সামাজিক জোটগুলো লোকপ্রজ্ঞাকে ব্যবহার করে ক্ষমতাকে লোকশত্রু হয়ে ওঠা থেকে কিছুটা
হলেও আটকাতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের ‘পরিবর্তন’-এর সীমা ও সম্ভাবনা বিচার করেছেন কুমার রাণা |
ভারতের প্রাচীন ভাষাগুলির অন্যতম সাঁওতালিতে চাঁদো উচ্চারণভেদে চাঁদু মানে মাস। সেরমা সিরমা বছর। আবার, চাঁদো চাঁদ, সেরমা আকাশ। চাঁদের হিসেবে মাস ঠিক করাটা বোঝা যায় মাসে একটাই পুরো চাঁদ। কিন্তু বছরের হিসাবের জন্য আকাশের ব্যবহার যতটা কাব্যিক, ততটা সহজে বোধগম্য না-ও হতে পারে। হয়তো কৃষিসমাজে আকাশের জলের উপর নির্ভরতার কারণে দুই বর্ষার অন্তর দিয়ে বছর মাপার রীতি থেকে আকাশের আবাহন। দৃশ্যমান প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে সময়ের পরিমাপ বহু যুগ ধরে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন সমাজে চলে আসছে। সেই সঙ্গে সমাজের লোকপ্রজ্ঞা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিজস্ব দর্শন গড়ে তোলার কাজে লাগিয়ে এসেছে। উদাহরণ, পূর্ণিমা-অমাবস্যার সঙ্গে সুখ-দুঃখ। সমাজের ভাগ্য নির্ধারণে এই লোকদর্শনের সঙ্গে রাজনৈতিক দর্শনের সম্পর্কটা গুরুত্বপূর্ণ। আদর্শ একটা অবস্থায় এ দুইয়ের সামঞ্জস্য সমাজে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু সাধারণ ভাবে অতটা আদর্শ অবস্থা আমরা পাই না, প্রায়শই রাজনৈতিক দর্শন লোকদর্শনের বিপরীতে গিয়ে ক্ষমতায় নিরঙ্কুশ হতে চায়।
পশ্চিম বাংলার বিশেষ প্রেক্ষিতে আমরা এ জিনিসটাকে দেখতে পারি। নয় চাঁদ আগে রাজ্যে পরিবর্তনের যে প্রবল চাহিদা ক্ষমতার সমীকরণ বদলে দিল, তার ভিত্তিটাই ছিল পরিবর্তনের লোকদর্শন, যা কেবল ক্ষমতার হাতবদলই চায়নি, চেয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে পর্যবেক্ষণের মতোই এই দর্শনের একটা সহজ যুক্তি থাকে: ক্ষমতা যেন নিরঙ্কুশ হয়ে না ওঠে। তার সীমা এমন ভাবে বেঁধে দেওয়া দরকার, যাতে দৈনন্দিন লোকজীবনে তার দাপটটা অসহনীয় হয়ে না ওঠে। অর্থাৎ, অংশত হলেও, ক্ষমতা যেন লোকহিত ভুলে না যায়। এটা যদি গণতন্ত্রের মূল হয়, তা হলে বোধ হয় তার প্রধান সমস্যাও বটে। কেননা, এখানে ক্ষমতার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে। এ বার, ক্ষমতা থাকলে সে নিরঙ্কুশ হতে চাইবেই তার ধর্মই একাধিকার, তা সে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যার সঙ্গেই সম্পর্কিত হোক না কেন। হয়তো লোকদর্শনের কাজকারবার অনেক বেশি আশু ও বাস্তব ব্যাপার নিয়ে, তাই রাষ্ট্রহীন অর্থাৎ ক্ষমতাকেন্দ্রহীন সমাজের যে কল্পনা কার্ল মার্কস করেছিলেন, সেটা খুবই সম্ভবত একমাত্র আদর্শ ব্যবস্থা বলে মনে হলেও সাধারণ্যে রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই অধিকতর স্বীকৃত, সম্ভবত সেটার বাস্তব অস্তিত্বের জন্যই। |
গণতন্ত্রের সমস্যাটাকে মোকাবিলা করার জন্য সমাজ একটা ব্যবস্থাও গড়ে তুলেছে, যাতে ক্ষমতার বিপরীতে লোকশক্তি ভারসাম্য রক্ষার কাজ করে। সেই শক্তি নানা ভাবে সংগঠিত হতে পারে: গণ-সংগঠন (পেশাগত ইউনিয়ন), সামাজিক পরিচিতির সংগঠন (নারী, দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু), আয় বৃদ্ধির জন্য জোট (স্বরোজগার দল), বিশেষ চাহিদা থেকে উদ্ভূত গোষ্ঠী (পরিবেশ রক্ষা), ইত্যাদি বিভিন্ন সমূহ গড়ে ওঠে। রেজিস্টার্ড এনজিও বা নন-রেজিস্টার্ড জনসমিতিগুলিও ইদানীং বড় শক্তির