|
|
|
|
দাপট হারিয়ে অনিলের ‘শত্রু’ সিপিএম-ই |
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় • চুঁচুড়া |
দলের নিচু তলার কর্মীদের একাংশের কাছে তিনি ছিলেন ‘রবিনহুড’। আর বিরোধীদের কাছে মূর্তিমান ‘আতঙ্ক’!
টানা সাত বার আরামবাগের সাংসদ থাকাকালীন সিপিএম নেতা অনিল বসুর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেনি বিরোধীরা। এমনই ছিল তাঁর ‘প্রতাপ’। কিন্তু দলই যে ‘দুর্নীতিতে প্রশ্রয়’ এবং ‘স্বজনপোষণের’ অভিযোগে এ ভাবে তাঁর ‘লাগাম’ টানবে, তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না অনিল-অনুগামীরা!
দলে ‘অসম্মানের জবাব’ দিতে যে অনিলবাবুকে শুক্রবার চুঁচুড়ার রবীন্দ্রভবন চত্বরে দেখা গেল, সেই অনিলবাবু এখন যেন অনেকটাই ‘মলিন’। ছিল না পরিচিত সেই ‘দাপট’ও।
১৯৬৭ সাল থেকে দীর্ঘ ৪৫ বছর এর উল্টো ছবিটাই দেখে এসেছেন আম জনতা। জীবনে এমন ঘূর্ণাবর্তে সম্ভবত এর আগে কখনও পড়েননি চুঁচুড়ার বাসিন্দা, সিপিএমের এই ‘দাপুটে’ বর্ষীয়ান নেতা।
১৯৬৭ সালে দলের ছাত্র সংগঠনে যুক্ত হন। দায়িত্ব পান ছাত্র সংগঠনের হুগলি-চুঁচুড়া শাখার সহ-সম্পাদকের। এর পর ১৯৭০ সালে দলের সদস্যপদ লাভ।
রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার অনুপ্রেরণা পান তাঁর বাবা সুধীর বসুর কাছ থেকে। সুধীরবাবু অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনিলবাবুর কথায়, “আমার বাবা অনুশীলন সমিতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তাঁকে দেখে রাজনীতি ছাড়া অন্য কিছুতে আকর্ষিত হওয়ার কোনও জায়গা ছিল না। তাই বাড়ি থেকেই আমার রাজনীতির পাঠ শুরু।”
‘মেঠো রাজনীতি’তে তাঁর দক্ষতা এবং বক্তৃতার সহজাত ক্ষমতা তাঁকে দ্রুত দলের নেতাদের কাছে বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা এনে দেয়। এই ‘মেঠো’ এবং ‘সহজাত’ বক্তৃতার জেরে একাধিকবার বিতর্কেও জড়িয়েছেন অনিলবাবু।
গত বছর বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কে ‘অশালীন’ মন্তব্যের জন্য দলের চাপে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করতে হয়েছিল তাঁকে। তবে তার মধ্যে সিপিএমের ভাবমূর্তির যা ‘ক্ষতি’ হওয়ার, হয়েই গিয়েছিল!
স্থানীয় রাজনীতি থেকেই জেলার বৃহত্তর ক্ষেত্রে উঠে আসা শুরু অনিলবাবুর। ক্রমে জড়িয়ে পড়েন দলের নানা শাখা সংগঠনের কাজে। কৃষিক্ষেত্রে চাষিদের নানা সমস্যার বিষয়ে জড়িত হয়ে ক্রমেই তিনি দলের কৃষক সভার কাজেও নেমে পড়েন এক সময়ে। এখনও তিনি দলের কৃষক সভার সর্বোচ্চ কমিটির সদস্য। এমনকী দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলী এবং রাজ্য কমিটির সদস্যও হয়েছিলেন
তিনি ইতিমধ্যে।
ভোটের ময়দানে অনিলবাবুর আত্মপ্রকাশ ১৯৭৮ সালে। সেই বছর তিনি হুগলি জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি হয়েছিলেন। জেলা পরিষদের নানা কাজে তাঁর ‘দক্ষতা’ প্রশংসিত হয়। টানা সাত বছর তিনি ওই পদ সামলান। ১৯৮৪ সালে আরামবাগ লোকসভায় দল তাঁকে প্রার্থী করে। তার পর থেকে পর পর সাত বার তাঁর জয়যাত্রা অব্যাহত থেকেছে। শেষ যে বার জেতেন, সেই ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে তিনি বিজেপি প্রার্থীকে প্রায় ৬ লক্ষ ভোটে হারিয়েছিলেন। যা এ দেশের ভোটের পরিসংখ্যানে ‘রেকর্ড’!
রাজনৈতিক জীবনে অনিলবাবুর কিছুটা খারাপ সময় গিয়েছে ২০০০ সালে। বিরোধীরা জাঁকিয়ে বসেছিল আরামবাগে। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছিল, অনিলবাবু কয়েক মাস খানাকুলে ঢুকতে পারেননি। সেই সময়ে খানাকুলের দু’টি পঞ্চায়েত সমিতি তৃণমূলের দখলে ছিল। এই পরিস্থিতি থেকে কার্যত একক দক্ষতায় গ্রামের পর গ্রাম থেকে বিরোধীদের ‘হটিয়ে’ দিয়ে তিনি মহকুমা থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের চমকাইতলা এবং বাঁকুড়ার কোতুলপুর পর্যন্ত ক্ষমতা কায়েম করেন।
খারাপ সময় আবার ফেরে ২০০৯ সালে। ওই বছর আরামবাগ লোকসভা আসনটি তফসিলিদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ায় তিনি আর প্রার্থী হতে পারেননি। তবু আরামবাগে তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দলীয় সংগঠন জিতিয়ে দেয় সে বারের সিপিএম প্রার্থী শক্তিমোহন মালিককে।
বিরোধীরা বলে থাকে, ‘অনিল বসু’ নামটা নাকি আসল নয়! কুখ্যাত একটি মামলার হাত থেকে রেহাই পেতে নাম ‘মানিক রায়’ নাম বদলে তিনি হয়েছিলেন অনিল বসু! সে সব প্রচারে অবশ্য এত দিন কোনও রকম আমল দেননি অনিলবাবু। কিন্তু সেই অনিলবাবুকেই এখন তোপ দাগতে হচ্ছে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে ‘কুৎসা-অপপ্রচারে’র বিরুদ্ধে!
রাজনীতির এমনই পরিহাস!
|
|
|
|
|
|