশাল বড় সোফাটায় এমন করে বসল যেন গরম কালে সুইমিং পুলে ঝাঁপ দিচ্ছে, ‘তোর বাবার কাণ্ডটা দেখেছিস? কত সাহস দেখেছিস?’
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। কারণ, যা দেখাশোনার, সেটা যে আপাতত দাদুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে বুঝতে পারছি।
‘কী হয়েছে বলবে?’
‘করে তো সামান্য একটা সাইট ইন্সপেক্টরের চাকরি। কত পায় ও? কুড়ি-পঁচিশ হাজার? আমার বাড়ির তিন জন ড্রাইভার মিলিয়ে ওর চেয়ে বেশি টাকা আমি মাইনে দিই। আর সে কিনা আমার নামে কুড়ি হাজার টাকার ড্রাফট পাঠায়! সাহসটা দেখেছিস?’ দাদুর ফর্সা স্ট্রবেরির মতো হয়ে উঠেছে।
আমি মাথা নামিয়ে নিলাম। কী বলব আমি? বাবা কিছু করলে আমাকেই তো এই সব কথা শুনতে হয়। বাবার প্রতি দাদুর সমস্ত রাগ আমার ওপরই এসে পড়ে শেষমেশ। কিন্তু আমি এ সবের কিছুই জানি না। বাবা টাকা পাঠিয়েছে তো আমি কী করব? আমি তো আর টাকা পাঠাতে বলিনি।
আমি দাদুর বাড়িতে থাকি কলকাতায়। বালিগঞ্জের এই বাড়িটা বিশাল বড়। বড় রাস্তা থেকে গেট পেরিয়ে ভেতরে আসতে হয় লাল মোরামের পথ দিয়ে। এক দিকে বাগান আর অন্য দিকে লনের মধ্যে সিঁথি কাটা বাঁকানো রাস্তাটার শেষে আমাদের তিন তলা বাড়ি। আমার বন্ধুরা বলে বাড়ি কোথায়? এটা তো কেল্লা!


আমার মা এমন একটা বাড়ির মেয়ে হয়ে কী করে যে প্রেমে পড়েছিল বাবার কে জানে! এম এ পড়তে গিয়ে আলাপ হয়েছিল দু’জনের। মামার বাড়িতে মানুষ, আমার রোগা, শ্যামলা আর মুখচোরা বাবা কী করে এত সাহস পেয়েছিল? আসলে বাবার নয়, সাহস ছিল মায়ের। সবাইকে একদম উড়িয়ে দিয়ে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। দাদু তো বলেছিল কোনও দিন মুখ দেখবে না মায়ের।
মা আর বাবা চলে এসেছিল নর্থ বেঙ্গলে। সেখানে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিল বাবা। সাইট ঘুরে ঘুরে কাজের তদারক করাই বাবার চাকরি।
বাবা আর মা ভালই ছিল ওখানে। অত বড় বাড়ির মেয়ে হলেও টানাটানির সংসারে মা মানিয়ে নিয়েছিল সহজেই। এর বছর দুয়েকের পর আমি আসি পৃথিবীতে। ঘনঘোর আষাঢ়ের এক মধ্য রাতে আমি এসেছিলাম মায়ের কাছে। মায়ের বুকের কাছে ছোট্ট ন্যাকড়ার পুঁটলির মতো করে শুয়েছিলাম অঝোর বৃষ্টির সেই রাতটায়। নতুন কেনা সস্তা ক্যামেরায় বাবা তুলে রেখেছিল সেই ছবি।
আমার এখন ষোলো বছর বয়স। তিন বছর বয়সে আমার মা মারা গিয়েছে। গত তেরোটা বছর আমার সম্বল বলতে মায়ের সঙ্গে তোলা অমন কয়েকটা ছবি।
মাঝরাতে ঘুম না এলে আমি অ্যালবামের ওই ছবিগুলো দেখি। দেখি, ক্লান্ত মা ছোট্ট, সাদা পুঁটলিটা জড়িয়ে হাসছে। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আমি মায়ের গন্ধ পাই। মনে হয় নরম হাত যেন জড়িয়ে রেখেছে আমায়।
