ভয়ঙ্কর তবু নিশির ডাক
ঠাৎ এক এক দিন ওপারের সবুজ খড়ের জমির শেষে নীল আকাশটা যেখানে আসিয়া দূর গ্রামের সবুজ বনরেখার উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, সেদিকে চাহিয়া দেখিতেই তাহার মনটা যেন কেমন হইয়া যাইত সে সব প্রকাশ করিয়া বুঝাইয়া বলিতে জানিত না। শুধু তাহার দিদি ঘাট হইতে উঠিলে সে বলিত দিদি দিদি, দ্যাখ্ দ্যাখ্ ঐদিকে পরে সে মাঠের শেষের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিত ঐ যে? ঐ গাছটার পিছনে? কেমন অনেক দূর, না?” বিভূতিভূষণের অপু, ‘অনেকদূর’-এর টানে একে একে ছেড়েছিল নিশ্চিন্দিপুর, কাশী, কলকাতাও। বঙ্গবাসী পত্রিকার বিলাত যাত্রীর চিঠি মারফত শুরু হয়েছিল যার মানস বিশ্বভ্রমণ, সেই অপুই পথের বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিলক কপালে পরে ঘরছাড়া হয়েছিল এক দিন। বইয়ের পাতার অভিযাত্রিকদের অভিযান আপন-জীবনে বরণ করে নিয়েছিল সে।
অভিযান সবার ঘটে ঘটে না। সে বিপুল সুদূর ব্যাকুল বাঁশি বাজিয়ে যাদের ঘরছাড়া করে, তারা সত্যিকারের এলেমদার।
অভিযান শব্দটা শুনলেই কেমন একটা মন কেমন করা, এক্সোটিক হাতছানি মনে পড়ে না?
সাহেব কবি লিখছেন:
It works in me like madness to say goodbye
For the seas call, and the stars call, and oh! the call of the sky!

রবীন্দ্রনাথও তারই প্রতিধ্বনি করেন:
বিপদবাধা কিছুই ডরে না সে
রয় না পড়ে কোনও লাভের আশে
যাবার লাগি মন তারি উদাসে...।

কেন এই ছেড়ে, দূরে চলে যাওয়া? কেননা, দূরত্বের মাঝে যে মুক্তির স্বাদ আছে, নির্ভার, যা-ইচ্ছে-তাই স্বাধীনতা আছে। ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্কর তাই শ্যামনগরের পাটকলের ভোঁ চায়নি, চেয়েছিল আফ্রিকার জনহীন প্রান্তর, রহস্যময়ী রাত্রি, তারা ভরা আকাশ। সংসারের নিভৃতিকে অচেনার, অজানার ভ্রুকুটির মাঝে সমর্পণ করে তবেই অভিযাত্রীর শান্তি। দূরে না গেলে নিজেকে চেনা যায় নাকি?
অভিযানে, যেমন আছে আবিষ্কারের আমোদ, তেমনি অপ্রত্যাশিত সঙ্কট। দুঃখ, মৃত্যু, দুর্লঙ্ঘ্য জনবিরল পথে চোখের সামনে প্রিয় বান্ধবের (সে হতে পারে মানুষ বা ভারবাহী পশু, কি অপরিহার্য যন্ত্র) বিরহদহন। গহন রহস্য সামনে দাঁড়িয়ে, অনেক সময়ই মৃত্যুপণে কিনতে হয় তাকে। লাইকা যেমন। মহাকাশযাত্রার আগেই সবাই জানতেন, জীবিত ফিরবে না সে আর পৃথিবীতে। অথবা ডক্টর ডেভিড লিভিংস্টোন? ১৮৪১-এ আফ্রিকা মহাদেশ অভিযাত্রী প্রথম পশ্চিমি, গিয়েছিলেন রহস্যাবৃত নীল নদের উৎসমুখ খুঁজতে। একা, প্রাণঘাতী ম্যালেরিয়া-আমাশায় ভোগা, সর্বস্ব চুরি যাওয়া মানুষটি হারিয়েই গিয়েছিলেন আফ্রিকার অন্তরমহলে, ইউরোপ-আমেরিকায় রটে গেছিল তাঁর মৃত্যুর গুজব। তিরিশ বছর পর, ১৮৭১-এ, আর এক অভিযাত্রী, স্ট্যানলি হেনরি মর্টন লিভিংস্টোন-এর রুট ধরে গিয়েখুঁজে বের করেন অগ্রজ সতীর্থকে। পড়ুন ১৯১১’য় দক্ষিণ মেরু বিজয়ী রোয়াল্ড আমুন্ডসেনের কথা। অভিযানের আগে পর্যন্ত সহযাত্রীরা জানতেন, সবাই যাচ্ছেন উত্তর মেরুতে, একা আমুন্ডসেন যাত্রাপথে সিদ্ধান্ত পালটে সবান্ধব রওনা দিলেন দক্ষিণ মেরুর পথে। মাইনাস ষাট ডিগ্রির আন্টার্কটিকা, যাত্রাপথের নিদারুণ স্নো-ব্লাইন্ডনেস, সব সয়ে এক নিরন্তর যাত্রা। স্লেজ টানা ৪৫টি কুকুরের ৭টি পথেই মারা গিয়েছিল, আরও ১৮টিকে নিজের হাতে মারলেন তাঁরা। চামড়া ছাড়িয়ে মাংস কেটে বিলোনো হল জীবিত কুকুর ও মানুষের মধ্যে। এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগে কিংবদন্তি হয়ে আছেন ’৫৩-র এভারেস্ট বিজয়ে, কিন্তু কেউ মনে রাখেনি টম