যন্ত্রণার জগতে তোকে স্বাগত রে! আমাদের ক্লাবে স্বাগত। আরও বহু বার তুই কাঁদবি। এটাই খেলার সৌন্দর্য। তুই এখানে সব সময় জিততে পারবি না!
বক্তা পেপ গুয়ার্দিওলা। মঙ্গলবারই তাঁর কিশোর ছেলে প্রথম এসেছিল বার্সেলোনা ম্যাচে। হার দেখে ফেরার সময় ছেলে বা কোনও কিশোর সমর্থক কাঁদলে তাঁকে কী বলবেন? সাংবাদিক সম্মেলনে যন্ত্রণাবিদ্ধ বার্সা কোচকে প্রশ্ন করলে, তাঁর জবাব ছিল ওটাই।
ফুটবল যত দিন থাকবে, তত দিন গুয়ার্দিওলার এই হাহাকারের সংলাপও থেকে যাবে। আর নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখতে থাকা ২-২ ম্যাচটাও। ইতিহাস ও ইন্টারনেটের অন্তরে।
একটা চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক দলকে দশজনে কী করে বশ মানানো যায়, তা দু’বছর আগে দেখান হোসে মোরিনহো। এই চ্যাম্পিয়ন্স লিগেই। সে দিন ইন্টার মিলানের বল পজেশন ছিল ২৪ শতাংশ। বার্সেলোনার ৭৬। মেসিদের ২০টা শটের পাশে মোরিনহোর টিম শট নেয় ১ বার। তারই অ্যাকশন রিপ্লে দেখিয়ে চেলসি সম্মোহিত করল বার্সেলোনাকে।
বার্সেলোনার অন্ধকারময় সপ্তাহ, চেলসির সর্বকালের সেরা জয়। ইতিহাসের ম্যাচটা থেকে আরও দুটো সত্য প্রখর সূর্য হয়ে জ্বলবে বহু দিন। |
এক, শুধুই প্রচুর বল পজেশন রেখে ম্যাচ জেতা যাচ্ছে না। চেলসির বিরুদ্ধে দুটো ম্যাচেই মেসি-জাভি-ইনিয়েস্তার বল পজেশন ছিল ৭২ শতাংশ। রিয়াল মাদ্রিদ ম্যাচে ছিল ৬৬-৩৪। তাতে লাভ কী? দুই, বিশ্ব ফুটবলের ধারা মেনেই বার্সেলোনার জয়চক্রে মরচে ধরতে বসেছে। মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা তিন সূর্যের ফুটবলেই ক্লান্তি ও একঘেয়েমির দাগ এখন। গুগল সার্চে ইউরোপিয়ান ফুটবলের ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে ক্লাবের সাফল্য ঢেউয়ের মতো উঠে মিলিয়ে গিয়েছে। পঞ্চাশের দশকে রিয়াল, ষাটের দশকে ইন্টার। সত্তরে আয়াখস, বায়ার্ন। আশির দশকে লিভারপুল, মিলান। নব্বই দশকে মিলান, রিয়াল। নতুন শতাব্দীতে মিলান, ম্যাঞ্চেস্টার, বার্সেলোনা।
এ বার আরও কেউ আসবে।
পাসের লাবণ্য দেখিয়েও বিশ্বের এক নম্বর দল তলিয়ে গেল কেন? প্রধানতম কারণ, ‘প্ল্যান বি’ নামক কোনও বস্তুর অভাব। সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসবে পাঁচটা কারণ।
১) এটো, ইব্রাহিমোভিচ চলে যাওয়ার পরে বার্সার কোনও সেন্ট্রাল স্ট্রাইকার নেই। এত পাস খেলে অ্যাটাকিং থার্ডে উঠে গোল করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। ছোট ছোট পাসে এগোতে সময় লাগছে এবং বিপক্ষ গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেদের। দুটো ম্যাচ মিলিয়ে বার্সেলোনার পাসের সংখ্যা ১৫৩৭ (৭৮২ ও ৭৫৫), চেলসির ৩২৯ (১৯৪ ও ১৩৫)। একা জাভিই চেলসির থেকে বেশি পাস খেলেছেন। তাতে হলটা কী?
