প্রবন্ধ ৩...
রাজনীতির রাষ্ট্রভাষা
উন্নয়ন নয়, পাইয়ে দেওয়া
রেল বাজেটের সদ্য-সমাপ্ত নাটকে ট্র্যাজিক নায়ক কে, তা নিয়ে সংশয় নেই। ভিলেন কে? এখন বিবিধ কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছে। ফলে, তাঁকে এই কুনাট্যের একমাত্র ভিলেন ঠাউরে নিলে বাকি আলোচনা সহজ হয়।
কিন্তু যথার্থ হয় না। রেল বাজেট নিয়ে মমতা যা যা করেছেন, তাকে একটা সহজ সুতোয় গেঁথে ফেলা চলে। তাঁর নিজস্ব রাজনীতির ভাষার সুতো। তিনি আজীবন রাজনীতির একটা ভাষাকেই ধ্রুব জেনে এসেছেন জনমোহনের ভাষা। কিন্তু এই ভাষাটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টি, এমনটা দাবি করলে অন্য রাজনীতিকদের প্রতি বেজায় অন্যায় করা হবে। বস্তুত, ভারতীয় রাজনীতির রাষ্ট্রভাষা এটাই মানুষের মন ভোলানোর ভাষা। রেল বাজেটের প্রেক্ষিতে মমতা একটু উচ্চৈঃস্বরে এই ভাষায় কথা বলে ফেলেছেন মাত্র।
রেলমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, রেলের অপারেটিং রেশিয়ো ৯৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, রেল বছরে যত টাকা আয় করে, তার ৯৫ শতাংশই খরচ হয়ে যায় রেল চালাতে, কর্মীদের বেতন-পেনশন দিতে, বকেয়া ঋণের সুদ দিতে। রেলের উন্নতির জন্য প্রায় কোনও টাকাই অবশিষ্ট থাকে না।
ফলে, রেলের উন্নয়নও হয় না। যে নেতারা যাত্রী-ভাড়া না বাড়াতে বদ্ধপরিকর, সম্ভবত তাঁরা জানেন না, রেলের শৌচাগার ঠিক কতখানি অপরিচ্ছন্ন থাকে, রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে পা দিলে ঠিক কতটা ঘেন্না করে। টাকার অভাবে পরিকাঠামোর উন্নতির কাজ থমকে থাকলে সাধারণ মানুষের ঠিক কতটা ক্ষতি হতে পারে, নেতারা সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করেন না। দুর্ঘটনায় জীবনহানির অর্থমূল্য কত, অর্থনীতির তত্ত্ব তার একটা হিসেব দিতে পারে। দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়লে সেই খরচও বাড়ে। প্রত্যেক যাত্রীকে বাধ্যতামূলক ভাবে সেই খরচ বহন করতে হয়। পুঁতিগন্ধময় রেল-সফরের যে অসুবিধা হয়, অর্থনীতির পরিভাষায় সেটাও একটা খরচ অসুবিধা বহন করার খরচ। সেটাও যাত্রীর ওপরই চাপে। ভাড়া যত বছর না বেড়ে থাকে, রেলের পরিকাঠামো ততই বেহাল হয়। ফলে, যাত্রীদের এই খরচের পরিমাণও বাড়ে।
রেলমন্ত্রীরা বাড়তি টাকার সংস্থান করেন পণ্য পরিবহণের মাসুল বাড়িয়ে। সেই মাসুলের খরচ পণ্যের দামের সঙ্গে যোগ হয়ে যায়। আম-আদমি যখন পাড়ার মুদিখানায় চিনি, তেল কিনতে যান, তখন তার দামের সঙ্গে সঙ্গে এই মাসুলটুকুও দিয়ে আসেন। যাঁরা কখনও রেল চড়েন না, তাঁরাও কিন্তু এই পণ্য মাসুল দিতে বাধ্য হন।
প্রশ্ন হল, ভাড়া না বাড়িয়েও যে নেতারা আম-আদমির ওপর বোঝা চাপিয়েই চলেছেন, এই কথাটা বোঝে প্রায় সবাই। বোঝেই যদি, তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন জনসভায় দাঁড়িয়ে বলেন, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনাদের এক পয়সাও বেশি ভাড়া দিতে হবে না তখন মানুষ হাততালির ঝড় তোলে কেন? নেতারা মানুষকে বোকা বানাতে চান, বোঝা গেল কিন্তু মানুষ বোকা বনে কেন?
