|
|
|
|
কেনিয়ায় হাতির দাঁতের ব্যবসা |
শোলার টুপি, খাকি হাফ প্যান্ট, হাঁটু পর্যন্ত মোজা আর অ্যালবার্ট জুতো পরা, পাহাড়ে চড়ে,
বেবুনের মাংস খেয়ে,
দমাদম গুলি চালিয়ে... এই না হলে অভিযাত্রী? সাহারায় সীতাহরণ,
টাঙ্গানাইকার নেকড়ে
বাঙালির রক্তে অভিযান, সেই বিগ ব্যাং যবে থেকে। অমিতাভ মালাকার |
আর প্রায় সবার মতোই আমার খুব ভূতের ভয়। দেখা দিয়ে ভূতেরা আমাকে নিয়ে ঠিক কী প্ল্যান করতে পারে সে সম্বন্ধে খুব পরিষ্কার ধারণা না থাকলেও জানি ডরাতে হয়। আসলে ভয়টা বোধ হয় যতটা না মটকানো ঘাড় এবং কিছু কাল লাশকাটা ঘরে ঠ্যাং তুলে রজনী যাপন বা ছেলেপিলেদের গয়ায় গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পিণ্ডির ব্যবস্থা নিয়ে, তার চাইতেও বরং অনেক বেশি আমাদের জানা ‘সম্পূর্ণ নেই’ থেকে অজানা রং আলো শরীর দৃষ্টি সমেত চোখের সামনে ‘কিছু একটা’ হাজির হবে এমন দুশ্চিন্তায়। গয়ায় কি জষ্ঠি মাসে খুব গরম পড়ে? ওরা নাকি সারা দিন কেবল রুটি চাপাটি আর ভুট্টা পোড়া খায়? আমাদেরও কি ছাতুর লিট্টি খেতে হবে? ইয়াল্লা! তার চাইতে গরিব ব্রাহ্মণ আর তার বিধবা ভ্রাতৃবধূকে আগে থেকে সেথায় পাঠিয়ে হোটেল খুলিয়ে চাড্ডি টক-ডাল-ভাতের বাঙালি ব্যবস্থা করে রাখো।
এ সমস্যা না হয় মিটল। কিসুমু থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে জনহীন প্রান্তরের মাঝে স্টেশন-মাস্টারের চাকরি পেয়ে একা একা থাকার জন্য রওয়ানা দেওয়ার আগে যদি শঙ্কর জানতও যে সেখানে দুটি সাপে-কাটা অপঘাতে মৃত্যু ঘটেছে, তা হলেও হয়তো সে যেত, হয়তো নয়, যেতই, কার্বলিকের শিশি বগলে করে, বা সারা পথ রেললাইনের দু’পাশে সে মাল ছিটাতে ছিটাতেই। আপনি আমি কি যেতাম? দিব্যি গেলে বলুন দেখি! যে আগলবিহীন দরওয়াজায় সিংহ নাক ঠেকিয়ে জুলজুল করে চেয়ে থাকে আপনার দিকে, সে দরওয়াজা ঠেলে বেরিয়ে রাতে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর জন্য আগে থেকে গল্পে বন্দুক পিস্তল আর ডিয়েগো আলভারেজের প্রবেশ জরুরি। তার পরই কিন্তু শঙ্কর “প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল...চাঁদ উঠচে দূরের আকাশপ্রান্তে...ঘাসের বন যেন রহস্যময়, নিস্পন্দ...রাত্রির সৌন্দর্য এত আকৃষ্ট করেচে ওকে যে ও সিংহের সান্নিধ্য যেন ভুলে গেল...।” সিংহের সান্নিধ্য আর তেমন ভয়ের কি না সে নিয়ে সামান্য কিন্তু থাকলেও, ভূতের ভয় যে সে পায় না সে আমরা জানি, সে তার সেই পোড়ো মন্দিরের চাতালে একা বসে ভাবার সময় থেকেই।