তিন বছরের স্মৃতি বিশেষ কারও থাকে না। আমারও নেই। শুধু এর ওর মুখে শুনে শুনে মনে একটা আবছা ধারণা তৈরি হয়েছে আমার। যেন আমি দেখতে পাই অগস্টের এক সকালে মালা-চন্দন দিয়ে সাজানো মায়ের মুখটা। আবছায়া মানুষ কিছু ঘিরে রেখেছে মায়ের দেহ। সে-দিন মেঘ ছিল নাকি রোদ? এক এক বার এক এক রকম মনে হয়। শুধু স্পষ্ট হয় না কিছু। যেন ঘষা কাচের ওপারের স্মৃতি। যেন মনে পড়ি পড়ি করেও মনে না পড়া উত্তর। যেন বুকের কাছে আটকে থাকা সব কষ্ট।
মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে দাদু গিয়েছিল ওখানে। বাবাকে নাকি সবার সামনে চড়ও মেরেছিল। মাসি আর মামারা থাকায় ব্যাপারটা বেশি দূর গড়ায়নি। বাবা কিন্তু কিছু বলেনি। মাথা নিচু করেই ছিল। বড় হওয়ার পরে মাসি সব বলেছিল আমায়। বলেছিল, ‘দিদি যে অমন আচমকা হার্ট ফেল করবে কে জানত? বাবা খুব অবুঝ। সমুদার মতো এমন মাটির মানুষ আমি দেখিনি।’
সে কথা শুনে দাদু বলেছিল, ‘মাটিই বটে। গলে যাওয়া অপদার্থ, মাটি। এমন কাদামাটি আমিও জীবনে দেখিনি। মেয়েটাকে খেল।’
আমার পড়াশুনোর জন্য মায়ের মৃত্যুর পরই দাদু আমায় নিয়ে এসেছিল কলকাতায়। বাবা নাকি তেমন আটকায়নি।
আমি তো বাড়তি, অতিরিক্ত। তাই হয়তো আটকায়নি। স্কুলে ছোটবেলা থেকে নানা অনুষ্ঠানে সবার বাবা-মায়েরা আসত। আর আমি যেতাম মাসির সঙ্গে। এই স্কুলের সেক্রেটারি আমার দাদু। তাই সবাই খুব খাতির করত আমায়। সামনের সারিতে নরম সোফায় বসতাম। স্পেশাল খাবারের প্যাকেট পেতাম। বন্ধুদের হিংসের চোখটা দেখতে পেতাম স্পষ্ট। কিন্তু ওরা আমার হিংসের চোখটা দেখতেই পেত না!
‘কী রে বল কিছু।’ দাদু আমার দিকে তাকাল।
‘আমি কী বলব? আমি তো কিছুই জানি না।’
‘তা জানবি কেন? ওই বাপেরই তো ছেলে। দেখ বুজাই, তোর বাপকে বল এ সব যেন না করে। তোর স্কুলের জন্য টাকা লাগবে সেটা কি আমি দিতে পারব না? এত দিন কোন নবাবপুত্তুর দিয়েছে যে আজ এমন করার সাহস পায় সমু? তোর মা যে কী দেখেছিল ওর ভেতরে!’
আমি কিছু বলার আগেই মাসি ঢুকল। মাসি খুব বড় চাকরি করে। বিয়ে হয়েছিল এক জনের সঙ্গে, কিন্তু ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর এখানেই থাকে। পৃথিবীতে মাসিই একমাত্র যে দাদুর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।
মাসি কড়া গলায় বলল, ‘তোমার না হার্ট প্রবলেম, এমন চেঁচাচ্ছ কেন তুমি? নীচের থেকে আমি শুনতে পাচ্ছি। কী হয়েছে কী? সমুদা টাকা পাঠিয়েছে তো কী হয়েছে? বুজাই তো ওর ছেলে। বাবা হিসেবে তারও তো একটা ইচ্ছে হয়। এ বার বুজাই বোর্ড এগজাম-এ স্কুলের ভেতর টপ করেছে। সেটা বলতেই ফোন করেছিলাম। তখন কথায় কথায় বলেছিলাম যে ইলেভেনে ভর্তি হতে টাকা লাগবে। তাই পাঠিয়েছে।’
‘বাপ মানে কি শুধু টাকা?’ দাদু গর্জন করল, ‘গত চার বছরে এসেছে এক বার? সন্ধেবেলা গাড়িতে উঠলে সকালে এখানে পৌঁছে যাবে। তাও আসে? টাকা পাঠালে শুধু হয়? বাপের টিকির দেখা নেই। বাপ হয়েছে!’
