বিনা-টেন্ডারে সুশান্ত ঘোষ এবং এন্তাজ আলির এলাকা ভুক্ত সমবায়কে বরাত দিয়েছে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দফতর! দু’জনেই সিপিএমের ‘দাপুটে নেতা’। আর জ্যোতিপ্রিয় সেই তৃণমূল নেতা, যিনি সিপিএমকে ‘ঘৃণা’ করার ফরমান দিয়েছেন দলের
নেতা-কর্মীদের।
ঘটনাটা কাকতালীয় হলেও রাজ্য-রাজনীতির কারবারিদের কাছে ‘চমকপ্রদ’। ঘটনাটি ঘটেছে জ্যোতিপ্রিয়র দফতরের অধীন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ নিগমের মারফৎ। সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প (আইসিডিএস)-এর অধীনে রাজ্যের ব্লকগুলিতে ছ’মাস থেকে ছ’বছরের শিশুদের পুষ্টির জন্য বিনামূল্যে চাল-ডাল-তেল-নুন দেওয়া হয়। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে ওই কাজের দায়িত্ব পেয়েছে নিগম। কারা ওই দুই জেলার ব্লকগুলিতে শিশুদের পুষ্টির জন্য বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করবে, তা ঠিক করতে নিগমের টেন্ডার ডাকার কথা। কিন্তু তারা টেন্ডার না-ডেকেই পশ্চিম মেদিনীপুরের তিনটি সমবায়কে চাল-ডাল-তেল-নুন সরবরাহের বরাত দিয়েছে। ওই তিনটি সমবায় হল ‘গড়বেতা-৩ ব্লক এগ্রি পি মার্কেট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’, ‘কেশপুর কো-অপারেটিভ মার্কেটিং অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ সোসাইটি লিমিটেড’ এবং ‘বড়কলসি ভাঙা এসকেইউএস লিমিটেড’। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ হল, তিনটি সমবায়ই সিপিএম-পরিচালিত। তার মধ্যে গড়বেতার সমবায়টি সিপিএম বিধায়ক সুশান্তবাবু এবং কেশপুরের সমবায়টি এন্তাজের এলাকাভুক্ত। সুশান্তবাবু কঙ্কাল-কাণ্ডে প্রায় ছ’মাস জেলে কাটিয়ে আপাতত জামিনে মুক্ত। আর এন্তাজ কঙ্কাল-কাণ্ডে এখনও ফেরার। কেশপুরের প্রয়াত সিপিএম নেতা জামশেদ আলির ভাই এন্তাজ কেশপুরে একটা সময়ে ছিলেন ‘শেষ কথা’। গত বিধানসভা ভোটের পর অবশ্য তাঁকে এলাকা-ছাড়া হতে হয়েছে।
ঘটনাচক্রে, নিগমের চেয়ারম্যান রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়। সম্প্রতি যিনি দলীয় কর্মীদের প্রতি সিপিএমের সদস্য-সমর্থকদের ‘সামাজিক বয়কট’ করার ডাক দিয়ে ‘বিতর্ক’ উস্কে দিয়েছেন। যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে নিগম ঘটনাটিকে ‘ইতিবাচক’ বলেই দাবি করছে। তাদের মতে, ওই তিনটি সমবায় যে সিপিএম-পরিচালিত, তা না জেনেই (আসলে, বাছবিচার না-করেই) তাদের খাদ্য সরবরাহের বরাত দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের নতুন শাসকদল যে ‘দলতন্ত্র’ করে না, এই ঘটনায় তা-ই প্রমাণিত। তবে খাদ্য দফতর সূত্রের খবর, ওই সমবায়গুলি সিপিএমের হাতে জানতে পেরে জ্যোতিপ্রিয় নির্দেশ দিয়েছেন, যত সংস্থা খাদ্য সরবরাহের বরাত পেয়েছে, তাদের সকলকে নিজেদের পরিচালন সমিতির সদস্যদের নাম-পরিচয় (রাজনৈতিক পরিচয় সহ) সাতদিনের মধ্যে জমা দিতে হবে। পাশাপাশি, বিনা-টেন্ডারে ওই বরাত দেওয়ার পিছনে নিগমের যুক্তি, মাত্র সাত দিনের মধ্যে তাদের ওই বরাত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। না-হলে পশ্চিম মেদিনীপুরের যে শিশুদের বিনামূল্যে চাল, ডাল, তেল, নুন পাওয়ার কথা, তারা তা পেত না। সাতদিনের মধ্যে টেন্ডার ডেকে তা খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না জানিয়ে খাদ্য দফতরের এক সূত্র জানাচ্ছে, টেন্ডারের বিষয়টি চূড়ান্ত হতে অন্তত তিন-চার মাস সময় লাগে। নিগমের আরও যুক্তি, যে তিনটি সমবায় নিয়ে বলা হচ্ছে, সেগুলি জঙ্গলমহল এলাকায়। যেখানে অনুন্নয়ন এবং অপুষ্টির শিকার হয়ে জনতার একটা বড় অংশ বাম জমানায় ‘লালগড় আন্দোলন’-এ সামিল হয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে সেই জঙ্গলমহলে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি নিজে একাধিক বার জঙ্গলমহলে গিয়ে সেখানকার গরিব মানুষকে স্বল্প মূল্যে চাল, ডাল প্রভৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। এই পরিস্থিতিতে একদিনও সেখানে আইসিডিএস প্রকল্পের চাল, ডাল, তেল, নুন দেওয়া বন্ধ রাখলে সরকারের বিরুদ্ধে ‘বঞ্চনা’র অভিযোগ উঠত এবং ‘নৈরাজ্য’ তৈরি হত। ফলে ২০০৯ সালে যখন নিগম পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে ওই কাজ করেছিল, তখন তারা যে সংস্থাগুলিকে বরাত দিয়েছিল, তাদেরই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের পরিচালন সমিতি কোন দলের হাতে, তা দেখা হয়নি। খাদ্য দফতরের এক পদস্থ অফিসারের বক্তব্য, বরাতের মেয়াদ শেষ হবে ৩০ এপ্রিল। গোটা বরাতটাই মাত্র ১৩ দিনের! পরে আবার নিগম ওই কাজের দায়িত্ব পেলে অবশ্যই টেন্ডার ডেকে সরবরাহের বরাত দেওয়া হবে। |