প্রবন্ধ ১...
জোয়ারের ভরসা নেই
০১২-১৩’র বাজেটটির লক্ষ্য কী? বলা সত্যিই মুশকিল। তবে একটা ব্যাপারে সন্দেহ নেই সরকার যাতে পড়ে না যায়, সেটা নিশ্চয়ই অর্থমন্ত্রীর একটা প্রধান লক্ষ্য ছিল। সরকার টিকবে কি না, সেটা অবশ্য অনেক কিছুর ওপর, বিশেষ করে রাজনৈতিক বাস্তবের ওপর নির্ভর করছে, কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায় অন্তত এইটুকু নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যাতে তাঁর বাজেট সরকারের পক্ষে একটা নতুন বিপদ হয়ে না দাঁড়ায়। এটা লক্ষণীয় যে, এ বারের বাজেট ভাষণের সময় সংসদে বিশেষ কোনও শোরগোল ওঠেনি।
এর ফলে আর একটা কাজও হয়েছে। প্রণববাবুর বাজেটের ফলে অর্থনীতিতে নতুন কোনও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়নি। অর্থনৈতিক স্থিতি এখন খুব জরুরি। সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে কোনও বড় রকমের অনিশ্চিতি দেখা দিলে সেটা শিল্পবাণিজ্য তথা অর্থনীতির পক্ষে খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। এ সত্যটি খেয়াল রাখলে অর্থমন্ত্রীর দূরদৃষ্টির প্রশংসা না করে উপায় থাকে না। সেই অর্থে, সাহসী সংস্কারের পথে না গিয়ে তিনি বিচক্ষণতারই পরিচয় দিয়েছেন। সংস্কার হোক বা না হোক, অর্থনীতি যদি বার্ষিক ৭ শতাংশ হারে এগিয়ে চলে, তবে শুধু শুধু তাকে ঘাঁটানোর দরকার কী?
অর্থমন্ত্রীকে আমি আরও একটি কারণে সাধুবাদ দেব। তিনি রাজকোষ ঘাটতি বা রাজস্ব ঘাটতি কমানো নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করেননি। বাজেটের যে হাল, তাতে সরকারি আয়ব্যয়ের ভারসাম্য ফেরানো নিশ্চয়ই জরুরি। প্রণববাবু সে কথা বলেছেন, কাজটা শুরুও করেছেন, কিন্তু খুব বেশি কিছু করেননি। ২০১১-১২’র বাজেটে রাজকোষ ঘাটতি ধরা হয়েছিল জিডিপি’র ৪.৬ শতাংশ, বিশেষজ্ঞরা অনেকেই অনুমান করেছিলেন, কার্যক্ষেত্রে এই অনুপাত ৫.৬ শতাংশে পৌঁছতে পারে। প্রণববাবুর বাজেট বিবৃতিতে দেখা গেল, সেটা দাঁড়িয়েছে আরও বেশি ৫.৯ শতাংশ। তিনি আগামী বছরের রাজকোষ ঘাটতি ধরেছেন ৫.১ শতাংশ চলতি বছরের সংশোধিত মাত্রার চেয়ে কম হলেও এ বছরের বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি।
এটা তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। গত বছরে অর্থমন্ত্রীর উপদেষ্টারা তাঁকে কিছুটা বিভ্রান্ত করেছিলেন, এ বার তিনি সেটা আর হতে দেননি। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা গোষ্ঠীর হিসেব অনুসারে তিনি ধরে নিয়েছেন, আগামী বছরে জিডিপি বাড়বে ৭.৬ শতাংশ। পাশাপাশি, আশায় বুক বেঁধে তিনি ধরে নিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। মূল্যস্ফীতির কোনও হার তিনি দেখাননি, তবে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি অনুমান করেছেন, মনে হয় অর্থমন্ত্রীও সেটাই অনুসরণ করেছেন। বলতেই হবে, এ ক্ষেত্রে তিনি বাস্তববাদিতার পরিচয় দিয়েছেন, না কি, বলা উচিত মোহভঙ্গের? সেটাই হয়তো ঠিক, কারণ বাস্তব পরিস্থিতির চাপ অগ্রাহ্য করার কোনও উপায় তাঁর ছিল না।
এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। অর্থনৈতিক সমীক্ষা তথা বাজেটের সংশোধিত হিসেব অনুসারে, চলতি বছরে জিডিপি বাড়ছে ৬.৯ শতাংশ। আগামী বছরে আয়বৃদ্ধির হার ৭.৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থনীতিকে একটা বড় রকমের উৎসাহ জোগানো দরকার। এই বাজেটে তেমন কিছুই নেই। আয়করে সামান্য কিছু ছাড় দিয়েছেন প্রণববাবু, যার ফলে করদাতাদের হাতে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার মতো বাড়তি ক্রয়ক্ষমতা আসবে। এর সবটাই যে বাজারে পণ্য কেনার জন্য খরচ করা হবে এমন নয়। আমি মনে করি, এই কর-ছাড় থেকে হাজার তিনেক কোটি টাকার বাড়তি চাহিদা তৈরি হবে।
অন্য দিকে, পরোক্ষ কর এবং পরিষেবা কর থেকে অর্থমন্ত্রী চল্লিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি বাড়তি আদায়ের হিসেব দিয়েছেন। এর ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। সুতরাং, আয়বৃদ্ধির গতি বাড়ানোর জন্য ভোগব্যয়ে উৎসাহ দেওয়ার যে প্রয়োজনটা ছিল, বাজেটে তা অপূর্ণ থেকে গিয়েছে। আর, মন্দাক্রান্ত বাজার যে ঘুরে দাঁড়াবে, এই আশাতেও বাজেট জল ঢেলে দিয়েছে। ৭.৬ শতাংশ আয়বৃদ্ধির আশা তাই আপাতত আশামাত্র।
ভোগব্যয় বিশেষ বাড়বে না, সেটা বোঝা গেল। বিনিয়োগ? বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার জন্য সরকার তেমন কিছুই করেনি। এমনকী পরিকাঠামোয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও যথার্থ উন্নতির ভরসা কম। এ ক্ষেত্রে অর্থ সংস্থানের সমস্যার সুরাহা করতে বাজেটে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু পরিকাঠামোয় বিনিয়োগের পথে অন্য অনেক বাধা আছে, যেগুলি দূর করা জরুরি। যেমন, জমি, অরণ্য, জনজাতি, পুনর্বাসন, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে সরকারি নীতির পরিবর্তন দরকার। সরকারি নীতি যাতে সুস্থির থাকে, সেই নীতির ওপর যাতে ভরসা করা যায়, সেটাও নিশ্চিত করা চাই। এই সব প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী নীরবতা পালন করেছেন। এক দিকে এই নীরবতা, অন্য দিকে আমাদের রাজনীতিতে অবিরত শোরগোল এর মধ্যে নতুন বিনিয়োগ?
যদি আমাদের কপাল ভাল হয়, তবে শিল্প উৎপাদনে মোটামুটি ৫ শতাংশ বৃদ্ধি আসতে পারে, তা-ও কয়লা, পেট্রোলিয়ম, সিমেন্ট, সার, ইস্পাতের মতো মৌলিক শিল্পগুলি যদি ঠিক ঠিক এগোতে পারে। এর সঙ্গে পরিষেবা ক্ষেত্রে যদি ৯ শতাংশ মতো আয়বৃদ্ধি ঘটে, তা হলে জিডিপি ৬.৫ শতাংশ বাড়বে বলে আমার ধারণা, ৭.৬ শতাংশ কোথা থেকে আসবে, আমি অন্তত বুঝতে পারছি না।
এ বার মূল্যস্ফীতির কথা। মূল্যবৃদ্ধির তেজ যদি আবার বাড়ে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আবার তেড়েফুঁড়ে সুদের হার বাড়াবে, অন্তত কমাবে না। ফলে ভোগব্যয় এবং বিনিয়োগে নতুন করে টান পড়বে, তার পরিণামে আয়বৃদ্ধির গতিও কমবে। মূল্যবৃদ্ধি বাড়ার দুটো গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। এক, বিশ্ব বাজারে পেট্রোলিয়মের দাম বেড়ে যেতে পারে, তার ফলে অন্য নানা পণ্যের দামও বাড়বে। দুই, আমদানি এবং রফতানির ফারাক বেড়ে গিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি বাড়তে পারে, তা হলে বৈদেশিক মুদ্রার, বিশেষত ডলারের দাম বাড়বে, ফলে মূল্যবৃদ্ধিতে নতুন ইন্ধন পড়বে। আর একটা ঝুঁকি আছে। বিদেশি মূলধনের প্রবাহে ভাটা পড়ার ঝুঁকি। যদি সেটা ঘটে, তা হলেও আবার টাকার দাম কমবে, ফলে মূল্যস্ফীতির তেজ বাড়বে। সব মিলিয়ে, এই বাজেট অর্থনীতিতে জোয়ার আনবে বলে ভরসা করা কঠিন।

একটি বেসরকারি সংগঠনে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.