উৎস হয়ে উঠছে। এ সবের বাইরে একেবারে তাৎক্ষণিক শক্তির স্ফুরণও ঘটে: আকস্মিক পথ অবরোধ, অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও তৎপরতা, ইত্যাদি নানা ঘটনায় এর প্রকাশ। এই সব সংগঠিত-অসংগঠিত জোট থেকে যে শক্তি জন্ম নেয়, অনেক সময় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি তেজ নির্গত হয় সম্পূর্ণ অদৃশ্য, অসংগঠিত জোট থেকে, যা সবচেয়ে ভাল ভাবে অনুভূত হয় নির্বাচনের সময়। সম্ভবত, অন্য শক্তিগুলো যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে বলে মনে হয়, তখনই, হয়তো তার জায়গা নিতে, এই শক্তি আকার ধারণ করে।
সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে খুবই কার্যকর বলে মানা যায় সংগঠিত ইউনিয়নগুলোকে। সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে তাদের নিস্তেজ হয়ে পড়ার একটা বড় কারণ সম্ভবত সেগুলোর ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা। মানুষের জোট থেকে যে-শক্তি গড়ে ওঠে, একটা সময় সেটা নিজেই ক্ষমতা হয়ে ওঠে এবং ক্ষমতার সঙ্গে আপস করে, যার ফলে তার চারিত্রিক গুণটাই যায় বদলে, লোককল্যাণের স্থান নেয় আত্মস্বার্থ। পশ্চিমবঙ্গবাসীর অভিজ্ঞতা আছে, যে সব গণসংগঠন এক সময় সরকারি ও সামাজিক কু-নীতি ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে ন্যায্য গঠনমূলক প্রতিবাদী উদ্যোগী গড়ে তুলেছে, তারাই আবার পরবর্তী কালে ক্ষমতার অংশভাক্ হয়ে অন্যায্য বদলি, কাজে গাফিলতি করা সদস্যদের বাঁচানো, ইত্যাদি লোকস্বার্থ-বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়েছে। ক্ষমতার চরিত্রই এমন যে, সে সব কিছুকে নিজের ছাঁচে ঢেলে নেয়: শক্তি যখন ক্ষমতার রূপ নিল, তখন সংগঠনের ভিতরও একটা অন্যায্য কাঠামো মজবুত হয়ে উঠল। লাভবান হল বিশেষ এক শ্রেণি, সংগঠনের সকল সদস্যের সমানাধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষার মধ্য দিয়ে জোটের যে শক্তি ব্যাপক মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হয়েছিল, ক্ষমতায় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে তার সেই মূল উদ্দেশ্যটাই পরাভূত হল।
এর ফলটা মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। এই যে জনমানসে ইউনিয়ন মানেই ফাঁকিবাজির আখড়া বলে একটা ধারণা গড়ে উঠল ও ক্ষমতাগোষ্ঠীগুলি সেই ধারণা প্রচারে মদত জোগাল, তাতে আসল যে ক্ষতিটা হল, সেটা সেই লোকদর্শনের, যার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ক্ষমতাকে সহনীয় সীমায় বেঁধে রাখার জোট। (ইতিহাসের পরিহাস, এমন ইউনিয়ন যে ক্ষমতাকে চোখের মণির মতো রক্ষা করার অঙ্গীকারে বৃহত্তর উদ্দেশ্য ভুলে গিয়েছিলেন, অন্তত আংশিক ভাবে হলেও, সেই ক্ষমতার কাছেই তাঁরা আবার নিন্দিত হয়েছেন, ‘ইউনিয়ন যত নষ্টের গোড়া’ বামফ্রন্ট সরকারের কোনও কোনও মাথার এই রোগনির্ণয় কারও কারও মনে থাকতে পারে।) ইউনিয়ন একটা উদাহরণমাত্র। ক্ষমতা যে-কোনও জোটকেই সন্দেহের চোখে দেখে এবং বিনষ্ট করতে চায়। সেটা সে করে দু’ভাবে বলপ্রয়োগ করে অথবা আত্মস্থ করে নিয়ে। পশ্চিম বাংলার যে মূলধারা, তাতে ইউনিয়নগুলোর ক্ষমতার মধ্যে মিশে যাওয়ার ঝোঁকটাই অনেক দিন ধরে প্রধান থেকেছে। এখন উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে, বলপ্রয়োগের হুঙ্কারই আজকের বৈশিষ্ট্য হয়তো ইউনিয়নগুলোর মধ্যে বর্তমান ক্ষমতা তেমন সমর্থন পেয়ে ওঠেনি বলেই।
