জীবনের উপান্তে এসে ফের এক বার ধাক্কা খেলেন ওঁরা।
নিজের বাড়িতে ঠাঁই মেলেনি। বয়সের ভারে ‘সুখী গৃহকোণে’ বোঝা হয়ে ওঠায় জীবনের শেষ সম্বলটুকুও ছেড়ে আসতে হয়েছে অনেককে। অচেনা আস্তানায় যখন ক্রমেই মানিয়ে নিচ্ছেন ওঁরা তখনই গত বছর তিন ধরে সামান্য খাদ্য তালিকা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে দুধ, ডিম এমনকী মুড়ি-বাতাসার স্বাদটুকুও।
তিন বছর ধরে সরকারি অনুদান থমকে যাওয়ায় চন্দ্রনাথ বসু সেবা নিকুঞ্জ বৃদ্ধাশ্রমের জনা তেইশ আবাসিকের এখন ভাল করে খাবারও জোটে না। সরকারি অনুদান যখন নিয়মিত আসত তখন সাত সকাল শুরু হত, চা-বিস্কুটে। । প্রার্থনার পরে মুড়ি, চানাচুর, সঙ্গে কলা, কিংবা বাতাসা। দুপুরে ভাতের সঙ্গে সপ্তাহে এক দিন মাংস, দু’দিন ডিম এবং তিন দিন মাছ। রাতে রুটির সঙ্গে দুধ মিলত রোজই। কিন্তু ২০০৯-এর পর থেকে, সরকারি অনুদান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের খাবার তালিকা থেকে মুড়ি-বাতাসাও এখন প্রশ্নের মুখে। চানাচুর কিংবা কলাও বাড়ন্ত। দুপুরে ভাতের সঙ্গে সপ্তাহে দু’দিন মাছ দেওয়া হলেও ডিম বন্ধ। মাংস মাসে এক বার। অনেক সময়ে তাও জোটে না বলে অভিযোগ করছেন আবাসিকেরা। দুধও হারিয়ে গিয়েছে। বৃদ্ধাশ্রমের সুপার লক্ষ্মী মণ্ডল বলেন, ‘‘আশ্রম শুরুর দিন থেকে এখানে আমি রয়েছি। এতটা খারাপ সময় কখনও আসেনি। সরকারি অনুদান বন্ধ হয়ে আছে, পরিচালন সমিতি আবাসিকদের জন্য যৎসামান্য কিছু টাকা পাঠায়। তাতেই চলে কোনওক্রমে।” সেই টাকায় সারা মাস চালাতে গিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে আশ্রম কর্তৃপক্ষকে। লক্ষ্মীদেবী জানান, শেষ কবে ‘সাম্মানিক’ পেয়েছেন তাও মনে নেই। শচীন দাস, সন্ধ্যা দাস কিংবা যতীন সরকারদের মত আবাসিকদের কথায়, ‘‘খাবার আর আগের মত নেই। টাকার অভাবে অনেক কিছুই এখন বাদ গিয়েছে।’’ খবর পেয়ে সম্প্রতী ওই বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিলেন তেহট্টের মহকুমাশাসক অচিন্ত্যকুমার মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘‘ওই বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকরা সত্যিই খুব অসুবিধার মধ্যে আছেন। দিন কয়েক আগে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও কিছু সহৃদয় মানুষের সাহায্য নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকদের হাতে কিছু পোশাক তুলে দেওয়া হয়েছে। চক্ষু পরীক্ষা ও চিকিৎসারও ব্যবস্থা হয়েছে।’’ |
কিন্তু সরকারি অনুদান বন্ধ হয়ে গেল কেন? মহকুমাশাসক বলেন, ‘‘ঠিক কী কারণে অনুদান বন্ধ হল তা খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’ তেহট্টের বেতাই ডাঙাপাড়ায় ১৯৯২ সালে তৈরি হয় ওই বৃদ্ধাশ্রম। কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত এই বৃদ্ধাশ্রমে ২৫ জন আবাসিকের থাকার ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে সেখানে আবাসিকের সংখ্যা ২৩। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে সরকারি অনুদান বন্ধ। বিপাকে পড়েছেন পরিচালন সমিতি, বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিক ও আশ্রমের কর্মীরা। ১৯৯২ সাল থেকে নিয়মিত সরকারি অনুদান আসছিল তখন সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে আর সেই অনুদান আসেনি কেন? পরিচালন সমিতির সম্পাদক কলকাতার বাসিন্দা সুস্মিতা বিশ্বাস বলেন,‘‘ প্রতি বছরই কেন্দ্রীয় সরকারের সোশ্যাল জাস্টিস অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট দফতরে আমাদের কাগজপত্র পাঠাতে হয় কিন্তু গত কয়েক বছরে সরকারি নানা টালবাহানায় সেই কাগজপত্র ঠিকমত দিল্লিতে পৌঁছয়নি। সেই কারণেই আমরা সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।’’ বৈশাখের তপ্ত বিকেলেও বৃদ্ধাশ্রমের ঘরটা অদ্ভুতরকম ঠান্ডা টিমেতালে একটি পুরনো পাখা নিজের মত ঘুরছে। সার বেঁধে শুয়ে থাকা আবাসিকদের মাঝে জানালার পাশে একটি বিছানায় বসে খালি চোখে মাদুর বুনছিলেন ৭৫ বছরের সরলা বারুই। বাংলাদেশে শৈশব, কৈশোরের পর নদিয়ার দত্ত ফুলিয়ায় স্বামীর ঘর ঠিকানা বদলাতে বদলাতে এসেছিলেন। এখন ঠিকানা ওই বৃদ্ধাশ্রম। তিনি বলেন, ‘‘স্বামী ও এক মাত্র ছেলে দু’জনেই মারা গিয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে দুই মেয়েরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে তারা মাঝেমধ্যে এসে দেখা করে যায়। এখানে সকলের সঙ্গে দিব্যি দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল এখন শুনতে পাচ্ছি সরকারি অনুদান নাকি বন্ধ হয়ে গিয়েছে এই আশ্রমটাও যদি বন্ধ হয়ে যায় এই বয়সে যে আবার কোথায় যেতে হবে কে জানে!’’ |