শান্তির শহর মেদিনীপুর। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বরাবরই এগিয়ে। বুধবার আরও এক নজির তৈরি করল এই শহরবার্তা দিল অসহায় মানুষের পাশে থাকার।
অন্য পাঁচটা দিনের মতো বুধবার সকালে পাড়ার চায়ের দোকানের সামনে বসেছিলেন রবীন্দ্রনগরের বাসিন্দা রাকেশ মিশ্র। সাড়ে ৮টা নাগাদ স্থানীয় এক নার্সিংহোমে আগুন লেগেছে খবর পেয়ে উঠে পড়েন। এলাকার ছেলেদের ডেকে নিয়ে সোজা চলে যান সেই নার্সিংহোমে। বেসমেন্টে চারিদিকে তখন কালো ধোঁয়া। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। রোগীর পরিবারের লোকজনদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। কোনও কিছু তোয়াক্কা না করেই দলবল নিয়ে হাসপাতালের মধ্যে ঢুকে পড়েন একদা এসএফআইয়ের ‘সক্রিয়’ কর্মী রাকেশ। শেষ পর্যন্ত সকলেরই প্রাণ বেঁচে যাওয়ায় দৃশ্যত তৃপ্ত দেখায় পেশায় গাড়ি ব্যবসায়ী রাকেশকে। কপালের ভাঁজ মুছে তিনি বলেন, “এমন ঘটনার কথা শুনে তো আর বসে থাকতে পারি না। সাধ্য মতো করেছি। সকলের প্রাণ বেঁচেছে শুনে ভাল লাগছে।” |
রাকেশ একা নন। অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে এ দিন উদ্ধার-কাজে ঝাঁপিয়েছেন এলাকার আরও অনেকেই। এঁরা কেউ গাড়ি চালান, কেউ দোকানে কাজ করেন, কেউ বা বেকার। একের পর এক রোগীকে নীচে নামিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দিয়েছেন হাতে-হাত মিলিয়ে। ধোঁয়ার প্রায় দমবন্ধ মুমূর্ষু রোগীদের শয্যা কাঁধে তুলে নিয়ে গিয়েছেন ছাদে। তারপর বাক্স ভেঙে কার্ডবোর্ড দিয়ে হাওয়া করেছেন সাধ্যমতোযাতে শ্বাসকষ্ট কমে।
উদ্ধারের কাজে স্থানীয় বাসিন্দারা হাত না-লাগালে পরিস্থিতি যে অন্য রকম হত, তা মানছেন রোগীর পরিবারের লোকজনও। হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন নীলকণ্ঠ দাস। বাড়ি গোদাপিয়াশালে। তাঁর ছেলে মিহির বলেন, “বেসমেন্টে আগুন লাগার পর হাসপাতালের অধিকাংশ কর্মীই পালানোর চেষ্টা করেন। স্থানীয় লোকজন উদ্ধারের কাজে সহযোগিতা না-করলে সমস্যায় পড়তে হত।” একই মত মায়া দাসের। তাঁর মেয়ে সায়নী এখানে ভর্তি ছিলেন। মায়াদেবীর কথায়, “শুরুতে হাসপাতাল কর্মীরা ঘটনাকে গুরুত্ব দেননি বলে শুনেছি। আগুন দেখে স্থানীয়ারই ছুটে আসেন।” এ দিন দোতলা-তিনতলায় উঠে রোগীদের উদ্ধার করেছেন পিন্টু রায়। তিনি বলেন, “তখন হাসপাতালের মধ্যে ঢোকাই মুশকিল। কালো ধোঁয়ায় একতলা ঢেকে গিয়েছে। রোগীর পরিবারের লোকজনদের দেখে কষ্ট হচ্ছিল। সময় নষ্ট না-করে উদ্ধারের কাজে হাত লাগাই।”
বস্তুত পুলিশের কাজও প্রশংসা কুড়িয়েছে এ দিন। হাসপাতালে আগুন লাগার খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে পৌঁছন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) কল্যাণ মুখোপাধ্যায়। এক মহিলা পুলিশকর্মী ক’দিন ধরেই এই নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন। তাঁর মারফৎ আগুন লাগার খবর পান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। ছুটে আসেন হাসপাতালে। আসে পুলিশের কম্যান্ডো বাহিনী। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্ত, জেলা পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠি প্রমুখ। আসেন দীনেন রায়, প্রদ্যোৎ ঘোষ-সহ স্থানীয় তৃণমূল নেতারাও। বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠন অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে। উদ্ধারের জন্য কর্মী পাঠায়। হাসপাতালে দাঁড়িয়ে যুব-তৃণমূল নেতা স্নেহাশিস চক্রবর্তী বলেন, “স্থানীয় লোকজন উদ্ধারের কাজে না-নামলে বড় বিপদ হতে পারত।’’ জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্ত বলছিলেন, “স্থানীয়রা যে ভাবে হাসপাতালে ঢুকে রোগীদের উদ্ধার করেছেন, তা দেখে সত্যিই ভাল লেগেছে। মানুষ বিপদে পড়লে এ ভাবেই এগিয়ে আসা উচিত।” খবর পেয়ে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছন সিপিএম পরিচালিত জেলা পরিষদের সভাধপতি অন্তরা ভট্টাচার্য। উদ্ধারের পরে রোগীদের তখন সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। |