বাঙালির গল্প-উপন্যাসে অভিযাত্রীদের যে সব মালমশলা দিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়, তা পূর্ববর্তী বেশ কয়েক শতক যাবৎ ইউরোপিয়ান অভিযাত্রীগণের দ্বারা সব ক’টি মহাদেশে নানা ভাবে পরীক্ষিত। একটা বইয়ের দুই মলাটের ভিতর গাউসকে দিয়ে জমি জরিপের অঙ্ক কষিয়ে, হুমবোল্টকে অচেনা প্রান্তরে বরফ ঢাকা তেপান্তরে ছেড়ে গাছপালা সংগ্রহ করিয়ে অচেনাটিকে আর একটু কাছের, আর একটু কম শ্বাপদসঙ্কুল করিয়ে তবে বাজারে ছাড়া হয়েছে: “যা বেটা বেঙ্গলির বাচ্চা, এর পর সাধ থাকলে ঘুরে দেখ।” জন ডে মশাই ট্রপিকাল অরণ্য ঘেঁটে অর্কিডের ছবি এঁকে, নাম দিয়ে এই মোটা মোটা খাতা ভরিয়েছেন যাতে আমরা চোখ খুলে চাওয়া মাত্তর বলে দিতে পারি, “আরে, ওইটা তো ইসে, মানে অর্কিড, মানে নামটা ভুলে গেছি, বাড়ি ফিরে বই খুলে বলে দেবো অখন।” |
|
গালিভার’স ট্রাভেল্স ছবিতে জ্যাক ব্ল্যাক |
সাইমন উইনচেস্টার এক ঘোর-লাগা উৎকেন্দ্রিক পাগলাটে মানুষের মাথার ভিতর অবিরাম জট পাকিয়ে চলা জটিল প্রক্রিয়াগুলো ধীরে সুস্থে পড়বার চেষ্টা করেছেন যাতে নাম দেওয়ার এবং তার মানে তৈরি করার অতি প্রাচীন ঐতিহ্যটি খানিকটা হলেও বুঝতে পারি এবং বিদেশ বিভুঁইয়ে বন্দুক কাঁধে ম্যানলিকার বা উইনচেস্টার রিপিটার হলেই ভাল হাংরি মানে হাঙরের মতো ক্ষুধার্ত ইত্যাদি বলে বিপদে না পড়তে হয়। মুজতবা আলি সায়েবের ‘দেশে বিদেশে’কে কি দুর্দান্ত দুশমনের সামনে ক্ষীণ-খর্বতনুবিশিষ্ট পাতি বাঙালির দুর্জয় সাহসের বীরগাথা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে কখনও? সেখানে না আছে বাঘ বাঘেল্লা সিংগির উৎপাত, না আছে নরমুণ্ডশিকারীর বর্শা হাতে দৌড়ে এসে খুঁচিয়ে দেবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, আর বন্দুক পিস্তল হাতে ধরে দেখার সৌভাগ্য ওনার কোনও কালে বাপঠাকুদ্দার আশীর্বাদে হয়েছিল এমন প্রমাণ ভূরি ভূরি আছে বলেও মনে হয় না। আর অভিযাত্রী বলতে আমরা যে রকম শোলার টুপি, খাকি হাফ প্যান্ট, হাঁটু পর্যন্ত মোজা আর অ্যালবার্ট জুতো পরা, পাহাড়ে চড়ে, বেবুনের মাংস খেয়ে, দমাদম কালা আদমিদের গুলি চালিয়ে সাবড়ানোয় পুঙ্গব ছাড়া ভাবতে পারি না, বা যে রকমটা ভাবতেই ভালবাসি, তার সঙ্গে নানা ভাষার কেতাবে বুঁদ হয়ে ছাকা আলি সায়েবের মিল কিছুমাত্র নেই। আমাদের দৌড় ওই মসজিদ অবধি, মনের আনাচকানাচে ঢুঁ মারার বদলে বনের হাতি ঘোড়া শিকারই অভিযাত্রীদের মানায় ভাল, এমনটাই আত্মস্থ করেছি।
