|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
এখনও সেই ফুল, ধানখেত, আর সম্পর্কের উনিশ-বিশ! |
শুধু মিঠে টুংটাং! যেন কোথাও কোনও রাগ নেই, তিক্ততা নেই, সন্তর্পণে গালিচার নীচে চালান
করে দেওয়া ‘অসুস্থ’ ভাবভাবনা নেই! এই তো বাংলা ছবির ছাঁচ। লিখছেন
কৌশিক মুখোপাধ্যায় |
সাম্প্রতিক কালে বাংলা ছবি নিয়ে একটা আলোড়ন তৈরি হয়েছে। কেন হয়েছে, তার মধ্যে কী কী আছে, নতুন করে তার ফিরিস্তি দেওয়া অর্থহীন। কিন্তু, এই সূত্রে কিছু কথা মনে করে নেওয়া ভাল।
কী মনে করব?
পরিপ্রেক্ষিত।
সন্দেহ নেই, ‘পরিপ্রেক্ষিত’ শব্দটা বাঙালির খুব প্রিয়। শুনতে মিঠে, আবার বেশ ভারীও, শুনলে হুট করে বক্তার প্রতি সম্ভ্রম বেড়ে যায়। আমি বাংলা ছবির পরিপ্রেক্ষিতটা একটু ভেবে দেখতে চাইছি। হালফিল বাংলা ছবিতে বেশ একটা শিল্পিত আবহ তৈরি হয়েছে। সাজানো, গোছানো, ছোটে না কি হাঁটে না, বোঝা কঠিন, কিন্তু নিঃসন্দেহে, কাউকে সে কাটে না। বেশ সুরভিত, অ্যান্টিসেপটিক লাগানো চেহারা! আমি বলতে চাই, এটা কিন্তু খুব নতুন কিছু নয়। এই নিরাপদ ছাঁচটাই বাংলা ছবির পরিপ্রেক্ষিত!
শোনামাত্র কয়েকটি নাম উঠে আসবে। সঙ্গে বেশ কয়েকটি সিনেমার নাম। কে জানে, বুকের ভেতরে কোনও সত্যি কথা লেখা থাকে কি না! বা থাকলেও, সর্বসমক্ষে তাকে কবুল করা যায় কি না। কিন্তু, এটুকু অন্তত জানি যে, অনেকের বুকের ভেতর এ কথা লেখা আছে যে, আমাদের মধ্যে দিয়েও এক কালে সত্তরের দশক গিয়েছে! এই পশ্চিমবঙ্গেই। সেই আগুনমুখো সত্তর চাবকে দিয়েছে আশপাশ! চোখ রাঙাতে শিখিয়েছে!
আবার, আমাদের (কারও কারও) বুকের ভেতর এ কথাও লেখা আছে যে, আসলে যতটা রাগ উঠে আসার কথা ছিল সেই সময়ের এবং তার পরের বাংলা সিনেমায়, ফিল্মের ভাষা যতটা দুমড়ে যাওয়ার কথা ছিল, তার ভগ্নাংশও হয়নি। অথচ, তখন কত অজস্র বাঙালি সে আগুনের কাছে ঘুরঘুর করেছিল। অনেকে স্পষ্টতই হাতও পুড়িয়েছিল, এবং আগুনে হাত রাখলে কী হতে পারে, তা ভেবেচিন্তেই হাতটা বাড়িয়েছিল!
মজা এই যে সেই পোড়া হাতটা কি সে ভাবে বাংলা ছবিতে উঠে এল? তার ওই দগদগে ঘা-সমেত? পুঁজের দাগ, গুলিয়ে ওঠা গন্ধ কি সে ভাবে টের পেলেন কেউ? পেলেন না। পেলেনই না!
কারণ, আমরা নাকি ‘শিল্প’ করছি! যেখানে নাকি একটা অদৃশ্য লক্ষ্মণরেখা টেনে রেখেছে কারা সব। যেন এক বেগদাও বেফাঁস না হয়। হলেই যেন জাত যাবে। এবং, এটাও নির্জলা সত্যি যে, বাংলা সিনেমা কখনওই এই জাত হারাতে চায়নি। |
|
অ-সুস্থ! কৌশিক মুখোপাধ্যায়ের ‘গান্ডু’ ছবির একটি দৃশ্য। |
তা হলে, বাঙালির প্রিয় ছবি না, বই হবে কেমন? পরিষ্কার, সাফসুতরো, শুদ্ধ, শুচি, সব্বাই এক সঙ্গে বসে গরমের ছুটি কাটানো যেন। অনেকটা মিষ্টি বিরামহীন জলতরঙ্গের মতো। সেটাই নাকি ‘সুস্থ’ বিনোদন। সারা ছবিতে কোথাও কোনও পিন নেই যে সাংঘাতিক ভাবে ফুটে রক্তারক্তি করে দেবে। ফিল্ম তো বিনোদন, ‘মেক-বিলিভ’! তার তো ভাবানোর কথা নয়। রাস্তায় হোঁচট খেলে পাথরের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে কাঁচা গালিগালাজ করতে পারি, বাড়িতে কাজের মহিলাকে দেখতে পারি ঘন ঘন, আড়চোখে, কিন্তু সিনেমা বানানোর অথবা দেখার সময় ধানখেত, পলাশ ফুল, এবং সম্পর্কের উনিশ-বিশ। এই তো সেই বাংলা ছবির চিরকেলে পরিপ্রেক্ষিত!
