|
|
|
|
মানহানির মামলা করব বিমানের বিরুদ্ধে, হুমকি সস্ত্রীক অনিলের |
নিজস্ব সংবাদদাতা • চুঁচুড়া ও কলকাতা |
ক্ষমতাচ্যুত সিপিএমে ‘অ-কমিউনিস্টসুলভ বিচ্যুতি’র যে ‘প্রবণতা’ দেখা দিয়েছিল, এ বার তা আরও ঘোরালো পর্যায়ে পৌঁছল! শুক্রবার দলের বর্ষীয়ান নেতার স্ত্রী মানহানির মামলার হুমকি দিয়ে বসলেন সরাসরি রাজ্য সম্পাদকের বিরুদ্ধে!
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে স্থান না-পেয়ে প্রকারান্তরে হলেও প্রকাশ্যেই ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করেছিলেন দুই প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য এবং আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। তাঁদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে দলে তাঁর ‘অসম্মানের জবাব’ দিতে শুক্রবার সস্ত্রীক সাংবাদিক বৈঠক করে ফেললেন সাত বারের সাংসদ (গত বার হেরেছেন) অনিল বসু। যে বৈঠকে তোপ দাগা হল দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর বিরুদ্ধে।
‘কৌশলী’ অনিলবাবু সামনে এগিয়ে দিয়েছিলেন স্ত্রী সবিতাদেবীকে। তিনিই ছিলেন বেশি সরব। যদিও ‘বক্তব্য’ কার, তা স্পষ্ট। সবিতাদেবী বলেন, “আমি বিমানবাবুর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব! আমি চাই না, এর পর আমার স্বামী আর দলে থাকুন। কোনও দলে না-থেকেও মানুষের কাজ করা যায়। এ বার তা-ই করুন।” বস্তুত, অনিলবাবুর যে চিঠির প্রতিলিপি আজ সাংবাদিকদের মধ্যে বিলি করা হয়, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই চিঠিটি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে উদ্দেশ করে লেখা। তার প্রতিলিপি দেওয়া হয়েছে বিমানবাবুকে।
আপাতত আরামবাগের দাপুটে নেতা অনিলবাবুকে নিয়ে প্রশ্ন দু’টি।
প্রথমত, সিপিএম কি এ বার তাঁকে ‘বহিষ্কার’ করবে?
দ্বিতীয়ত, ‘বহিষ্কার’ করলে অনিলবাবু কী করবেন? তিনি কি দল ছাড়ছেন?
স্পষ্ট উত্তর এড়িয়ে গিয়ে প্রাক্তন সাংসদের জবাব, “যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেই নেব।” তবে ‘লক্ষণীয় ভাবে’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মা-মাটি-মানুষ’ স্লোগানের প্রসঙ্গ টেনে এক অনিল-অনুগামীর বক্তব্য, “দাদার সঙ্গে মানুষ আছেন, মাটিও আছে! তাই তাঁর কোনও ভয় নেই!”
সিপিএমের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, “অনিলবাবু নিজেই তাঁর বহিষ্কারের পথ প্রস্তুত করছেন!” তবে তা কবে হবে, তা স্পষ্ট নয়।
এমনিতে সিপিএম-ছুট নেতাদের প্রতি মমতার ‘দুর্বলতা’ সর্বজন বিদিত। তিনি কি অনিলবাবুকে দলে নেবেন? বিধানসভা ভোটের আগে এই অনিলবাবুই ‘কুৎসিত’ ভাষায় তৃণমূল নেত্রীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছিলেন। তৃণমূলের একাংশের মত, অনিলবাবুকে দলে নিলে এক দিক থেকে ‘ফায়দা’ হবে মমতার। তিনি দেখাতে পারবেন, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণকে তিনি রাজনৈতিক বিবেচনায় রাখেননি। সিপিএমের অনিলবাবু ‘শুদ্ধ’ হতে চেয়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।
মাসদু’য়েক আগে দলের রাজ্য কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয় অনিলবাবুকে। এর পর ‘দুর্নীতিতে প্রশ্রয়’ এবং ‘স্বজনপোষণে’র অভিযোগে গত রবিবার তিন মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। সে দিন অনিলবাবুর শাস্তির ব্যাপারে সিপিএম নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ খুলতে চাননি। বিমানবাবু শুধু বলেন, “অনিল বসুকেই এটা জিজ্ঞাসা করতে হবে।”
