ঠিক পনেরো দিন সময় দিচ্ছি। তার মধ্যে টাকাটা যেন ট্রান্সফার হয়ে যায়। নইলে... কী, মনে হচ্ছে এটি কোনও বনপ্রান্তে মাওবাদীদের হাতে বন্দি কোনও ছোকরা সরকারি অফিসারের প্রতি হুংকার? না, ঠিক তা নয়, তবে হতেও পারত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারকে ঠিক সহিংস ভয় দেখাননি। এখনও দেখাননি।
তবে যা তিনি নিজে দাবি করেছেন, এবং তাঁর অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে দিয়ে বলিয়েছেন, তা হল এই যে,
ক) রাজ্যের ঘাড়ে চাপানো পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের অর্থনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতার ফল হচ্ছে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকার ঋণের বোঝা, যার আসল ও সুদ বাবদ রাজ্যকে ফেরত দিতে হচ্ছে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা। তিন বছরের জন্য এই ঋণ বাবদ রাজ্যকে অব্যাহতি দেওয়া হোক, এবং
খ) বর্তমান দেনার বোঝাটি দশ বছরব্যাপী সময়কালের মধ্যে পুনর্বিন্যস্ত করা হোক। তার মধ্যে কিছু ধার মকুব হোক, কোথাও কমানো হোক সুদের হার।
পনেরো দিন কেন? কারণ, যে দিন থেকে এই ‘হুঁশিয়ারি’, মতান্তরে ‘আর্জি’ উচ্চারিত হয়, তার ঠিক পনেরো দিনের মাথায়, অর্থাৎ ৪ মে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে দেখা করবেন।
বর্তমান প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাচনভঙ্গির বিশ্লেষণ নয়, যদিও সে বিষয়ে তাঁর স্বকীয়তা অনস্বীকার্য। বর্তমান আলোচনার বিষয়: এই বেপরোয়া ঋণবৃদ্ধির কারণ কী? কেন্দ্রের পক্ষে কি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বিশেষ ঋণ-ছাড় দেওয়া সম্ভব? এবং কেন্দ্র যদি রাজ্যকে সাধ্যাতিরিক্ত সাহায্যদানে বিরত থাকে, তবে কী হতে পারে তার প্রতিক্রিয়া?
ব্যক্তিজীবনের মতোই, সরকারি রাজস্ব পরিচালনার ক্ষেত্রেও সচরাচর ঋণবৃদ্ধির বড় কারণটি হচ্ছে পূর্বকৃত ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা। পরিশোধ ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়েও ঋণগ্রহণে সক্ষম একমাত্র কোনও সার্বভৌম রাষ্ট্র, বিশেষ করে তা যদি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রতাপশালী। কিন্তু ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হয়ে কোনও রাজ্যের পক্ষেই অবাধ ঋণগ্রহণ কেন্দ্রের পক্ষে চিরকাল বরদাস্ত করা সম্ভব নয়।
ঠিক সেই কারণেই ২০০৩ সালে কেন্দ্র প্রণয়ন করে দায়িত্বশীল রাজস্ব আয়ব্যয় ও বাজেট পরিচালনা (ফিসকাল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট) সংক্রান্ত আইন। বাজেটের ঘাটতিগুলি প্রথমে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সীমাবদ্ধ করে ক্রমশ রাজ্যগুলির মোট দেনা তাদের মোট উৎপাদনের একটি নির্দিষ্ট অনুপাতের মধ্যে বেঁধে রাখা এই হল আইনটির লক্ষ্য। এই চুক্তিগুলি পূরণ করতে যে-সব রাজ্য রাজি, তাদের অল্প হলেও কিছুটা ঋণ মকুব হয়। তা ছাড়াও সাহায্য করা হয় ঋণ পুনর্বিন্যাসে, যেমন অল্প সুদের ঋণ নিয়ে বেশি সুদের ঋণ মিটিয়ে ফেলা। |
পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার কিন্তু ওই আইন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। লোকদেখানো কারণ: ওটি হচ্ছে রাজ্য অর্থনীতিতে ‘নব্য উদারবাদী’ হস্তক্ষেপ। আসল কারণ, সিটুর চাপে এবং একটি কল্পিত শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে আত্মীকরণের দরুন বামফ্রন্ট সরকার কোনও ভাবেই কর্মচারীদের বেতনের ব্যয়ভার কমাতে রাজি হয়নি। ২০০০-২০০১ সালে (বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম বছর) মোট রাজস্ব ব্যয়ের ৪৩.৪ শতাংশ খরচ হয়েছে শুধু কর্মচারী বেতন বাবদ। তাঁর শেষ পূর্ণ বছরে (২০১০-১১) অনুপাতটি ছিল ৩৬.