বাবার টিকি থাকে কি না আমি আর জিজ্ঞেস করলাম না।
মাসি বলল, ‘তুমি এ বার শান্ত হও। সামনে স্কুলে স্পোর্টস। তার পর ফাংশান। সেখানে বুজাই প্রাইজ পাবে। কত আনন্দ বলো তো! শুধুমুদু রাগ করে শরীর খারাপ কোরো না।’ তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বুজাই, তুই সমুদাকে একটা ফোন করে বলিস, যাতে আসে এ বার। কত দিন আসেনি! স্পোর্টসে না আসুক, তুই প্রাইজ পাবি সেটা দেখতে তো আসতে পারে। আজ রাতেই ফোন করিস কেমন?’
দাদু বলল, ‘হুঁঃ, সে এসেছে আর কী।’

ফোনে বাবার গলাটা টিন এজারের মতো লাগে চিরকাল। আমি বেশ কয়েক মাস হল কথা বলিনি বাবার সঙ্গে। আজ কথা বলতে গিয়ে কেমন যেন লাগল। আসলে বাবাকে কোনও দিন কিছু বলিনি আমি। কোনও দিন কিছু চাইনি বাবার কাছে।
প্রথম প্রথম বাবা তাও আসত আমায় দেখবে বলে। তখন কেমন যেন লাগত আমার। মনে হত এই লোকটা আমার বাবা? এই বিশাল বড় বাড়িটার ভেতরে বাবাকে বেমানান লাগত। সব চকচকে সেলোফেনে মোড়া মানুষের ভেতরে কেমন যেন পুরনো দিনের দেশলাই বাক্সের মতো বাবা। খুব লজ্জা লাগত আমার।
তার পর আমার বারো বছরের জন্মদিনে এসে বাবা বলেছিল, আমায় নিয়ে যাবে নর্থ বেঙ্গলে। নিজের কাছে রাখবে আমায়।
সেই শুনে দাদু কী যে রেগে গিয়েছিল! প্রায় মারতে গিয়েছিল বাবাকে। বলেছিল, ‘আমার মেয়েকে খেয়েছ, এ বার নাতিটাকেও খাবে? রাক্ষস তুমি? বেরোও আমার বাড়ি থেকে। দূর হয়ে যাও।’
দোতলায় আমার শোওয়ার ঘরের জানলা দিয়ে দেখেছিলাম সন্ধের আবছায়ার ভেতর চলে যাচ্ছে আমার বাবা। রোগা, শ্যামলা একটা মানুষ চলে যাচ্ছে মাথা নিচু করে। লাল মোরামের ওপর ছোট্ট পুতুলের মতো মানুষটা মিলিয়ে যাচ্ছে, মিলিয়ে গেল।
দাদু বলেছিল, ‘বাঁচা গেল, রাক্ষসটা গেছে।’
তার পর চার বছর পার হল। রাক্ষস আসেনি আর। মোরামের রাস্তা আর দেখেনি সেই অপমানিত মানুষটাকে।

আমার গলার স্বর শুনে বাবা আজ থমকাল একটু। নিজেকে কি গুছিয়ে নিল? আমি যেন দেখতে পেলাম থতমত আর কী বলবে বুঝতে না পারা একটা মুখ।
‘বাবা, আমি বুজাই বলছি।’
‘হ্যাঁ’, বাবা সময় নিল, ‘বলো, কেমন আছো?’
‘ভাল’, আমিও সময় নিচ্ছি। রক্তের চেয়ে দূরত্ব কি বেশি বলবান? বললাম, ‘তোমার ড্রাফট এসেছে। তবে দাদু রাগ করছিল।’
‘তাই? ও।’ বাবা চুপ করে গেল।
আমি আবার বললাম, ‘একটা কথা... মানে...’