২) দাভিদ ভিয়ার অনুপস্থিতি ঢাকা যাচ্ছে না। সামনে প্রচুর উইঙ্গার খেলাচ্ছেন গুয়ার্দিওলা। পেদ্রো, থিয়াগো, আলেক্সিস। কেউ ভিয়ার মতো গোল চেনেন না। কেউ রোনাল্ডিনহো, ডেকো, এটো নন যাঁদের তাড়িয়েছিলেন গুয়ার্দিওলা।
৩) গুয়ার্দিওলা নিজেই। তিনি কি ফুটবল বিপ্লবী হতে চাইছেন? সাড়ে তিন বছরে ১৩টা ট্রফি জিতে বার্সা কোচ ঘনঘন প্রথম এগারো বদলাচ্ছেন এখন। রাইনাস মিশেলস, জোহান ক্রুয়েফের মতো আমিও নতুন বৈপ্লবিক কিছু করে দেখাব এই ভাবনা তাঁর দল গঠনে গণ্ডগোল করে দিল শেষ তিনটে ম্যাচে। ক্রুয়েফের জন্মদিনের আগের দিন এত বড় ম্যাচে আনকোরা কুয়েঙ্কাকে নামানোর কী মানে? কী মানে আদ্রিয়ানো বা থিয়াগোকে না ভেবে তেলোকে নামানোর? ৩-৪-৩ ছকে দানি আলভেসকে প্রথমে বসিয়ে রাখার কারণও দুর্বোধ্য। লন্ডনের ম্যাচেও গুয়ার্দিওলা উল্টোপাল্টা বদলেছিলেন। রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হারের দিন শুরুতে চমকে দিয়ে খেলান তরুণ তেলোকে। তাঁর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দলেও প্রভাব ফেলেছে দেখা গেল ১-২ হওয়ার পরে। ওটাই টার্নিং পয়েন্ট।
৪) জাভি, ইনিয়েস্তা, মেসি হয় ক্লান্ত, না হয়, সব কিছু পাওয়ার তৃপ্তিতে আচ্ছন্ন। অতীতে ৭টা পেনাল্টি নষ্ট করেছেন মেসি। মঙ্গলবার বড় তাড়াহুড়ো করেই বারে মারলেন পেনাল্টি। ওই তিনজনের স্টাইলও ধরা পড়ে যাচ্ছে। ফ্রি-কিক, কর্নারেও পুরনো তীক্ষ্ণতা নেই। সাপোর্টিং প্লে একেবারে ভাল না হওয়ায় ওপেন স্পেস হল না।
৫) ভিয়ার অভাব যদি অ্যাটাকিং থার্ডে টের পাওয়া যায়, ডিফেন্সিভ থার্ডে ভোগাল আবিদালের অনুপস্থিতি। প্রতিআক্রমণ সামাল দিতে আবিদাল অনেক জায়গা নিয়ে ট্যাকল করতেন। ম্যাকালেলে যা করতেন রিয়ালে।
চেলসির ওই রক্ষণ করে যাওয়া ফুটবলকে অ্যান্টি ফুটবল বলবেন? কেন? ৫২ মিনিট তারা খেলল টেরি-হীন দশজনে, দুই সেরা স্টপার মাঠের বাইরে, ইউরোপের বৃহত্তম স্টেডিয়াম তাদের ধ্বংস দেখার জন্য পাগল এই প্রেক্ষাপটে চেলসির রক্ষণ করে যাওয়া দু’চোখ ভরে দেখতে হচ্ছিল। বার্সেলোনাকে হারানোর প্রথম শর্ত ছিল, দশজনকে সব সময় বলের পিছনে রাখতে হবে। গেরিলা যুদ্ধের স্টাইলে ওই ভাবেই তারা