৩ শতাংশ। শুধু বেতন কমিশন বাবদ এই খাতে বরাদ্দ বেড়ে গেছে বলে লাভ নেই, কারণ কর্মচারী-বাহুল্য সামলাতে কোনও কার্যকর পদক্ষেপই বামফ্রন্ট সরকার নেয়নি তাদের শাসনকালে, বরং যা নিয়েছে, তা ভুল বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ। যেমন, হাসপাতালে ডাক্তার থাকুক বা না-থাকুক, অবিরাম চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী নিয়োগ করে চলা। ২০১০-১১ সালে বেতন ও ঋণের উপর সুদ, এই দুই খাতে খরচ হয়েছে মোট রাজস্ব ব্যয়ের ৭৮.২৬ শতাংশ।
সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিজস্ব কর রাজস্ব বাড়াতে বামফ্রন্টের চরম ব্যর্থতা। রিজার্ভ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১০-১১ সালে সাধারণ তালিকাভুক্ত ১৭টি রাজ্যের মধ্যে নিজস্ব কর রাজস্ব (Own Tax Revenue) ও রাজ্য মোট উৎপাদনের অনুপাতের হিসাবে সর্বনিম্ন স্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। এই ও টি আর-এর এক বিশিষ্ট উপাদান হল বিক্রয় কর, যা অধুনা ভ্যাট-এ রূপান্তরিত। ওটিই রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু রাজ্যে শিল্পোৎপাদন গোল্লায় যাওয়ার দরুন বিক্রয় কর থেকে আয়ও যৎসামান্য।
বামফ্রন্ট অন্যান্য রাজ্যের মতো ২০০৫ সালেই যদি এফ আর বি এম মেনে নিতেন, তবে সেই সঙ্গে মানতে হত একটি বিশেষ শর্ত। প্রতি বছর মোট রাজ্য উৎপাদনের তুলনায় রাজস্ব ঘাটতি (রাজস্ব ব্যয় এবং রাজস্ব আয়ের ফারাক) কমাতে হত ০.৫ শতাংশ হারে। এটা ও অন্যান্য শর্তাবলি মেনে নিয়েই কিন্তু বেশ কয়েকটি রাজ্য তাদের মোট উৎপাদনের তুলনায় ঋণভার কমিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ২০০৫ থেকে ২০০৮-এর মধ্যে বিহারের অনুপাত ছিল ৫১.৯ শতাংশ, ২০১০-১১-তে তা নেমে এসেছে ৩৯.৫ শতাংশে। কিন্তু মতাদর্শের দোহাই পেড়ে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত ওই আইন মেনে নেয়নি।
অবস্থা পাল্টাল ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের দুর্দশা দেখে। হয়তো তখনই ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয় অবধারিত জেনে সি পি এম রাজ্য সম্পর্কে ‘পোড়া মাটি’ নীতি গ্রহণ করে। ২০১০ সালে তারা সই করে এফ আর বি এম আইনে। সেই মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল রাজ্যের পক্ষে ইচ্ছা অনুযায়ী ঘাটতি সমেত বাজেট পাশ করানোর ক্ষমতা। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত পুরোপুরি বাঁধা। তিনি অবশ্য চেষ্টা করতে পারেন নিজস্ব কর-সংগ্রহ বাড়াতে, বা নিষ্কর্মা বেতনভোগী তাড়াতে। কিন্তু তার ফলও পাকতে বেশ কয়েক বছর। সেই জন্যই ঋণের জাল থেকে তিনি আপাতত মুক্তি চাইছেন।
কেন্দ্র কি কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারে এই রাজ্যের জন্য? এ সম্পর্কে বর্তমান অর্থ কমিশনের (ত্রয়োদশ, ২০১০-১৫) নতুন করে দেয় কিছু নেই। কিছু ঋণের পরিশোধ-কাল বাড়ানো, সামান্য কিছু ঋণ মকুব ও কোনও ক্ষেত্রে সুদের হার কমানো এ সব বামফ্রন্টের শেষ বছরেই চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও পঞ্জাব, ঋণভারে জর্জরিত এই ত্রয়ীর জন্য কেন্দ্রের কি কোনও বিশেষ ব্যবস্থার পরিকল্পনা আছে? সঙ্গত ভাবেই রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র গ্রিসের উদাহরণ দিয়েছেন। সে দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে আগামী মাসে যে নির্বাচন হতে চলেছে, তাতে যে-ই জিতুক, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে হাতে হাতে ১৩০ বিলিয়ন, অর্থাৎ তেরো হাজার কোটি ডলার ইউরো ঢালতে হবে গ্রিসকে বাঁচাতে।