|
|
অন্দরের ক্ষোভ প্রকাশ্যে। চুঁচুড়ার রবীন্দ্রভবন চত্বরে সাংবাদিক
বৈঠকে সস্ত্রীক অনিল বসু। শুক্রবার। ছবি: তাপস ঘোষ |
এ দিন ‘জবাব’ দিতে চুঁচুড়ায় রবীন্দ্রভবন চত্বরে সাংবাদিক বৈঠক ডেকেছিলেন বসু-দম্পতি। তাঁর বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতিতে প্রশ্রয়’ এবং ‘স্বজনপোষণের’ নির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ নেই বলে দাবি করে অনিলবাবু বলেন, “দল থেকে বিবৃতি দিয়ে সেই অভিযোগে আমাকে সাসপেন্ড করার কথা জানিয়ে দেওয়া হল। আমি দলে আপত্তি জানাই। সাংবাদিকদের কাছে দলের তরফে ভুল স্বীকার করে ফের বিবৃতি দেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সেই আশ্বাস দল রাখেনি।” তাঁর আক্ষেপ, “অত্যন্ত হতাশ লাগছে। সাংবাদিকরা আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের জবাব বিমানবাবুর কাছে চেয়েছিলেন। তিনি অভিমুখ আমার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। গত ৪৫ বছর ধরে যা জেনে এসেছি, এখন তার উল্টো পথে চলেছেন বিমানবাবুরা! তাই ওঁর কথা মতো এখন আমি উত্তর দিতে বাধ্য হচ্ছি।”
অনিলবাবুর চেয়েও চড়া মেজাজে ছিলেন সবিতাদেবী। অনিলবাবু নন, তিনিই সাংবাদিকদের ডেকেছেন বলে জানিয়ে সবিতাদেবী বলেন, “আমার স্বামীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু কী সেই দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণ, তা বারবার বলার পরও দলের তরফে জানানো হয়নি। এতে পরিবারের সকলে অত্যন্ত অসম্মানিত বোধ করছি।” তিনি বলেন, “এই অন্যায়ের প্রতিবাদ না-করলে তা আত্মহত্যার সামিল হবে। জানি, প্রতিবাদ করলে খুন হয়ে যেতে পারি!” কারা খুন করবে? সবিতাদেবীর উত্তর, “যাঁরা কুৎসা রটাচ্ছেন, তাঁরাই।”
সস্ত্রীক অনিলবাবুর ‘নজিরবিহীন’ তোপের জবাবে এ দিন মুখ খোলেননি বিমানবাবু। তবে সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের বড় অংশই মনে করেন, অনিলবাবু এ বার তাঁর ‘বহিষ্কারে’র পথ প্রস্তুত করছেন! প্রথমত, দুর্নীতিতে প্রশ্রয়ের অভিযোগে দল ব্যবস্থা নেওয়ায় স্ত্রীকে পাশে নিয়ে অনিলবাবু যে ভাবে দলের রাজ্য সম্পাদককেই সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন, তা ‘গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গে’র পর্যায়ভুক্ত। অনিলবাবুকে রেয়াত করা না-হলে রেজ্জাক বা অমিতাভ নন্দীরাও প্রকাশ্যে দলীয় নেতৃত্বের দিকে আঙুল তোলার ক্ষেত্রে ‘সতর্ক’ থাকবেন। রাজ্য নেতৃত্বের একাংশের আশঙ্কা, অনিলবাবুরা পার পেয়ে গেলে সংগঠনের যে কোনও স্তরেই এ বার দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলার ‘প্রবণতা’ চেপে বসবে! |
|
হুগলি জেলা নেতৃত্বের কাছে অনিলবাবুর বিষয়ে আলিমুদ্দিন প্রাথমিক রিপোর্ট চেয়েছে বলেও দলীয় সূত্রের খবর। তেমন হলে তাঁকে আলিমুদ্দিনে তলব করাও হতে পারে। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “ওঁকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত রাজ্য সম্পাদক বা কেউ প্রকাশ্যে ঘোষণা করেননি! দলীয় মুখপত্রেও নোটিস দেওয়া হয়নি। তা হলে কুৎসা, অপপ্রচার এ সব প্রশ্ন আসছে কোথায়? কাউকে বহিষ্কার করলে তাঁর সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক থাকে না। তাই তা প্রকাশ্যে জানাতে হয়। সাসপেনশন তেমন বিষয় নয়। দল সব নিয়ম মেনে কাজ করেছে। সংবাদমাধ্যম কী ভাবে জানল, সেটা তাদের ব্যাপার!”