অবশ্য, ইউনিয়ন ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলোর, বহু ক্ষেত্রেই, ক্ষমতার সঙ্গে সংঘাতের পথে যাওয়ার ব্যর্থতার ফলে সামাজিক চাহিদা থেকেই অন্য ধরনের শক্তি উঠে এসেছে, যা রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথটা অনেক সহজ করে দিয়েছে। এতে ক্ষমতার সমীকরণ বদলে, যাঁরা ছিলেন বিরোধী শক্তি, এখন তাঁদেরই স্বচ্ছন্দ অধিষ্ঠান। ক্ষমতা স্বভাবত বিস্মৃতিপ্রবণ: তার কাছে বর্তমানের পূর্ণিমাই সব, বিগত অমাবস্যার স্মৃতি অবান্তর। সুতরাং, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, ক্ষমতা সামাজিক শক্তিগুলোকে বলপ্রয়োগ করে, অথবা আত্মস্থ করে অকেজো করে দিতে চাইবে। কর্মচারী ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আস্ফালনের মধ্য দিয়ে যার শুরুয়াত, এমন ভাববার কারণ নেই যে, সেটা কেবলমাত্র বিশেষ কোনও জোটের উপরই ক্রিয়াশীল থাকবে। সংকেত স্পষ্ট: যে কোনও প্রশ্নবাচী, সমালোচক, বিরোধাভাষী শক্তি ইউনিয়ন, সংবাদমাধ্যম, এনজিও, এমনকী ব্যক্তিবিশেষকেও কণ্ঠরোধী এজেন্ডার আওতায় আনা হবে। কিন্তু সমস্যা হল, পশ্চিমবঙ্গের লোক-অভিজ্ঞতায় বৃহৎ ইউনিয়নগুলো যে ছাপ ফেলেছে, তাতে ক্ষমতার এই আস্ফালন বিশেষত মধ্যশ্রেণির একাংশের কাছে বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে, এখনও কেউ কেউ ‘মানুষ ভুল বুঝেছে’ বলে লোকপ্রজ্ঞাটাকেই অস্বীকার করে চলেছেন।
আশার কথা, কোনও কোনও ইউনিয়নের মধ্যে আত্মমন্থনের এবং ব্যাপক লোকহিতে শক্তি নিয়োগের একটা বাস্তবিক প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। গঠনমূলক ভাবে উদ্দেশ্য স্থির করার এই প্রক্রিয়াতে জোর পড়ছে নিজের কাজের প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতার উপর। ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠা থেকে আটকানোর জন্য এই দায়িত্ববোধটাই আসল শক্তি। শ্রমিক-কর্মচারী-ছাত্র থেকে যে নানান সংগঠনগুলি আছে, তাদের বোধ হয় ব্যাপক লোকহিতের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার মৌলিক সমাজদর্শনটি নিয়ে মন দিয়ে ভাবতে হবে। ইউরোপ থেকে লাতিন আমেরিকা, বিশ্বের নানা প্রান্তে শক্তি ও ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। অনেক নতুন নতুন ধ্যানধারণা গড়ে উঠছে, যাদের মূল কথা হল, কোনও ক্ষমতাকেই চোখের মণির মতো রক্ষা করার প্রয়োজন নেই, লোকহিতের মাপদণ্ডে সে যদি বৈধ বলে স্বীকৃত না হয়, তার পতনই বাঞ্ছনীয়। সমাজদর্শন শুধু পূর্ণিমাই নয়, অমাবস্যাও দেখবে। দিন-রাত-দুপুর-বিকেল প্রতিটি ক্ষণকে পরীক্ষায় ফেলবে। যে লোকপ্রজ্ঞা সময়ের মতো একটা বিমূর্ত ব্যাপারকেও পরিমাপে ধরতে পারে, তা যে ক্ষমতার মতো একটা সতত দৃশ্যমান, প্রতি মুহূর্তে অনুভবে ধরা পড়া, নিপীড়ক, দাহ্য সত্তাকে নিয়ত মাপতে থাকবে, এতে সন্দেহ নেই। রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতা স্বেচ্ছায় লোকহিতকর হয়ে ওঠে না, কিন্তু সামাজিক জোটগুলো লোকপ্রজ্ঞাকে ব্যবহার করে ক্ষমতাকে লোকশত্রু হয়ে ওঠা থেকে কিছুটা হলেও আটকাতে পারে। যেটা দেখার, তা হল, জোটগুলো পরিস্থিতির দাবিতে সাড়া দিয়ে নিজস্ব চিন্তাভাবনার জগৎকে কতখানি পুনর্বিন্যস্ত করতে পারে।
|
প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এ কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত |