রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
ছোট্ট বন্ধু, ভাল থেকো
ন আঁধার রাত। তারা-ঢাকা মেঘের ফাঁক দিয়ে যেটুকু চাঁদের আলো ফুটে বেরোচ্ছে, তাতে পথের ঢাল ঠাহর করে এগোনো মুশকিল। ভরসা আমাদের মধ্যে কয়েক জনের হাতের ছোট টর্চ। সেই এক চিলতে আলোতেই একে অপরের পিছু পিছু সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছি সমুদ্রের গর্জন লক্ষ করে। চলতে চলতে বালুপথে পা পড়তেই অন্ধকার ভেদ করে এল সতর্কবার্তা: ‘থামুন। ওরা চাপা না পড়ে।’ সচকিতে থমকে দাঁড়ালাম আমরা।
২০১০ সালের জুন। রুশিকুল্যা সমুদ্রতটে পৌঁছতে আগের দিন সকাল সাড়ে সাতটায় হাওড়া স্টেশন থেকে ‘ফলকনামা এক্সপ্রেস’ ধরেছিলাম। গন্তব্য ওড়িশার গঞ্জাম জেলার বালুগাঁও। ওই এলাকায় বিরল অলিভ রিডলি প্রজাতির কচ্ছপ যে ডিম পাড়তে আসে তা শুনেছিলাম। কিন্তু ভাবিনি, সে দৃশ্য কখনও চাক্ষুষ করার সুযোগ হবে। তাই সুযোগ যখন এল, তখন রওনা দিতে দ্বিধা করিনি। ঘণ্টা সাতেকের পথ। ট্রেন ছাড়তেই বাঙ্কে রাখা বালিশ-বিছানা নামিয়ে বসে গিয়েছিলাম প্রাণিজগৎ সম্পর্কিত একটি পত্রিকা নিয়ে কচ্ছপকুলের হালহকিকত জানতে।
সামুদ্রিক কাছিমদের মধ্যে অলিভ রিডলি আকারে সব থেকে ছোট। তাতেই পূর্ণবয়স্কদের ওজন গিয়ে দাঁড়ায় ২৫ থেকে ৪৫ কিলো! জলপাই সবুজ রঙের খোলস-বিশিষ্ট কাছিমগুলি পাওয়া যায় অপেক্ষাকৃত উষ্ণ জলে। জীবনসমুদ্রে একাকী সাঁতরে বেড়ানো এই প্রজাতি দলবদ্ধ হয় বছরে এক বার সমুদ্রতটে, প্রজননের কারণে।
অলিভ রিডলিদের প্রসবকালীন আচরণ প্রাণিজগতে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা হিসেবে গণ্য হয়। বাসা বাঁধার সময় এলেই এরা জড়ো হতে থাকে সমুদ্রের সন্নিকটে। তার পর একযোগে হাজার হাজার স্ত্রী-কাছিম তীরে উঠে আসে ডিম পাড়তে। এক এক জন একশোটির মতো ডিম পাড়ে। বিশ্বের কিছু সমুদ্রতটে এত কাছাকাছি বাসা বাঁধতে হয় এদের যে, প্রায়শই একটি কচ্ছপ অন্যের ডিম খুঁড়ে বার করে দিয়ে সেই গর্তে নিজের ডিম পাড়ে।
কোন সংকেতে কাছিমকুল একযোগে প্রসব করতে আসে? বিজ্ঞানীদের নানা মত। যেমন, উপকূলে বাতাসের গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন, তিথি বিশেষে চাঁদের দশা ও স্ত্রী-কাছিমের দেহে বিশেষ হরমোনের নিঃসরণ। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁরা এখনও ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেননি।