‘বলো না।’ বাবার গলায় কি আগ্রহ দেখলাম?
‘আমি এ বার প্রাইজ পাব স্কুল থেকে। তিন দিন পর স্পোর্টস আর তার পরের দিন প্রাইজ গিভিং। তাই...’ আমার জিভে যেন গিঁট লেগে গেল হঠাৎ। আমি কী করে চাইব লোকটার কাছে? কোনও দিন যে কিছু চাইনি।
বাবাও যেন আটকে গেছে, বলল, ‘ও খুব ভাল... তোমার মাসি বলছিল। কিন্তু আমি... মানে... ইয়ে...’
আমি মন শক্ত করে গিঁটটা খোলার চেষ্টা করলাম। সংকোচ ঝেড়ে বললাম, ‘সবার পেরেন্টসরা থাকবে। আমার তরফ থেকে তো কেউ থাকে না। আমার বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে। ওদের বাবা-মায়েরা তো আসে। পার্টিসিপেট করে। আই ফিল লেফট আউট বাবা। তাই বলছিলাম...’
‘ও... আচ্ছা... মানে... এখানে ছুটি পাওয়া এমন সময়ে... আসলে...’ বাবা কী বলবে বুঝতে পারল না।
আমার ঠিক কষ্ট হল বলা ভুল, তবে কেমন যেন তেতো হয়ে গেল মুখটা। আসলে নিজেকে অতিক্রম করে চেয়েছিলাম তো কিছু, কিন্তু বাবা এটুকুও দিল না দেখে আমার কথা বলার ইচ্ছেটা চলে গেল।
বললাম, ‘ঠিক আছে। নো প্রবলেম। আমি রাখি তবে।’
‘রাখবে?’ বাবার গলায় কেমন যেন একটা দ্বিধা।
আমি আর সময় দিলাম না, ‘ওকে, গুড নাইট।’
ফোনটা কেটে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বাবা কি এখনও ওই পারে রিসিভার হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে?
‘আসবে না তো?’ দাদু পেছন থেকে বলে উঠল।
আমি চট করে ঘুরলাম। ঘরের দরজা খোলা। দাদু কি তবে দাঁড়িয়েছিল আমাদের কথা শোনার জন্য?
আমি কিছু না বলে মাথা নাড়লাম।
দাদু বলল, ‘জানতাম। অপদার্থ একটা। ছেলের জন্য এটুকুও পারে না?’

গাড়িটা মাঠের সামনে দাঁড়াতেই আমরা লাফ দিয়ে নামলাম গাড়ির থেকে। এক ঘণ্টা লাঞ্চ ব্রেক ছিল তাই বন্ধুদের নিয়ে আমি খেতে গেছিলাম বাড়িতে। আসলে ইচ্ছে ছিল না যাওয়ার, কিন্তু দাদু এমন বকল যে যেতেই হল। তবে আমরা চলে এসেছি এক ঘণ্টার আগেই। কিন্তু দাদু আসেনি, মাসির সঙ্গে পরে আসবে।
আমাদের স্কুলের স্পোর্টসটা দারুণ হয়। বিশাল মাঠ জুড়ে চক খড়ি দিয়ে ট্র্যাক কাটা হয়। আর এক দিকে বড় শামিয়ানা টাঙিয়ে তৈরি করা হয় গ্যালারি আর ভিআইপি বক্স।
আমার এমনি গ্যালারিতে বন্ধুদের সঙ্গেই বসতে ইচ্ছে করে, কিন্তু দাদুর জন্য পারি না। আমায় দাদুর পাশে ওই ভিআইপি বক্সেই বসতে হয়।
গাড়ি থেকে নেমে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি মাঠের ভেতর ঢুকতে যাব, এমন সময় স্কুলের অফিস স্টাফ করিমদা এসে পথ আটকাল আমার। বলল, ‘সৌরীপ্ত, এক জন খুঁজছেন তোমায়।’
‘আমায়? কে?’
‘জানি না। তবে তোমার নাম বললেন। স্যরের নামও বললেন। কোনও দিন দেখিনি।’
‘কোথায় তিনি?’ আমি এ দিক ও দিক তাকালাম।
‘এসো।’
করিমদার পিছনে পিছনে মাঠের এক দিকে গেলাম আমি।
‘আরে! এখানেই তো ছিলেন,’ করিমদা অবাক হল, ‘কোথায় গেলেন?’
পাশের থেকে আর এক জন স্টাফ বলল, ‘ওই দিকে গেছেন ভদ্রলোক। রেসের নাম নেওয়া হচ্ছে। ওই লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন।’
আমি এ বার করিমদার আগে ছুটলাম দূরের লাইনের দিকে।
লাইন একটা নয়। বেশ কয়েকটা। এখানে কে খুঁজছে আমায়?
‘বুজাই।’
আচমকা ডাকে আমি থতমত খেয়ে গেলাম একদম। কোথা থেকে এল এই ডাক? কত বছরের ওপার থেকে এল? কী নিয়ে এল সঙ্গে করে? কাকে নিয়ে এল?
আরও শ্যামলা হয়েছে কি? শরীরটা ভেঙেছে কি আরও? আরও কি চুপ করে গেছে? মাথার দু’পাশের চুলে বরফ জমেছে কিছু বেশি?
আমি দেখলাম দুপুরের হলুদ রোদের তলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে বাবা। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা মানুষটাকে আজও ঠিক আগছালো আর পুরনো দেশলাই বাক্সের মতোই মনে হচ্ছে।
‘তুমি? হঠাৎ!’
বাবা আমতা আমতা করে বলল, ‘চলে এলাম। ছুটি দিচ্ছিল না, তবু চলে এলাম। ট্রেনে রিজারভেশন পাইনি। জেনারেল কামরায় দাঁড়িয়ে এসেছি। তুমি বললে সে দিন... প্রাইজ পাবে... কোনও দিন তো কিছু পারলাম না, তাই... আর এসে দেখলাম পেরেন্টসদের রেসের নাম নেওয়া হচ্ছে। ভাবলাম যদি কিছু করতে পারি... তাই সাইকেল রেসে নামটা...’
‘সারারাত না ঘুমিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্রাভেল করে এখন নাম দিচ্ছ রেসে? কেন? আর সাইকেল চালাতে পারো তুমি?’ আমার অবাক লাগছে। বাবা এসেছে? সত্যি এসেছে? কোনও খবর না দিয়ে এ ভাবে এসেছে!
‘সাইটে সাইটে তো সাইকেল নিয়েই ঘুরতে হয়। মানে জীবনটা তো সাইকেলেই কাটল প্রায়। তাই...’ বাবা যেন গুটিয়ে গেল লজ্জায়, ‘ঠিক আছে, তুমি গিয়ে বসো। ওরা বলল নম্বর লাগাবে জামায়। আমায় যেতে বলল। শুধু...’
‘কী?’
‘আমার এই ব্যাগটা, মানে... কোথায় রাখব...’
আমি হাত বাড়িয়ে বাবার ব্যাগটা নিয়ে কাঁধে ঝোলালাম। বললাম, ‘আমার কাছে থাক। আমি বক্সে আছি। দরকার হলে বোলো।’
গ্যালারির সামনে বন্ধুরা আমায় ধরল, ‘কে রে লোকটা? অমন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট পিকচার আমদানি করলি কোথা থেকে?’
আমি তাকালাম ওদের দিকে। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট পিকচার! কোথায় যেন লাগল আমার।
আমি কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম। শুনলাম পিছনে বন্ধুরা বলছে, ‘সৌরীপ্ত জোগাড়ও করে সব। নাইনটিন ফিফটির মডেল। ভিন্টেজ কার র্যালিতে নামিয়ে দিলেই হয়।’

‘রাক্ষসটা এসেছে?’ দাদুর গলাটা এই হট্টগোলের ভেতরেও আমার কানে এসে বিঁধে গেল, ‘হঠাৎ এল কেন ও? আর এসেই একদম সোজা মাঠে?’
আমি দাদুকে মাঠের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালাম।
দাদু এ বার হইহই করে উঠল মাঠের দিকে তাকিয়ে, ‘সবার শেষে ও? এখানেও? ওকে আসতেই বা বলেছিল কে, আর এই রেসে নামতেই বা বলেছিল কে? সবেতেই তো লাস্ট! আমার মান-সম্মানটার কথা কি কোনও দিনও ভাববে না? কেরামতি করে কে বলেছিল এ সব করতে? কী প্রমাণ করতে চায় ও? ইমপ্রেস করতে চায় তোকে? বোঝাতে চায় কত বড় বীরপুরুষ?’ দাদু কথাটা বলে হাতের লাঠিটাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল বড় সোফাটায়।
আমি মাথা নিচু করে নিলাম কিছুক্ষণের জন্য, তার পর তাকালাম মাঠের দিকে। সবার শেষে থাকা সাইকেলটা নড়বড় করতে করতে এগোচ্ছে ফিনিশিং লাইনের দিকে। বাবা সাইকেলের হাতল ধরে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সাদা শার্টটা ভিজে লেগে আছে শরীরের সঙ্গে। লোক জন চিৎকার করছে। বাবার সামনে শুধু এক জন।
দাদু আবার বলল, ‘এ সব কী? এ ভাবে কেউ চালায়? একটাকেও টপকাতে পারছে না? সবার শেষে? আমি আগে এলে ওকে নামতেই দিতাম না। আমার জামাই হয়ে...’
সামনের লোকটা ফিনিশিং লাইনের কাছে চলে এসেছে। বাবা অনেকটা পিছনে। সামনের লোকটা চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। চাকা গড়াচ্ছে আর ফিনিশিং লাইন এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে... আর ওই সামনে লোকটা ছুঁয়ে ফেলল লাইনটা!
হাততালি পড়ছে খুব। মাঠের পাশের জাজরা দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলল বাবার সাইকেল। দাদু অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। আসলে দাদু তো এই মাত্র এসে ঢুকেছে মাঠে তাই বুঝতে পারছে না।
‘কী হল বলত? তোর বাবা হারল তো, নাকি?’
পাশের থেকে মাসি হাসল এ বার, ‘বাবা তুমি কিছু বোঝো না?’
দাদু তাকাল আমার দিকে, ‘বুজাই কী রে তোর চোখে জল কেন? এই, বাবা হেরে গেছে বলে?’
আমার চোখে জল? কোথায়? চোখে হাত দিলাম। আরে, তাই তো! আমি দ্রুত হাতে মুছে নিলাম চোখ। বললাম, ‘হেরেছে? কে হেরেছে? বাবা তো হারেনি।’
‘মানে?’ দাদু হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হারেনি? তবে যে সবার শেষে ছিল। সবাই তো ওর আগে ফিনিশ করল। আর ও তো সবার শেষে...’
‘সবার শেষে থাকলেই বুঝি হারে?’ মাসি বলল, ‘বাবা এটা স্লো সাইকেল রেস। সবার শেষে থাকলেই এখানে জেতা যায়। আর সত্যি করে বলো তো, সবার শেষে থাকা মানেই কি সব সময় হেরে যাওয়া?’
আমি জানি না দাদু কী বলল। আমি জানি না আশেপাশের মানুষ কতটা হাততালি দিল। আমি শুধু দেখলাম সারারাত ট্রেনের জেনারেল কামরায় দাঁড়িয়ে আসা একটা মানুষ, পুরনো দেশলাই বাক্সের মতো শ্যামলা আর রোগা একটা মানুষ। আর তাকে ঘিরে জমে থাকা ভিড়।
আর মানুষটা ভিড় কাটিয়ে এই বক্সের দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজছে ওই চোখ দুটো? কীসের টানে খুঁজছে? কত দিন ধরে তুমি আমায় খুঁজছ বাবা? আমি বন্ধুদের বলব ওই সাদা-কালো মানুষটা আমার বাবা। আর দাদুকে বলব নরম কাদামাটি শুধু গলেই যায় না। আগুনে পুড়ে আর রোদে ঝলসে সে আর এক রকম রূপও ধারণ করে।

ছবি: সুমন চৌধুরী




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.