ভারতের চিন্তাধারা কিন্তু নিছক আমলাতান্ত্রিক। গত বছর ওই তিন রাজ্য কেন্দ্রের কাছে ঋণের ব্যাপক ছাড় ও পুনর্বিন্যাসের জন্য অনুরোধ করে। বিশেষ করে পঞ্জাব জনসংখ্যার হিসাবে যার ৬৯০০০ কোটি টাকা ঋণদায় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে প্রায় তুলনীয় জানায়, এটি আশির দশকে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদ ও আতঙ্কবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামেরই ফল। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এই ব্যাপারটি পর্যালোচনা করতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গড়ে দেন, যার শীর্ষে ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যয় সচিব (পরে অর্থ সচিব) সুষমা নাথ। আবেদন সরাসরি নাকচ করে দিয়ে নাথ কমিটি লিখেছে, এটি এক ‘খারাপ নজির’ তৈরি করবে, যা শুরু করতে পারে রাজস্ব পরিচালনায় বিশৃঙ্খলা (‘এনকারেজিং ফিসকাল মিসম্যানেজমেন্ট’)। এই কমিটিকেই দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের আবেদন বিচার করার দায়িত্ব। এই ‘বড়বাবু’র মনোভঙ্গি দিয়ে মনে হয় না কেন্দ্র এগোতে পারবে। ফলে, ৪ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা নিষ্ফল হওয়ার সম্ভাবনা সমধিক।
তাঁর ‘আল্টিমেটাম’ ব্যর্থ হলে সেটি ঘটবে এমন এক সময়, যখন সর্বত্র কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক অগ্নিগর্ভ। কোষাগারের অবস্থার তোয়াক্কা না রেখে একের পর এক শিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার প্রমুখ আইনের দ্বারা কংগ্রেস রাজ্যদের পাশ কাটিয়ে নিজেদের নির্বাচনী দামামা পেটাচ্ছে, এটাই বিরোধীদের অভিমত। জনান্তিকে, জোটসঙ্গীদেরও। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর পক্ষে আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁর পছন্দসই প্রার্থীকে জেতানো শক্ত কাজ। বরং, ‘তাঁর প্রার্থী’ এই তকমাটি কারও থাকলে তাঁর পরাজয়ের সম্ভাবনাই বেশি।
রাজ্য নেতারা যে ইউ পি এ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপর ঘোরতর অসন্তুষ্ট, তাতে সন্দেহ নেই। রাজ্যের ক্ষোভকে অকপটে ব্যক্ত করেছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। বলেছেন, রাজ্য সরকারকে কেন্দ্র নগর পুরসভা হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত। সংবিধান কার্যকর হওয়ার ৬২ বছর পরে অনেক জল বয়ে গেছে যমুনা দিয়ে, যতই তা ক্ষীণস্রোতা হোক। কেন্দ্র-রাজ্য অর্থবণ্টনের মূল সূত্র হল, মোটা অঙ্কের কর (আয়কর, ভ্যাট, আমদানি শুল্ক, পরিষেবা কর ইত্যাদি) সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের অধিকারী কেবল কেন্দ্র। রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত মাত্র কিছু সামান্য কর, যেমন আবগারি, স্ট্যাম্প ও রেজিস্ট্রেশন, গাড়ির উপর কর ইত্যাদি।
কেন্দ্র অবশ্য তার কর বাবদ আয়ের ভাগ দেয় রাজ্যকে। কিন্তু, রাজ্য নেতাদের মত এই যে, তাঁদের প্রাপ্য অনেক বেশি, কারণ সামাজিক উন্নয়নের সিংহভাগ খরচ বহন করতে হচ্ছে রাজ্যকেই।
এই বিতর্ক আমলাতান্ত্রিক পথে মেটার নয়। ২০০৮ সালে বিশ্বজোড়া মন্দার মেঘ ঘনিয়ে আসতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা আমলাতান্ত্রিক পথে না হেঁটে বাস্তববুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। দিল্লিতে এই বাস্তববুদ্ধির স্বল্পতা রাজ্য নেতাদের বিদ্রোহের পথে টেনে আনতে পারে। সে ক্ষেত্রে দেশলাই কাঠিটি জোগানোর পক্ষে মমতা বন্দোপাধ্যায় যোগ্যতম ব্যক্তি।
যোগ্যতম, কারণ সফল সেনাপতিরা অনেকেই হন ঈষৎ অন্য রকম। প্রত্যুষে দেবদূতদের সঙ্গে বাক্যালাপ সেরে তবে যুদ্ধে বেরোতেন জোন অব আর্ক। আর নেপোলিয়ন ঘোড়ার পিঠে বসে তাড়াতাড়া নোট লিখতেন, যার ছত্রে ছত্রে থাকত বিস্তর অসঙ্গতি। |