এই প্রশ্নের সহজ উত্তর পকেট থেকে সরাসরি বেশি টাকা খরচ করতে আমাদের খারাপ লাগে। সেই টাকাটাই ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে নিলে আমরা তেমন আপত্তি করি না। সাধারণ বাজেটে অর্থমন্ত্রী আয়করে ছাড় দিয়েছেন। কিন্তু, অর্থমন্ত্রী আয়কর ছাড় দিয়ে রাজস্ব হারিয়েছেন চার হাজার কোটি টাকা, আর উৎপাদন শুল্কের হার বাড়ানোর মাধ্যমে, অনেক বেশি সংখ্যক পরিষেবাকে পরিষেবা করের আওতায় এনে বাড়তি রাজস্ব তুলবেন একচল্লিশ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, অর্থমন্ত্রী যত ছাড়লেন, তার দশ গুণ টাকা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থাও করলেন। তাতেও মানুষ খুশি। কারণ, আয়কর সরাসরি দিয়ে দিতে হয়, পরোক্ষ করগুলি আমাদের অজান্তেই দেওয়া হয়ে যায়। রেলের পণ্য মাসুলের মতোই।
পণ্য মাসুলের মতোই এই পরোক্ষ করও কোনও বাধবিচার করে না, সবার কাছ থেকে এক হারে কর আদায় করে। দেশের ক’জন মানুষ মাসে কমপক্ষে ১৭,০০০ টাকা আয় করেন? সংখ্যাটা খুব বেশি হওয়ার কারণ নেই। আয়করের ছাড়ের মাত্রা বাড়ায় লাভ হল তাঁদের। এই শ্রেণির মানুষ যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কেনেন, যাঁর মাসে পাঁচ হাজার টাকা আয়, তাঁকেও সেই পণ্যের অনেকগুলিই কিনতে হয়। দু’জনে সমান হারে কর দিতে বাধ্য। এতে কার লাভ, কার ক্ষতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও জানেন, সনিয়া গাঁধীও। কিন্তু, আম-আদমির প্রতি যাবতীয় দরদও হাততালি পাওয়ার রাজনীতিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না।
শেষ যে বার রেল-ভাড়া বেড়েছিল, তখন ভারতে মাথাপিছু আয় ছিল ৮,০০০ টাকার কাছাকাছি। এখন সেই অঙ্কটি বেড়ে তার প্রায় তিন গুণ হয়েছে। মানে, তিনশো শতাংশ বৃদ্ধি। রেলের ভাড়া বেড়েছে বড় জোর কুড়ি শতাংশ। এই বাড়তি ভাড়াটুকু দেওয়া কি সত্যিই সাধ্যাতীত? প্রত্যুত্তরে বলতেই পারেন, আয় বেড়েছে মূলত মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তার সঙ্গে আম আদমির সম্পর্ক কী? মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প এক ধাক্কায় আম আদমির রোজগার বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটাই। যাঁরা প্রকল্পে কাজ পেয়েছেন, তাঁদের তো বটেই, যাঁরা কাজ পাননি, তাঁদেরও মজুরি বেড়েছে। হয়তো তিনশো শতাংশ নয়। কিন্তু কুড়ি শতাংশের বেশি।
এক ধাক্কায় ২০ শতাংশ ভাড়া বাড়লে তবুও গায়ে লাগে। নেতারা তাই আপত্তি করেছেন। কিন্তু, এক ধাক্কায় ২০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় কেন? হয়, তার কারণ, প্রতি বছর দুই শতাংশেরও কম ভাড়া বাড়াতেও নেতারা অনিচ্ছুক। অসংরক্ষিত সাধারণ কামরায় যে দূরত্ব যেতে ২০০ টাকা ভাড়া লাগে, দশ বছর ধরে প্রতি বছর ভাড়া বাড়ালে প্রথম বছরের শেষে ভাড়া বাড়াতে হত ৩ টাকা ৬৬ পয়সা, আর দশম বছরের শেষে ভাড়া বাড়াতে হত ৪ টাকা ৩১ পয়সা। দশম বছরে ভাড়া দাঁড়াত ২৩৯ টাকা ৭৬ পয়সায় দশ বছর ধরে বাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি ঝুলিয়ে রেখে এক ধাপে ২০ শতাংশ বাড়িয়ে রেলমন্ত্রী যে ভাড়ায় পৌঁছোলেন! যাত্রীদের এক বারে ৪০ টাকা বেশি দিতে বলা যদি রাজনৈতিক ভাবে বিপজ্জনক হয়, তা হলে প্রতি বছর চার টাকা বেশি চাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। রাজনীতিসঙ্গতও।
কিন্তু, রাজনীতির এই পথে হাঁটতে গেলে একটা সততা প্রয়োজন রাজনীতিকদের স্বীকার করে নিতে হবে, রেলের পরিষেবা সুষ্ঠু ভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য যাত্রীদের থেকে বেশি ভাড়া নিতেই হবে। তা নিয়ে জনমোহিনী রাজনীতি করা চলবে না। সেই বেশি ভাড়া কী ভাবে নেওয়া যায়, মানুষকে কতখানি সইয়ে নেওয়া যায় যাতে তাঁদের সমস্যা না হয় এগুলো পরের প্রশ্ন। এই যে অল্প অল্প করে ভাড়া বাড়ানো, এটাও তো আসলে রাজনীতি। মানুষের স্বার্থরক্ষার রাজনীতি। ইতিবাচক রাজনীতি। কিন্তু মুশকিল হল, এই রাজনীতির পথে হাঁটলে ‘আমি তোমাদের পাইয়ে দিলাম, অতএব আমায় হাততালি দাও’ এই কথাটি আর জোর গলায় বলা চলে না।
সাধারণ মানুষ এই পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতিতেই অভ্যস্ত। কোনও সরকারি পরিষেবাই যে কখনও উন্নত হতে পারে, অভিজ্ঞতা তাঁদের এই কথাটি শেখায়নি। তাঁরা জানেন, সরকার বেশি রাজস্ব পেলে কিছু মন্ত্রীর আর তাঁদের কিছু পারিষদের বেশি লাভ। তাই, উন্নতি-টুন্নতির গল্পে তাঁদের মন নেই। জনসভায় দাঁড়িয়ে যদি তাঁদের নেতা জোর গলায় বলে দেন, ‘আমি বলছি, আপনাদের এক পয়সাও বাড়তি দিতে হবে না’ তাতে হাততালি বাজিয়ে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়া বরং অনেক সহজ কাজ। নেতাকে প্রশ্ন করার মতো গলার জোরও তাঁদের নেই, ইচ্ছেও নেই।
নেতারা সেটা বিলক্ষণ জানেন। আর, জানেন বলেই জনমোহনের ভাষাই আজ ভারতীয় রাজনীতির রাষ্ট্রভাষায় পরিণত হয়েছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.