ওড়িশার মূলত তিনটি তটে অলিভ রিডলিরা প্রসবকালে বাসা করে। কেন্দ্রপাড়া জেলায় গহিরমাথা অঞ্চলে নাসি দ্বীপপুঞ্জ, পুরীর সন্নিকটে দেবী নদীর উৎস, আর এই রুশিকুল্যা। কিন্তু বড়ই কঠিন এদের জীবনসংগ্রাম। সারা বিশ্বে গত কুড়ি বছরে অলিভ রিডলির সংখ্যা কমে গিয়েছে ২৮ থেকে ৩২ শতাংশ। ২০০৮ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রজননকারী স্ত্রী-কাছিমদের সংখ্যা এসে ঠেকেছে সাড়ে আট লক্ষের সামান্য ওপরে। ওড়িশাতেই ১৯৯৩ থেকে ২০০৩ দশ বছরে এক লক্ষেরও বেশি অলিভ রিডলি মারা গিয়েছে, শুধুমাত্র মৎস্য শিকারিদের তাণ্ডবে। সেই জন্য সদ্য আগত স্বেচ্ছাসেবকদের সমুদ্রতটে পৌঁছনোমাত্র সাবধান করে দিয়েছিল ভীমা, যাতে ক্ষতির বহর আর না বাড়ে।
ভীমার পরিচয় পরে দিচ্ছি। তার আগে বলে নিই, সে বছর এমনিতেই কচ্ছপ সংরক্ষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল, কারণ অলিভ রিডলির দল ডিম পাড়তে হাজির হয় অনেক দেরিতে। ‘গত বছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ওদের ডিম পাড়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর এ বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহেও ওদের দেখা নেই,’ কচ্ছপ-বিশারদদের দুর্ভাবনা প্রকাশ পেয়েছিল সংবাদপত্রে ছাপা বয়ানে গ্রীষ্মের গোড়ায়। তারা অবশ্য এসেছিল, এই বয়ান ছাপার আরও এক সপ্তাহ পরে। আড়াই মাস অপেক্ষার পর সেই ডিম ফোটার সন্ধিক্ষণ উপস্থিত। সেই উপলক্ষেই আমাদের ওড়িশা আগমন।
বালুগাঁও স্টেশন থেকে অটো রিকশা ধরে বড়কুলের সরকারি পান্থনিবাস মিনিট পনেরোর পথ। লজের পাশেই চিল্কা হ্রদ। ওখানকার বোর্ডে লেখা বানান অনুযায়ী চিলিকা হ্রদ। অর্থ, জলে ঢাকা মাটি। হ্রদের ধারে গিয়ে দাঁড়াতেই ভেসে এল ছেলেবেলার একটুকরো স্মৃতি। আমি তখন ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণিতে। পুরী বেড়িয়ে ফেরার পথে এই হ্রদে নৌবিহারে গিয়েছিলাম সপরিবার। মাঝদরিয়ায় প্রপেলার আটকে গেল, নৌকা একদম নট নড়নচড়ন। জলে ঝাঁপ দিয়ে টানাটানি করেও মাঝি কিছু করতে পারল না। অগত্যা শঙ্কিত চিত্তে, উদরে ছুচ্ছুন্দরের কীর্তন শুনতে শুনতে ঝাড়া একটি ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল, কখন অন্য নৌকা সাহায্য নিয়ে পৌঁছয়। সাহায্য বলতে এসেছিল একটি রামদা। যা দিয়ে কেটে জলের তলার লতাপাতার জট থেকে প্রপেলার মুক্ত করা হয়েছিল।
খোঁজ নিয়ে জানলাম রুশিকুল্যা পৌঁছতে চিল্কার জলপথ নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে হ্রদের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখলাম।