যেন জীবনে কুৎসিত, ‘বিলো দ্য বেল্ট’, অশ্লীল, অস্বস্তিকর, পাপ-টাপ বলে কিছুই নেই। বা, থাকলেও, সে সবের ছবির পর্দায় আসা মানা। আহা, মধ্যবিত্ত ‘মূল্যবোধ’ ঠোক্কর খাবে যে! বাঙালির এই আর একটি অমোঘ শব্দ, মূল্যবোধ! কিন্তু, ‘মূল্যবোধ’ যে কার, এবং যাঁর মূল্যবোধ, তিনি নিজে কী অবস্থানে আছেন, সে সবও তো ভেবে দেখার বিষয়।
আসলে, সে সবই ভেবে দেখার বিষয়। ভাববে কে? ভাববে কেন?
সত্যিই তো, কেন ভাববে? মূল্যবোধ তা-ই, যাহাকে মধ্যবিত্ত ‘ভদ্র’ বাঙালি ‘মূল্যবোধ’ বলে মনে করে। ইহা সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা সত্য। বাকি সব, ন’কড়া ছ’কড়া! বাকি সব অশ্লীল! অ-সুস্থ!
হুতোম নাকি পড়া আছে আমাদের? কী জানি, কোন সংস্করণ ছিল সেটা! আজকাল শুনি, ‘আরবান’ সিনেমা, মানে নাগরিক ছবি (নগরের ছবি, তাই ‘নাগরিক’) নামে একটি জিনিস খুবই চলছে।
অথচ, শহর মানে যে শুধু ঝকঝকে উড়ালপুল, তার দু’ধারে সারবাঁধা মিঠে আলোটুকুই নয়, সেই উড়ালপথের নীচে অন্ধকার, তার ক্লেদ, ময়লা, মুখখিস্তি সে সবও নির্জলা মহানগর এই সহজ কথাটা এখনও বাংলা ছবির মগজে ঢুকল না। মগজে কারফিউ, নিষেধ বেরোনো! বেরোলেই ভয়, পাছে সেই তলার দিকের কথা উঠে আসে! সেই তথাকথিত নিচু-তলার মানুষদের রাগ, গোলাপ ফুল, লোভ সবটাই তো শহরেরই অঙ্গ। সেগুলো আমরা হল-এ গিয়ে দেখব না কেন? মোট কথা, মুখের ওপর যে ‘সত্যি’গুলো রোজ রোজ ঝামরে পড়ছে, সেগুলোর ছবি কেউ তুলে রাখবে না কেন?
সেন্সরের কাঁচি তো পরের জিনিস, তার আগে আমাদের মনের মধ্যেই ক্রমাগত ‘বিপ’ শব্দ। এ দিক ও দিক। এটা দেখতে নেই। ওটা দেখাতে নেই। ছি, ও সব বলে নাকি!
আমরা জানি, বলে। আমরা এও জানি, আমাদের ‘সংস্কৃতি’-তে এ সব ঢোকা বারণ!
আমরা বেশ মনের মতো করে একটা বিরাট কাচের ঘর বানিয়ে ফেলেছি। তাতে নানা রকম তাক আছে। যে তাকে যা, তা সেখানেই থাকবে। চিরকাল। ধরা যাক, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। কমেডি করে, বাঙাল কথা বলে লোক হাসায়। পিরিয়ড। অথচ ভদ্রলোক যে অত বড় স্যাটায়ারিস্ট ছিলেন, সে আমলে বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ে ৪০,০০০ টাকা দিয়ে একা হাতেই একটা ফিল্ম বানিয়েছিলেন, সে সব না জানলেও চলবে।
যেই একটু গুলিয়ে যাবে, তক্ষুনি সেটিকে আর্ট ফিল্ম বলে দাগিয়ে দেব। আরে, একটু খুঁচিয়ে দেখাই যাক না, কী বলতে চায়। হয়তো দরকারি কিছু একটা বলছে। বা হয়তো কিছুই বলছে না। হয়তো স্রেফ কিছু ইমেজ দেখাতে চাইছে, যা থেকে আমিই তৈরি করে নেব আমার গল্প। কিন্তু, অত পরিশ্রম কি ধাতে সইবে?
বাংলা ছবির তথাকথিত পুনর্জন্মের সময়ে এই কথাগুলো একটু মনে করা ভাল।
ভুলতে আর কতক্ষণই বা লাগে? |
|
|
|
|
|