শিশু বিভাগের দরজার উপরে বড় হরফে লেখা, ‘জুতা পরিয়া প্রবেশ নিষেধ’। দরজার বাইরে কয়েকটি জুতো পড়ে রয়েছে। দেখলে মনে হবে ওয়ার্ডের ভিতরে বাইরের লোকজন নেই। কিন্তু দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই ভুল ভাঙল।
ভিতরে থিকথিকে ভিড়। প্রবল হই-হট্টগোল, শিশুদের কান্না, শিশুদের মা ও আত্মীয়-পরিজনদের কথাবার্তা, মোবাইল ফোনের ‘রিংটোন’-- সব মিলিয়ে কান পাতা দায়। অসুস্থ শিশুকে ঘুম পারাতে না পেরে বিরুক্ত এক মা বলেই ফেললেন, “এটা হাসপাতালের ওয়ার্ড না বাজার?” পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের এটাই রোজকার ছবি।
২০০৩ সালে এই ওয়ার্ডের পাশে গড়ে তোলা হয় নবজাত শিশুর পরিচর্যা কেন্দ্র।.কলকাতার বাইরে রাজ্যে প্রথম এখানেই সদ্যোজাত শিশুদের বিশেষ চিকিৎসা কেন্দ্র তৈরি হয়। পুরুলিয়াকে মডেল করেই পরবর্তী সময়ে অন্যান্য জেলাগুলিতেও এই ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের একাংশের মত, প্রদীপের নীচে অন্ধকারে পড়ে থাকার মতই জেলা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডটি পড়ে রয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, শিশু ওয়ার্ডে শয্যার সংখ্যা ৬৮। কিন্তু রোগীর চাপ সে তুলনায় যথেষ্ট বেশি। গড়ে প্রতিদিন এখানে ১১৫টি শিশু রোগী থাকে। ফলে এক একটি শয্যায় ২-৩টি করে শিশু শুয়ে থাকে। |
কয়েকদিন আগে নিজের পাঁচ মাসের পুত্র সন্তানকে এই হাসপাতালে ভর্তি করেছেন ঝালদা থানার বেলাডি গ্রামের বাসিন্দা ললিতা কুমার।. তাঁর ছেলে জ্বর, সর্দি-কাশিতে ভুগছে। ললিতাদেবী বলেন, “জ্বর ছাড়ছেই না। তাই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।” সেই শয্যাতেই শুয়েছিল বরাবাজার থানার ব্রজরাজপুর গ্রামের ঝনি মুর্মুর আট মাসের ছেলে। তিনি বলেন, “একই বিছানায় দু’জন রোগীকে রাখতে হচ্ছে। শিশুরা ছোট বলে মায়েদেরও থাকতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে খুবই অসুবিধা হচ্ছে।” পাশের শয্যাতেও একই ছবি।. জয়পুর থানার জররো গ্রামের বাসিন্দা উর্মিলা গোপ জন্ডিসে আক্রান্ত শিশু সন্তানকে নিয়ে শুয়ে ছিলেন। সেই শয্যাতেই শুয়ে ছিল পুরুলিয়া শহরের রেণী রোডের রূপালী মোদকের তিন মাসের শিশু সন্তান। তিনি বলেন, “ছেলে জ্বরে ভুগছে। কিন্তু এ ভাবে বিছানা ভাগ করে রাখতে সমস্যা হচ্ছে। চারপাশে এত হট্টগোল হচ্ছে যে ছেলেকে ঘুমাতেও পারা যাচ্ছে না।”
এক নার্স এক শিশুর মা’কে ওষুধ খাওয়ানোর নিয়ম বোঝাচ্ছিলেন। হই-হট্টগোলের মধ্যে ওই মহিলা নার্সের কথা বুঝতে পারছিলেন না। তা দেখে নার্স বিরক্তি ভরা গলায় বললেন, “দেখছেন কি অবস্থা! কাকে কি বলব? জুতো খুলে ঢুকতে বললে কেউ তা শুনছেন না। চুপ করতেও চাইছে না। উল্টে আমাদেরই নানা কথা শোনাচ্ছেন। এই অবস্থার মধ্যে কাজ করা যায়?” ওয়ার্ডের বারান্দায় কয়েক জন দিব্যি ধূমপান করছিলেন। পাশেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া সতর্কতা নোটিস, ‘আপনার ধূমপান শিশু মৃত্যুর কারণ হতে পারে’।
হাসপাতাল সুপার স্বপন সরকার বলেন, “শিশু ওয়ার্ডে শয্যার তুলনায় দ্বিগুণ রোগী ভর্তি থাকে। পুরুলিয়া ছাড়াও লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন এলাকা থেকেও অনেক রোগী আসে। তাঁদের ফেরানো যায় না। ফলে রোগীর চাপ কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না। নবজাত শিশুদের পরিচর্যা কেন্দ্রের ২২টি শয্যাও সব সময় ভর্তি থাকে।”
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, শিশু বিভাগে মোট ১২ জন চিকিৎসক রয়েছেন। তার মধ্যে আট জন নবজাত শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে থাকেন। বাকি চারজন শিশু বিভাগের রোগীদের চিকিৎসার দায়িত্বে রয়েছেন। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয় বলে রোগীর আত্মীয়দের অভিযোগ। সুপারের দাবি, “প্রয়োজনে অন্য বিভাগের চিকিৎসকদের সাহায্য নেওয়া হয়।” হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সচেতনতার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বেড়েছে। তাই হাসপাতালে সন্তান প্রসব করানোর সংখ্যাও বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কম ওজনের শিশু জন্মাচ্ছে। তাই নবজাত শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের উপরেও চাপ বাড়ছে। এ কারণেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই ওয়ার্ডের শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য দফতরের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিল। অনুমোদনও মিলেছে। সুপার বলেন, “নবজাত শিশুদের পরিচর্যা কেন্দ্রে শয্যার সংখ্যা ২২ থেকে বেড়ে শীঘ্রই ৬৮ করা হচ্ছে। এর পর সাধারণ শিশু বিভাগের শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাব।” |