বোর্দিলো আর চার্লস ইভান্স’কে, শৃঙ্গের ১০০ মিটারের মধ্যে এসেও শরীরঘাতী ক্লান্তিতে যাঁরা নেমে আসতে বাধ্য হন। পা রাখেননি চূড়োয়, প্রোথিত করেননি দেশের পতাকা, তা বলে কিছু কি কম তাদের কৃতিত্ব? মৃত্যুর মাঝে অমর হয়ে আছেন আরও দুই ব্রিটিশ এভারেস্ট অভিযাত্রী, জর্জ ম্যালোরি আর অ্যান্ড্রু আরভিন। ১৯২৪-এর সর্বপ্রথম এভারেস্ট-অভিযানে দু’জনেই নিখোঁজ হয়ে যান, শেষ তাঁদের দেখা গিয়েছিল পবর্তচূড়ার শ’খানেক মিটারের মধ্যেই। দীর্ঘ ৭৫ বছর পর, ১৯৯৯ সালে ম্যালোরির বরফশীতল মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়, আর আরভিনকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি (যদিও এ নিয়ে বিতর্ক প্রচুর)। ইন্দো-আমেরিকান মেয়ে কল্পনা চাওলা ১৯৯৬ সালে গিয়েছিলেন মহাকাশে, নাসা থেকে। ১০.৪ মিলিয়ন কিলোমিটার ঘুরে, পৃথিবীকে ২৫২ বার পাক খেয়ে আসা মেয়ের দুর্দম সাধ মেটেনি, ২০০৩-এ স্পেস শাট্ল কলম্বিয়ায় আবার যান মহাকাশে। ফেরার সময় ঘটে বিপর্যয়, পৃথিবীর বাতাসমণ্ডলে ঢোকার পরই টেক্সাসে ভেঙে পড়ে কলম্বিয়া, মারা যান কল্পনা সহ কলম্বিয়ার সাত জন অভিযাত্রীই। অভিযান-আত্মার অমোঘ অল্টার-ইগো’র নাম তাই মৃত্যু।
তবু, মৃত্যুদূত শিয়রে নিয়েও সাফল্যের খতিয়ানই বা কম কীসে? হোক না সে দুর্ঘটনা, এক জন কলম্বাস বা রবিনসন ক্রুসো গোড়াপত্তন করেন নতুন সভ্যতার। এক জন নীল আর্মস্ট্রং ছোট্ট পা ফেলেন চাঁদের মাটিতে, আর পৃথিবীর মানুষ এক লাফে এগিয়ে যায় কত খানি! এক জন চার্লস ডারউইন দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল বরাবর পাঁচ বছর ভূতত্ত্ব গবেষণা আর ন্যাচারাল হিস্ট্রির উপাদান সংগ্রহ করে তৈরি করে ফেলেন এক যুগান্তকারী বই ‘অন্ দি অরিজিন অব স্পিসিস’ আর বিবর্তনবাদের মোক্ষম ভিত্তি। উটা-র ক্যানিয়ন-এ ৩৬০ কেজি বোল্ডারে হাত-চাপা পড়ে পাঁচ দিন সাত ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া তুখোড় তরুণ অ্যারন রোল্স্টন অন্য হাতটায় একটা ভোঁতা ছুরি নিয়ে হাড়, চামড়া, মাংস ভেদ করে কেটেই ফেলেন চাপা-পড়া, বিষিয়ে-ওঠা হাতটা, আর নিজের অজান্তেই হয়ে ওঠেন মৃত্যুকে সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসতে-দেখা পৃথিবীর যে কোনও মানুষের নাছোড়বান্দা মোটিভেশন।
কত অভিযান তবু না-বলা রয়ে যায়। যুগে-যুগান্তরে, দেশে-দেশান্তরে, রাজনীতির বারুদে-ঠাসা, যুদ্ধের মোড়কে-আঁটা সামরিক অভিযানগুলো যদি বা বাদও দিই, উল্লেখ না করে পারা যায় না বুদ্ধের মহাভিনিষ্ক্রমণ (এমনকী, পরিনির্বাণও), শ্রীচৈতন্যের সংসারত্যাগ ও কৃষ্ণনাম প্রচার, বিবেকানন্দের শিকাগো যাত্রার মতো সুদূরপ্রসারী গুরুত্ববহ অভিযাত্রাগুলি। মনে পড়ে যায়, ওয়ান্ডারল্যান্ড-এর অ্যালিস-এর কথা, সুইফ্ট-এর লেখনীতে লেম্যুয়েল গালিভার-এর আশ্চর্য অভিযান, আর আমাদের ঘরের চিরচেনা বুড়ো আংলা, আমতলি গাঁয়ের রিদয়ের অবাক-যাত্রা, নালকের মানস-পরিভ্রমণ।
বাঙালি মনে অবশ্য অভিযানের চিরন্তন মোটিফ অপু, দুর্গা। নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে যাওয়া অপুর, উত্তরকালে সাত-সাগর-তেরো-নদী ঘুরে আসা অপুর বড় মনে পড়ত দিদির কথা ‘অপু, সেরে উঠলে আমায় এক দিন রেলগাড়ি দেখাবি?’ অপু তা পারেনি। কিন্তু অভিমানী দিদিটা ভাইয়ের তোয়াক্কা না করে এক দিন রেলগাড়ি কেন, মহাকাশ দেখেছিল।
‘পরিচিত ও গতানুগতিক পথের বহুদূরপারে কোনও পথহীন পথে’, অনন্ত অভিযানে, সব দুর্গারাই হয়তো কোনও দিন কল্পনা চাওলা হয়ে যায়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.