হাতে তখনও অনেক সময়। কারণ, ডিমগুলি ফোটে ভোর রাতে। সুতরাং ধীরেসুস্থে গেলাম নৈশভোজ সারতে। বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছেন এখানে অলিভ রিডলির টানে। কথা হচ্ছিল বস্ত্রনির্মাতা টার্টল কোম্পানিতে কর্মরত এক বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে। কোম্পানি যেহেতু কাছিমের নামে, তাঁরা এই বিরল প্রজাতির সংরক্ষণে সাহায্য করে থাকেন। ‘দিন দশেক না খাইয়েও এদের বাঁচিয়ে রাখা যায় বলে মাছের বাজারে জ্যান্ত কচ্ছপ বিক্রি আটকানো যাচ্ছে না। তাই মাছের ব্যাপারিদের মধ্যে ওড়িয়া ভাষায় ছাপানো ইস্তেহার বিলি করছি, বোঝাতে যে, কচ্ছপরা কী ভাবে নোংরা খেয়ে জল পরিষ্কার রাখে। তাতে মাছের স্বাস্থ্য ও স্বাদ, দুইয়েরই উন্নতি হয়।’

জনা বিশেক শিশু এসে হাজির। রুক্ষ কেশ, ছিন্ন বেশ, হাতে তাদের ভাঙা ঝুড়ি অথবা বালতি, চোখে-মুখে উৎসাহের ঝিলিক। আশপাশের গ্রাম থেকে এসেছে কাছিম শিশু সংগ্রহে। এই খুদেরা বরঞ্চ প্রাপ্তবয়স্কদের থেকেও অধিক কার্যকর। কারণ, শরীরের ওজন কম হওয়ার ফলে এদের পদক্ষেপে ভূগর্ভস্থ ডিমের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

ওখানেই আলাপ হল মার্ক ও এমা-র সঙ্গে। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে এই যুবকযুবতী এসেছেন ভারত ভ্রমণে। দু’জনেই কলেজে পড়েন। “‘লোনলি প্ল্যানেট’ পড়ে জানলাম, এই সময়েই এখানে অলিভ রিডলির জন্ম হয়। বেড়ানোর অবকাশে যদি একটা ভাল কাজ করা যায়, সেই ভেবে ইন্টারনেট ঘেঁটে আমরা ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটি অব ওড়িশা-র সঙ্গে ই-মেলে যোগাযোগ করি। তারাই আমাদের এই দিন সমুদ্রতটে পৌঁছতে বলে।’’
টিভি দেখে রাতের দ্বিতীয় প্রহর অবধি কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পরনে কালো পোশাক, যাতে অন্ধকারে মিশে থাকা যায়। জিপ-যাত্রায় আমাদের সঙ্গী শ্রীমান ভীমা। ঝাঁকড়া চুল, মিশকালো রং, পেটা চেহারা। ‘অপারেশন কছুয়া’র কর্ণধার ও ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটি অব ওড়িশা-র সম্পাদক বিশ্বজিৎ মহান্তির বিশ্বস্ত সৈনিক। সে-দিন রাতে মহান্তি সাহেব নিজেও আসছেন কাছিমকুলের নতুন প্রজন্মের কুশল সংবাদ নিতে।
এই ভীমার কাছেই আমাদের কচ্ছপছানা সামলানোর প্রথম পাঠ। ‘এ বছর মা-কচ্ছপরা এত দেরিতে ডিম পাড়ল যে ক’টা বাচ্চা বাঁচবে তা সন্দেহ’, ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল সে। ওদের হিসেবে এ বারের বাসার সংখ্যা এক লক্ষ বিরাশি হাজারের মতো। সংখ্যাটা শুনে বোধ হয় আমার মুখে একটা স্বস্তি ফুটে উঠেছিল। বিষণ্ণ হেসে ও বলে উঠল, ‘দিদি, অর্ধেক ডিম ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।’ অতঃপর জিপ জুড়ে বিমূঢ় নৈঃশব্দ্য।
অনাগত কচ্ছপকুলের ধ্বংসপ্রাপ্তির কারণটা ধীরে ধীরে বুঝলাম। শীতের তুলনায় গ্রীষ্মে সমুদ্রতটে ক্ষয় হয় অনেক বেশি। ডিমের নিয়তির সঙ্গে এই তথ্য অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত, কারণ ডিমগুলি মা-কচ্ছপেরা পুঁতে যায় এক-দেড় হাত গভীরে, বালুরাশির উষ্ণ আশ্রয়ে। বালি যত সরে যায় গ্রীষ্মের হাওয়ায়, ডিমগুলি তত বেআব্রু হয়ে পড়ে। ডিম ফোটার সময় বর্ষা এসে গেলে আর এক বিপদ। ‘এই যে কাল বৃষ্টি হল, ওপরের বালি এত শক্ত হয়ে রয়েছে, অনেক বাচ্চা গর্তের মুখ ভেদ করে ওপরে উঠতেই পারবে না’, আক্ষেপভরা গলায় বলল ভীমা।
মহান্তিমশাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁকে অনুসরণ করে এগোলাম সমুদ্রতটের দিকে। একটু পরেই থমকে দাঁড়াতে হল। সামনে উঁচু তারের জাল, সমুদ্রতট বরাবর। তিনি একা এগিয়ে গেলেন। তাঁর হাতের ঠেলায় এক জায়গায় বেড়াটা খুলে কিছুটা সরে গেল। সরু ফাঁক দিয়ে এক এক করে গলে ঢুকতে থাকলাম। মনে হল কে বা কারা যেন দূর থেকে নজর রাখছে আমাদের ওপর। অস্বস্তিতে সে দিকে তাকাতে দেখি দূরে ভাটার মতো জ্বলছে ও কী? বেড়াটা ঠেলে আবার বন্ধ করতে করতে মহান্তিবাবু নিচু গলায় উত্তর দিলেন, ‘হায়নার চোখ। বুনো কুকুর আর হায়নার জন্যই দেওয়া এই বেড়া। কচ্ছপের মাংস ওদের খুব প্রিয় কিনা।’
এক জায়গায় গোল হয়ে আমরা ক’জন দাঁড়ালাম ভীমা ও মহান্তিবাবুকে ঘিরে। প্রত্যেকের হাতে দেওয়া হল একটি করে ছিদ্রভরা প্লাস্টিকের বালতি। কাজ শুরুর আগে দেওয়া হল কচ্ছপ-শিশু রক্ষার ঝটিতি পাঠ। ‘মন দিয়ে শুনুন’, বললেন মহান্তিবাবু, ‘আপনাদের কাজ হল গর্ত থেকে বের হওয়া কচ্ছপদের বালতিতে তুলে একত্র করে সমুদ্রের পথে এগিয়ে দেওয়া। ওদের তুলবেন খুব সাবধানে, খোলসের দু’পাশ ধরে। খবরদার, গর্ত থেকে বেরনোমাত্র যেন বালতিতে বসিয়ে দেবেন না। ডিম ফেটে সুড়ঙ্গ ফুঁড়ে বেরনোর ধকল সইতে দিন। এই আবহাওয়ায় অভ্যস্ত হতে দিন। জমিতে পা ফেলে ওরা যদি কিছুটা হাঁটতে না পায়, তা হলে হয়তো হাঁটতেই শিখবে না।’

গর্তের থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটি কচ্ছপ শিশু চিত হয়ে পড়ে আছে দেখে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তাকে সাহায্য করতে, যাতে চার পায়ে আবার সে চলতে পারে। কিন্তু তার ওপর টর্চের আলো পড়তেই স্তম্ভিত হয়ে থমকে গেলাম। নরম একফালি বুকের মাঝে একটি নির্মম ছিদ্র!

আমরা ছড়িয়ে পড়লাম বালতি হাতে। বেশি দূর এগোতে হল না। পেন্সিল টর্চের আলোয় দেখি এক গা বালি মেখে গর্তের মুখে কী যেন নড়াচড়া করছে। একটু অপেক্ষা করতেই এক আঙুল সমান লম্বা বপুটি টেনেটুনে বের করল শ্রীমান। স্থির হয়ে যেন নিরীক্ষণ করল আমার জুতোর ফিতেটা। তার পর শুরু হল তার চলা। কী প্রচণ্ড শ্লথ সে গতি! ‘ঈশপ’-এর গল্পে কচ্ছপের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া খরগোশটির কথা মনে পড়ল। এই গতিতে হেঁটে সমুদ্রে পৌঁছতে তো ও নির্ঘাত বাকি রাতটা লাগিয়ে দেবে! আরও কিছু মুহূর্ত ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়ার পর অনভিজ্ঞ আঙুলের ফাঁকে ধরে মাটি থেকে তুলে শ্রীমানকে জমা দিলাম আমার বালতির আশ্রয়ে।
সে আত্মপ্রসাদ অবশ্য বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কারণ তার ঠিক পরেই চোখে পড়া একটি দৃশ্য। গর্তের থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটি কচ্ছপ-শিশু চিত হয়ে পড়ে আছে দেখে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তাকে সাহায্য করতে, যাতে চার পায়ে আবার সে চলতে পারে। কিন্তু তার ওপর টর্চের আলো পড়তেই স্তম্ভিত হয়ে থমকে গেলাম। নরম একফালি বুকের মাঝে একটি নির্মম ছিদ্র! ‘কাকের শিকার’, জানাল ভীমা। পৃথিবীর আলো দেখতে না দেখতে উড়ে আসা নখের আলগা টোকায় অসহায় ভাবে চিত হয়ে পড়া, তার পর তীক্ষ্ণ চঞ্চুর এক কর্কশ আঘাতে সব শেষ। না, শ্রীমান কচ্ছপ যত দ্রুতই চলুক, সমুদ্র অবধি পৌঁছবে না। তার আগেই আকাশপথে বিপদ ধেয়ে আসবে, যদি না আমরা আমাদের উদ্ধারকার্য ত্বরান্বিত করে তা ঠেকাতে পারি।
দ্বিগুণ মনোযোগ দিয়ে চিরুনি তল্লাশি শুরু করলাম নবজাতকদের খোঁজে। কিন্তু আমার সংগ্রহের দ্বিতীয় কচ্ছপটি আমায় খুঁজে নিয়েছিল আমি তাকে দেখার আগেই। কিছুক্ষণ ধরে কেমন একটা অস্বস্তি কেউ যেন আমায় অনুসরণ করছে। হঠাৎ ফিরে থাকাতেই ডান পায়ের গোড়ালির অনতিদূরে আবিষ্কার করি এই শ্রীমান (অথবা শ্রীমতী)-কে। টর্চের আলো দেখে নিশ্চিন্তে গুটি গুটি পিছু নিয়েছে সে। এই বার বুঝলাম কেন মহান্তিবাবু আমাদের টর্চের ব্যবহার
সমুদ্রে পৌঁছতে এই যে কিছুটা
বালুপথ কচ্ছপশাবকগুলি
নিজেরা পায়ে হেঁটে অতিক্রম
করবে, তাতেই তাদের
আত্মিক সংযোগ ঘটে যাবে
এই বেলাভূমির সঙ্গে।
যথাসম্ভব কম করতে উপদেশ দিয়েছিলেন। যে সময় কচ্ছপরা ডিম ফুটে বেরোয়, চাঁদ থাকে সমুদ্রের দিকের আকাশে। তাই প্রকৃতির নিয়মেই তারা চাঁদের আলো অনুসরণ করে সমুদ্রে পৌঁছে যায়। কিন্তু কোথাও যদি সমুদ্রতটের পাশেই হাইওয়ে বানানো হয়, তবে সেই পথ দিয়ে ধাবমান যানবাহনের হেডলাইটের আলোয় বিভ্রান্ত কচ্ছপকুল নিজেদের কোন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় তা সহজেই অনুমেয়।
ভোরের আলো ফোটার আগেই সমুদ্রতট ভরে উঠল কচিকাঁচাদের কোলাহলে। জনা বিশেক শিশু এসে হাজির। রুক্ষ কেশ, ছিন্ন বেশ, হাতে তাদের ভাঙা ঝুড়ি অথবা বালতি, চোখে-মুখে উৎসাহের ঝিলিক। আশপাশের গ্রাম থেকে তারাও এসেছে কাছিম-শিশু সংগ্রহে। প্রথমে এদের সন্দেহের চোখে দেখছিলাম, কিন্তু আশ্বস্ত হলাম শুনে যে, এরাও আমাদের মতো সংরক্ষণ যুদ্ধের সৈনিক। এই খুদেরা বরঞ্চ প্রাপ্তবয়স্কদের থেকেও অধিক কার্যকর। কারণ, শরীরের ওজন কম হওয়ার ফলে এদের পদক্ষেপে ভূগর্ভস্থ ডিমের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
কিছুক্ষণ পরেই দেখি তাদের অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দ্রুত হস্তে বালি খুঁড়ে কচ্ছপশাবকগুলিকে বের করে আনতে। মহান্তিবাবু বা ভীমা, দু’জনের কেউই তখন কাছেপিঠে নেই। কাজটা শাবকগুলির পক্ষে স্বাস্থ্যসম্মত কি না, এই সন্দেহে তাদের থামানোর চেষ্টা করলাম। তারা কী জবাব দিল, মোটেও বোধগম্য হল না। হিন্দি-বাংলা মেশানো খিচুড়িতে আমি ও বিশুদ্ধ ওড়িয়ায় তারা দু’পক্ষের বাদানুবাদ চলল বেশ কিছুক্ষণ। শব্দের স্রোতে ‘টঙ্কা’ ছাড়া একটি কথাও উদ্ধার করতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে উল্টো মুখে হাঁটা দিলাম। অস্বীকার করব না, বীতশ্রদ্ধ হওয়ার আর একটি কারণও ছিল। দু’ঘণ্টার চেষ্টায় যখন আমার বালতিতে সবে এক ডজন শাবক সংগ্রহ হয়েছে, তখন ওদের এক এক জনের ঝুড়ি ইতিমধ্যেই অর্ধেক ভরা। হিংসে হবে না?
পরে শুনেছি রাজ্যের বনবিভাগ সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ওদের এই কাজ দেয়। সেই ‘টঙ্কা’ই কি ওরা আমার কাছ থেকে আদায়ের চেষ্টা করছিল?
কিছুক্ষণের মধ্যেই দিগন্তে সমুদ্রবক্ষে সূর্যের প্রথম রশ্মি তিল তিল করে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বোধ হয় সেই অপরূপ দৃশ্যে কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিলাম তাই টের পাইনি কখন তার সঙ্গে সংকটের কালো মেঘও ঘনিয়ে এসেছে। আচম্বিতে ক্ষুধার্ত বায়সবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল সমুদ্রতটে প্রাতরাশের সন্ধানে। সূর্যোদয়ের ঘোর কাটল তাদের কর্কশ কলধ্বনিতে। ঝটিতি আক্রমণে দিশাহারা হয়ে আমরা দৌড়ে বেড়ালাম এ দিক থেকে ও দিক, কিন্তু তাদের ছোঁ মেরে শিকার ধরা আটকাতে পারলাম না। শেষে কাকতাড়ুয়ার ভূমিকায় ব্যর্থ হয়ে আবার যখন আশপাশের গর্তে মনোনিবেশ করেছি শাবকদের সন্ধানে, তখন চোখে পড়ল এমন কিছু, যার সম্পর্কে ভীমা বা মহান্তিবাবু কেউই আমাদের সতর্ক করেননি।
দেখলাম একটি কচ্ছপশিশু গর্ত থেকে বেরিয়েই দ্রুত আবার গর্তের মধ্যে ঢুকে গেল। নবজাতকের এ হেন অদ্ভুত আচরণে বিস্মিত হয়ে অপেক্ষা করছি তার পুনরাগমনের আশায়। কিন্তু তার আর ফেরার নাম নেই। এমন সময় কিছুটা দূরে দেখি আর একটি শিশুকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পাশের একটি গর্তের দিকে। প্রাণপণ শক্তিতে ধেয়ে গেলাম সে দিকে। আমার পদধ্বনির কম্পনে সতর্ক হয়ে তাকে মুক্তি দিয়ে সরে গেল তার মৃত্যুদূত এক বিরাট কাঁকড়াবিছে। কাছে গিয়ে তাড়াতাড়ি আমার বালতির নিরাপদ আশ্রয়ে শাবকটিকে তুলতে গিয়ে শিউরে উঠলাম। শিকার ছাড়ার আগে বিছেটা তার দুই দাঁড়ার নির্মম আলিঙ্গনে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে কাছিমশিশুটির ধড় ও মুণ্ড।
ব্যর্থতার অন্ধ আক্রোশ ও নৈরাশ্যের বেদনায় সেই মুহূর্তে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। থামিয়ে দিয়েছিলাম কচ্ছপ সন্ধানের কাজ। বল পেলাম আবার গ্রাম্য শিশুগুলির দিকে চেয়ে, কী ভাবে চার পাশে মৃত্যুদূতের উপস্থিতি উপেক্ষা করে অফুরান উৎসাহে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
ধীরে ধীরে ঘড়ির কাঁটা যখন সাড়ে ছ’টা ছুঁল, মহান্তিমশাই হাঁক পাড়লেন সবাইকে কচ্ছপের বালতি হাতে একত্রিত হতে বলে। এ বার কাছিমছানাদের যাত্রা শুরুর পালা। জলরেখা থেকে আমাদের বলা হল ফুট বিশেক পিছিয়ে যেতে। কারণটি চমকপ্রদ। সমুদ্রে পৌঁছতে এই যে কিছুটা বালুপথ কচ্ছপশাবকগুলি নিজেরা পায়ে হেঁটে অতিক্রম করবে, তাতেই তাদের আত্মিক সংযোগ ঘটে যাবে এই বেলাভূমির সঙ্গে। যদি কুমির এবং সামুদ্রিক মাছের কবল থেকে বেঁচে শিশু অবস্থা কাটিয়ে দিতে পারে, তবে পনেরো-কুড়ি বছর পরে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে তারা যখন প্রজননের জন্য প্রস্তুত হবে, তখন যত দূরেই তারা থাকুক না কেন, এই রুশিকুল্যাতেই ঠিক ফিরে আসবে জন্মস্থানের টানে।
কত দূরে যায় অলিভ রিডলি কচ্ছপের দল? হাসলেন মহান্তিবাবু। ‘আমরা কিছু প্রাপ্তবয়স্ক কচ্ছপের খোলের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ট্রান্সমিটারে পাঠানো তথ্য অনুযায়ী এরা শ্রীলঙ্কা উপকূল বা তার চেয়েও দূরে চলে যেতে পারে।’
আবার বছর কুড়ি বাদে সত্যিই কি এরা ফিরতে পারবে? মহান্তিবাবু নিশ্চিত নন। তাঁর কাছে শুনলাম ওড়িশা সরকার উপকূলপ্রান্তকে যথাসম্ভব লাভজনক করে তুলতে সমুদ্রতট বরাবর বন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ‘গোপালপুর বন্দর এখান থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূর। সেখানকার ছোট বন্দরটিও অল ওয়েদার পোর্ট হয়ে যাবে। বছরভর বড় বড় জাহাজ এসে নোঙর ফেলবে। শেষ হয়ে যাবে রুশিকুল্যা,’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
আমার বালতি থেকে শেষ কচ্ছপটি তুলে ডান হাতের তালুতে রাখলাম। যাত্রা শুরু করার কী তাড়া তার! নিমেষে হাতের দৈর্ঘ্য পেরিয়ে শ্রীমান আমার আঙুলের ডগা টপকে ঝাঁপ দেয় আর কী! তার কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে তাড়াতাড়ি তাকে নামিয়ে দিলাম সমুদ্রবেলায়। ধীরে ধীরে সে এগিয়ে চলল সফেন তরঙ্গরাশির দিকে। অন্তরাত্মা থেকে ঠোঁটে উঠে এল একটুকরো প্রার্থনা ছোট্ট বন্ধু, ভাল থেকো।

ছবি: লেখক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.