তিন বছরের জন্য সুদ মকুব নিয়ে ‘চরমসীমা’ দেওয়ার পাশাপাশি এ বার সরকারের মধ্যে থেকে কেন্দ্রের উপরে চাপ বাড়াতে দলীয় সাংসদদের নির্দেশ দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সূত্রেই প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চাইলেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়রা। এই অবস্থায় চলতি বিতর্কের অবসানে আবার সক্রিয় হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
গত ২১ তারিখ মমতা জানিয়ে দেন, পশ্চিমবঙ্গের বকেয়া ঋণের উপর তিন বছরের জন্য সুদ মকুবের ব্যাপারে কেন্দ্র কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা নিয়ে আর পনেরো দিন অপেক্ষা করবেন তিনি। তার মধ্যে এই দাবি না মানা হলে আগামীতে তা ‘বড় ইস্যু’ হয়ে যাবে। পরে অবশ্য এই সময়সীমা নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সরকারকে ‘হুমকি’ দেওয়াটা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। কেন্দ্রকে চাপে ফেলতে তিনি চান না। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তফাতটাও কেন্দ্রকে বুঝতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে ৪ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসছেন মমতা। তাঁর দেওয়া ‘১৫ দিনের চরমসীমা’ শেষ হতে তখন আর দু’দিন বাকি থাকবে।
তার আগেই কেন্দ্রের উপরে ‘চাপ বাড়াতে’ দলের সব সাংসদকে নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। সেই মতো প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চেয়েছেন সুদীপবাবু। রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ের ঘরে এ দিন দলীয় নেতাদের আলোচনাও হয়। তার মধ্যেই ফোনে মুকুলবাবুর সঙ্গে কথা হয় মমতার। দলীয় সূত্রের খবর, মমতা তাঁর সাংসদদের জানিয়েছেন, প্রকাশ্যে কেন্দ্রকে হুমকি দিয়ে অস্বস্তিতে ফেলা হবে না। বরং সময় দেওয়া হবে। কিন্তু ইউপিএ-র ভিতরে থেকেই সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের উপর যতটা সম্ভব চাপ তৈরি করতে হবে। মনমোহন এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে সময় চাওয়ার প্রেক্ষিতেই দলীয় নেতৃত্বের আরও নির্দেশ, আগামিকালের মধ্যে রাজ্যসভা এবং লোকসভার সমস্ত তৃণমূল সাংসদ যেন নয়াদিল্লিতে পৌঁছে যান। যাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তৃণমূল তার ‘সর্বশক্তি’ নিয়ে হাজির থাকতে পারে।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক অবশ্য বারবার বলে আসছে, কোনও একটি রাজ্যকে এ ভাবে সাহায্য করায় সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, আর্থিক দায়বদ্ধতা ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে রাজ্য নিজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলে কেন্দ্রের পক্ষে তাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। ফলে বাজপেয়ী জমানায় যে ভাবে চন্দ্রবাবু নায়ডুকে ঢালাও আর্থিক প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল, তা এই ২০১২ সালে আর সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের সুদ মকুব করা হলে অন্য দু’টি ঋণ জর্জরিত রাজ্যও (পঞ্জাব এবং কেরল) একই দাবি জানিয়ে চাপ দেবে। তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় কর্তাদের বক্তব্য, রাজনীতিতে দল হারে-জেতে, কিন্তু প্রশাসন একই থাকে। তাই নতুন সরকারকে প্রাক্তনের সুফল এবং কুফল, দুইয়েরই দায় নিতে হবে।
কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, অর্থনীতির যুক্তি রাজনীতিতে সব সময় খাটে না। এখন মমতার দাবি না মানলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি বিরোধিতার পথে হাঁটবেন। তা সামলাতে এবং ইউপিএ-র বিভিন্ন নীতি রূপায়ণ করতে হলে মমতার দাবির প্রতি উদাসীন থাকা সম্ভব নয় কংগ্রেসের। তাই রফাসূত্র খুঁজছেন মনমোহন-প্রণব। আলোচনায় এমন প্রস্তাবও উঠেছে যে, দু’বছরের জন্য সুদ মকুব (যে হেতু আর দু’বছর পরেই লোকসভা নির্বাচন) করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখা হোক। এক্সপেন্ডিচার সেক্রেটারি সুমিত বসুর অধীনে একটি কমিটি গড়া হয়েছে। সেই কমিটি রাজ্যের ঋণের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
রাজ্যকে এখন প্রতি বছর সুদ দিতে হয় ১৫ হাজার কোটি টাকা। ওই সুদই তিন বছরের জন্য মকুব চায় রাজ্য। প্রধানমন্ত্রীকে তৃণমূল সাংসদরা বলবেন, খোদ প্রণববাবুই সংসদে মেনে নিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ দেশের তিনটি ঋণগ্রস্ত রাজ্যের মধ্যে প্রথমে। তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি মানতে কেন্দ্রের অসুবিধা কোথায়?
তবে এ ক্ষেত্রেও কেন্দ্রের আশঙ্কা, রাজ্য নতুন আয়ের উৎস তৈরি না করলে এবং ব্যয়সঙ্কোচের পথে না হাঁটলে সুদ মকুব করেও কাজ হবে না। |