পাবলো ভিয়রচি-র লেখা ‘দি ইম্পোস্টার্স’ উপন্যাসটার সম্পর্কে দু-চার কথা এ ক্ষেত্রে না বললেই নয়। শঙ্করের যেমন আলভারেজের সঙ্গে হলদে হিরের খনির সন্ধানে বেরনো, চাঁদের পাহাড় সামনে রেখে দিগ্বিদিক সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ও পারলে ম্যাপ তৈরি করে এগোনো, তেমনি অভিযানের গপ্পো আমরা হামেশাই পড়ে থাকি। পথ ভুলে জলকষ্টে দাঁত ছিরকুটে মরা সে ক্ষেত্রে ঘটে অন্যদের শিক্ষে দেওয়ার জন্য ঠাকুর বলেছিলেন ওতে লোকশিক্ষে হয়। ম্যাপ, কম্পাস, সেক্সট্যান্ট এর সঙ্গে ইসের কোনও সম্পর্ক নেই ধরে এগোও, সোনার খনির হদিশ নিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামিয়ে ফিরবে অনায়াসে। গোড়ায় কেবল ওই কী করতে চাইছ সেইটে ঠিক থাকলেই চলবে। সে পর্বতশৃঙ্গ জয়ও হতে পারে আবার ডাবল শৃঙ্গওলা গন্ডারের খোঁচা এড়ানোর জন্য উসিয়ান বোল্ট’কে তিন মাইল তফাতে ফেলে মেরে বেড়ানোও হতে পারে। ইম্পোস্টার্স-এর দুই ভবঘুরে নায়ক এমনিই বিনা কারণে লঞ্চ ভাসায় আমাজনের জলে, জঙ্গলে। এ গ্রাম, সে বসতি ঘুরে তার লোক ঠকায় কেবল ঠকানোর জন্যই। সম্পর্ক তৈরি করে ভেঙে ফেলবার জন্য, নৈতিকতার সমস্ত স্তম্ভ গুঁড়িয়ে মাটিতে মেশানোর আগে পর্যন্ত যেন নিস্তার নেই। সেটিই বোধ হয় একমাত্র সত্য আমাদের এমনটা মনে হওয়ার পিছনে কারণ বলতে গহীন অরণ্যের ভিতর এক জলায় তাদের সঙ্গে ক্রিস্তোবাল কোলোন-এর জাহাজটির মোলাকাত। ভিয়েরচি তার চরিত্রদের রোজকার জীবনের টুকরোটাকরার ভিতর দিয়ে নিজেদের যাত্রাপথ তৈরি করতে দেন বটে, তবে তা যেন ওই জাহাজটির এ মহাদেশের কূলে এসে নোঙর ফেলার এক বিশেষ মুহূর্ত থেকে বেরোতে পারে না কিছুতেই। লাতিন আমেরিকায় প্রতিদিনকার যে ইতিহাস রচিত হয়েছে আমাদের পড়বার জন্য, যে প্রতি দিনের কয়েক পাতা লোপাট করে দেওয়ার বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড-এ, সে ইতিহাস যেমন আলেহো কার্পেন্তিয়ের একটা বাড়ি ধ্বংসের পর গোটাগুটি ফের আগাপাস্তলা বানানোর বর্ণনায় তৈরি করেন একের পর এক ইঁট গেঁথে, ভিয়েরচি যেন বা তার চরিত্রদের আমাজনের বুকে দিকদিশাহীন ছেড়ে দিয়ে আবার তৈরি করেন আমাদের অ-পরিচিত মানুষ, অ-পরিচিত জলাভূমি আর রাত্রির সামনে এনে দাঁড় করান ইতিহাস লেখার, পড়ার চিরাচরিত চেনা কাঠামোগুলোকেই ভিত সমেত ওপড়াবার মতলবে। ভিয়েরচি’র উপন্যাসে কোনও সুস্থিত সময়ে কঠিন জমির ওপর দাঁড়াবার অবকাশ নেই। একে তো নদীনালায় সর্ব ক্ষণ নৌকার ওপর, তায় আবার মদ-টদ খেয়ে একাকার কারবার। তবে, তারা তো আর বাকিদের মতো শক্ত জমি খুঁজবার জন্য হিরের খনিও শক্ত জমি ভাই জলে ভাসেনি, যেমনটা, আমাদের জগতে, ক্রিস্তোবাল কোলোন থেকে শুরু করে আর প্রায় নামজাদা সব্বাই ভেসেছিল। |
|
|
|
|
|