খেলল। বিশ্বের সেরা লেফট ব্যাক অ্যাশলে কোলে ও ম্যাচের সেরা র্যামিরেজের নেতৃত্বে। দশজনের দলের সিস্টেমটা দাঁড়াল ৫-৪-০। বার্সেলোনার অ্যাটাকিং থার্ড চত্বরটা এমন ভাবে পাহারা দিল, শট নেওয়াই যাচ্ছিল না। সিয়েরা লিওন থেকে জিবুতি, লিচেস্টাইন থেকে ভানুয়াতুভবিষ্যতে সব দেশের কোচরা এই ম্যাচের সিডি প্র্যাক্টিসে দেখাতে পারেন। দশজন হয়ে গেলে কী ঢংয়ে ফেভারিটদের আটকানো যায়, এই শিক্ষা দিতে।
ওহ, সঙ্গে যোগ করুন তিন টাচে প্রতিআক্রমণে গোল করার শিক্ষা। ব্রাজিলিয়ান র্যামিরেজের চিপ, স্প্যানিশ তোরেসের মসৃণতা চেলসির দুটো গোল বিদ্যুৎশিখার মতো চোখ ঝলসে দেয়। দুটো ম্যাচে চেলসি (১২) বার্সেলোনার (৪৬) চেয়ে গোলে শট নিয়েছে অনেক কম। তবু লন্ডনে ১-০-র পরে বার্সেলোনায় ২-২। বেশি গোল চেলসিরই। কার্ডের জন্য ফাইনালে তাদের চার তারকা (টেরি, ইভানোভিচ, রামিরেজ, মেইরিলিস) নেই, তবু চেলসির কাপ তো নৌ কাম্পেই জেতা হয়ে গিয়েছে!
চেলসির কোচ রবের্তো দি’মাতিও গুয়ার্দিওলার থেকে মাস কয়েকের বড়। গুয়ার্দিওলার মতোই নামকরা মিডফিল্ডার। জন্ম সুইৎজারল্যান্ডে, দি’মাতিওর বড় হওয়া ইতালিতে। ঘটনাচক্রে বিশ্বের সবচেয়ে দুটো রক্ষণাত্মক ফর্মেশনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ওই দুটো দেশের নাম। সুইস বোল্ট সিস্টেম এবং কাতানেচিও। বড় দলকে বিপদে ফেলতে ম্যান মার্কিং ও জোনাল মার্কিং মিশিয়ে বোল্ট সিস্টেমে খেলত ছোট দল। আরও আধুনিক কাতানেচিও সিস্টেম সৃষ্টির পিছনে ছিল বোল্ট।
শুনলাম, মোরিনহো তাঁর পুরনো দলের ছাত্রদের এস এম এস পাঠিয়েছিলেন, “তোমরা বার্সেলোনাকে হারাবে। দেখা হবে মিউনিখে।” মোরিনহোর প্রাক্তন সহকারী রুই ফারিয়া-ও ছক এঁকে বুঝিয়েছিলেন দি’মাতিওর টিম ম্যানেজমেন্টকে কী ভাবে থামানো যায় বার্সেলোনাকে। কিন্তু সব ছকেরই উৎস মুখ বোল্ট সিস্টেম আর কাতানেচিও। দি’মাতিওর দুই দেশ।
দি’মাতিও কে? এত দিন সেরা পরিচয় ছিল, রুদ খুলিতের সুপারিশে চেলসিতে রেকর্ড অর্থে আসা ফুটবলার। তিন বছরে চারটে ট্রফি জিতে চেলসির সর্বকালের সেরা দলে ঢুকে যাওয়া মুখ। এ বার পরিচয় অন্য ভাবে লিখতে হবে। কী বলা যায়? স্বাগত, নতুন মোরিনহো! |