সিপিএম সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, রাজ্য কমিটির যে তদন্ত কমিশন অনিলবাবুর বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেয়, তারা হুগলি জেলার সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গেই কথা বলেছিল। সুতরাং, অনিলবাবুকে ‘অন্ধকারে’ রেখে কিছু করা হয়নি। বস্তুত, আরামবাগের প্রাক্তন সাংসদের বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতিতে প্রশ্রয়’ দেওয়ার অভিযোগ দু’বছরেরও বেশি পুরনো। দলীয় সূত্রের খবর, কয়েক বছর আগে ওষুধ কেনা নিয়ে দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগে জড়িয়ে গিয়েছিল সিপিএমের হুগলি জেলার কিছু নেতার নাম। তৎকালীন জেলা পরিষদের সভাধিপতি অসিত পাত্রকে (এখন ধৃত) পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই ঘটনায় রাজ্য কমিটির তিন সদস্যের তদন্ত কমিশনের ২০১০ সালের রিপোর্ট অনিলবাবুর বিরুদ্ধেই গিয়েছিল। রাজ্য কমিটিতে সম্প্রতি সেই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতেই অনিলবাবুকে সাসপেন্ডের সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়।
অনিলবাবুর এ দিনের ‘আচরণ’ নিয়ে হুগলি জেলা সিপিএম নেতৃত্বও মুখ খুলতে চাননি। জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, “অনিলবাবুর বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণের কোনও অভিযোগ আছে কি না, তা আমি দলের জেলা সম্পাদক হিসাবে বা ব্যক্তিগত স্তরে জানি না। তাই এ প্রসঙ্গে মতামত জানানোর কোনও জায়গা নেই। কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে রাজ্য স্তরে ব্যবস্থা নিতে গেলে জেলা নেতৃত্বের সুপারিশের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।”
অনিলবাবুর কথায়, “দলের তরফে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে, অসিত পাত্রের কাজকর্ম নিয়ে জানা সত্ত্বেও আমি দলকে অবহিত করিনি। কিন্তু কী প্রসঙ্গে, তা-ই স্পষ্ট করে বলা হয়নি। অন্য একটি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, জেলা পরিষদে আমি এক জনকে টাকা নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এই অভিযোগও অষ্পষ্ট। আমি কি টাকার কুমির যে লোককে টাকা বিলোব?”
সবিতাদেবীর আক্রমণের মূল লক্ষ্যই ছিলেন বিমানবাবু। তিনি বলেন, “দীর্ঘ ৪৫ বছর আমার স্বামী রাজনীতি করছেন। এ জন্য আমার সংসার অবহেলিত হয়েছে। বৃহৎ স্বার্থের জন্য সব এত দিন মেনে নিয়েছি। এখন বিমানবাবু ওঁর নামে মিথ্যাচার করছেন। ওঁকে হেয় করছেন! এ জন্য সংসারের ক্ষতি হচ্ছে। তাতে বিমানবাবুর কিছু এসে যায় না। তিনি সুদর্শন রায়চৌধুরীর মারফত নির্দেশ দিলেন, উনি (অনিলবাবু) যেন সাংবাদিকদের কিছু না বলেন। তাই বাধ্য হয়ে আমি আপনাদের ডেকেছি।” তাঁর আক্ষেপ, “দল না-করলেও সিপিএমকে ভালবাসতাম। কিন্তু এখন দল তলানিতে এসে ঠেকেছে। যে জায়গায় নেমে গিয়েছে, যে নীচতার আশ্রয় নিচ্ছে, তাতে আমি মনেপ্রাণে চাই না, উনি আর এই দলে থাকুন!”
|
পত্রে পাল্টা |
দলের অভিযোগ দুর্নীতি, স্বজনপোষণ
|
|
অনিলের জবাব |
• আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপোষণের বক্তব্য
প্রতিষ্ঠিত হবে, এ ধরনের নীচতা কী ভাবে সম্ভব? |
• রাজ্যে নেতৃত্বের স্তরে প্রতিহিংসার মানসিকতার
প্রতিফলন এই কুৎসিত প্রচার। |
• আমার বিরুদ্ধে যে চার্জশিট আপনারা দিয়েছেন,
সেই অভিযোগ হাস্যকর, অবাস্তব, ভিত্তিহীন। |
• নেতৃত্ব অদ্ভুত এক নীরবতা শুধু নয়, এমন মন্তব্য
করছেন, যাতে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়। |
• কমিউনিস্ট নৈতিকতা, আত্মমর্যাদা ও পার্টির স্বার্থেই
সাংবাদিকদের ডেকে তথ্যাদি পেশ করতে হবে। |
• কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল যে, সে মরে নাই।
হয়তো এই পরিণতি আমারও হবে। |
|
|
|
|
|
|