মায়ের কোল থেকে নামতেই চাইছিল না ঐশ্বর্যা। ছোট ছোট হাতে গলাটা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরছিল। আড়াই ঘণ্টা সময়টা এক বছরের ঐশ্বর্যা আর তার মা সাগরিকার জন্য বড়ই কম যে!
ছেলে অভিজ্ঞানও ঘুরঘুর করছিল মায়ের আশপাশে। নিজের মনে কী সব বিড় বিড় করে যাচ্ছিল! এ সব ঠেলেই বেরিয়ে আসতে হল সাগরিকাকে।
মঙ্গলবার ছেলেমেয়েরা নরওয়ে থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতায় নামলেও তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি সাগরিকার। সাগরিকার বাবা মনোতোষ চক্রবর্তীর দাবি, মঙ্গলবার রাতে কলকাতায় নামার পরে অনুরূপের বাবা অজয়বাবুর মোবাইলে অনেক বার ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই ফোন বেজে বেজে কেটে যায়। সাগরিকা জানতেন, মঙ্গলবার কলকাতায় নেমে তাঁর দেওর অরুণাভাস বাচ্চাদের নিয়ে সটান চলে যাবেন বর্ধমানের কুলটিতে, নিজেদের বাড়িতে।
সিঁথিতে থাকেন অনুরূপের ছোটমামা আবীর চট্টোপাধ্যায়। এর আগেও অনুরূপ-সাগরিকার মনোমালিন্য মেটাতে অভিভাবক হিসেবে এগিয়ে এসেছেন আবীরবাবু। এ বারও কি সাহায্য করবেন না তিনি? বুধবার সকালে এ নিয়ে আলোচনা করার জন্য তাঁকে ফোন করেন সাগরিকার বাবা। তখনই ওঁরা জানতে পারেন, অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যা সিঁথির বাড়িতেই আছে। কুলটি যায়নি। |
মনোতোষবাবুর কথায়, “আমার ফোনটা প্রথমে এক মহিলা ধরেন। আমি ভেবেছিলাম, আবীরবাবুর স্ত্রী। বলি, দাদাকে দিন না। দাদা ধরেন। আমি বলি, ‘চলুন না আবার আমরা আলোচনা করে সমস্যাটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করি। দু’জন দুধের শিশু, তাদের মা-বাবা সকলেই তো কষ্ট পাচ্ছে।’ ফোনের অন্য পাশ থেকে উনি বলে ওঠেন, ‘না, না। এখন আর কোনও আলোচনা নয়। অনেক পথ পেরিয়ে আমরা এসেছি। সকলেই ক্লান্ত।’ আমার তখন সন্দেহ হয়। এ ভাবে তো আবীরবাবু বলেন না! আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনি কে?’ তখন ফোনের ও-পাশ থেকে উনি বলেন, ‘আমি অজয়বাবু। অনুরূপের বাবা।’ তখনই আমি জানতে পারি ওঁরা কলকাতাতেই রয়েছেন।”
সকাল আটটায় আচমকাই ফোনে বেয়াইকে পেয়ে তখনই সিঁথিতে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে নেন মনোতোষবাবু। অজয়বাবুও মানা করেননি। প্রথমে একা একাই উল্টোডাঙা থেকে সিঁথি পৌঁছে গিয়েছিলেন মনোতোষবাবু। সেখানে বাড়ির বাইরে সংবাদমাধ্যমের ভিড় দেখে খানিকটা ভয় পেয়েই ফিরে আসেন। বাড়িটা চিনতে পারবেন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ ছিল। বিকাল চারটে নাগাদ মেয়ে, স্ত্রী, বন্ধুকে নিয়ে আবার সিঁথির বাড়িতে যান। আড়াই ঘণ্টা সেখানে ছিলেন। মঙ্গলবার রাতে কলকাতায় নামার পরে যতটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল অনুরূপ-সাগরিকার দুই ছেলেমেয়েকে, সেই ক্লান্তির ছাপ কাটেনি বুধবার সন্ধ্যাতেও। |
মনোতোষবাবুর কথায়, “আমরা যখন সিঁথি ছেড়ে বেরিয়ে আসি, তখনও ওঁদের কুলটি রওনা হওয়ার কোনও তোড়জোড় ছিল না। মনে হল, বুধবারের রাতটাও ওঁরা কলকাতায় কাটাবেন।”
রাতে সাগরিকা ফোনে বলেন, “খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার সঙ্গে ছেলেমেয়ের শেষ বার দেখা হয়েছিল নভেম্বরে। ছ’মাস পরে একরত্তি মেয়ে আমাকে দেখে ঠিক চিনতে পেরেছে। আমার কোলে বসে আমাকেই বিস্কুট খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে।” বৃহস্পতিবার সকালেও ছেলেমেয়ের সঙ্গে আবার দেখা করতে চান তিনি। সাগরিকার এখন একটাই আর্জি, “মায়ের অধিকার থেকে যেন বঞ্চিত করা না হয় ওই দুই শিশুকে। আমাকেও।”
|