অবশেষে তামিলনাড়ুর কুড়ানকুলামে প্রস্তাবিত পরমাণু জ্বালানি প্রকল্পের নির্মাণ মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম জয়ললিতার সবুজসঙ্কেত পাইয়াছে। রুশ সহযোগিতায় নির্মেয় ১২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরুও হইয়া গিয়াছে। প্রথমাবধি এই প্রকল্প নির্মাণের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দাদের সংগঠিত করিয়া পরিবেশবাদী ও এনজিও-রা বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতেছিলেন। রকমারি আন্দোলনের মধ্য দিয়া প্রকল্প বানচাল হওয়ার আয়োজন প্রায় সম্পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাও প্রকল্পের বিরোধিতায় দাঁড়াইয়া যাওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হইয়া ওঠে। শেষ পর্যন্ত জয়ললিতা প্রকল্প হইতে তাঁহার আপত্তি প্রত্যাহার করিয়া লওয়ায় চারি দিকে স্বস্তি।
আপত্তির পিছনে প্রধান কারণ অবশ্যই পরমাণু কেন্দ্রের আশেপাশে বসবাসকারীদের নিরাপত্তা এবং কৃষিজমি, মৎস্যচাষ প্রকল্প ইত্যাদির বিপন্নতার আশঙ্কা। চেরনোবিল এবং গত বছর জাপানের ফুকুসিমায় পরমাণু কেন্দ্রে সংঘটিত বিপর্যয় যে সর্বনাশ ঘনাইয়া তুলিয়াছিল, তাহার প্রেক্ষিতে পরমাণু বিদ্যুৎ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু একই কারণে পরমাণু কেন্দ্রগুলির নির্মাণ ও সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় অনেক বেশি সতর্কতাও অবলম্বন করা হইয়া থাকে। জ্বালানি হিসাবে ভূগর্ভস্থ তেল বা কয়লার ক্ষীয়মাণ সম্পদের বিকল্প হিসাবে সৌর ও পরমাণু বিদ্যুৎই যে ভবিষ্যতের চাহিদা মিটাইবার একমাত্র উপায়, তাহা লইয়া এখন আর বিশেষ বিতর্কও নাই। সৌর বিদ্যুৎ প্রভূত ব্যয়সাধ্য, তাহার প্রযুক্তিও সমুন্নত নয়। অন্য দিকে পরমাণু বিদ্যুতের উৎপাদনে রহিয়াছে বিকিরণের ঝুঁকি। তথাপি উন্নততর প্রযুক্তি এবং নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার সাহায্যে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়িয়া তোলার যে লক্ষ্যমাত্রা ভারত সরকার গ্রহণ করিয়াছে, কুড়ানকুলামে তাহাই রূপায়িত হইবে। পশ্চিমবঙ্গের হরিপুর এবং মহারাষ্ট্রের জয়িতাপুরে প্রকল্পের নির্মাণ-সম্ভাবনা আন্দোলনে বানচাল হইয়া গিয়াছে। তামিলনাড়ুতেও একই আশঙ্কা দেখা দিয়াছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার কাছে রাজ্যের বিদ্যুতের চাহিদা এবং তাহা মিটাইবার বাস্তব উপায়টি নির্বাচনী ইস্তাহারে নথিভুক্ত প্রতিশ্রুতির তুলনায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হইয়া ওঠে। গণ-আন্দোলনের আবেগে ভাসিয়া যাওয়ার চেয়ে বাস্তববোধ তাঁহার কাছে বেশি দরকারি মনে হয়। তিনি তাই নিজের আপত্তি প্রত্যাহার করিয়া লন।
পরমাণু বিদ্যুতের প্রয়োজন বা সমস্যা লইয়া বিতর্ক আছে, ফুকুশিমা-উত্তর দুনিয়ায় সেই তর্ক প্রবলতর। কিন্তু জয়ললিতার সিদ্ধান্তটি গুরুত্বপূর্ণ তাঁহার বাস্তবানুগ মানসিকতার কারণে। রাজনীতিকের যে দায় থাকে না, প্রশাসকের তাহা থাকে। তাই বিরোধী পক্ষে থাকা-কালে বিভিন্ন প্রশ্নে জঙ্গি বিরোধিতার অবস্থান লইলেও নির্বাচনে জিতিয়া আসিবার পর শাসক হিসাবে সেই অবস্থান হইতে কম-বেশি সরিয়া আসিতে বাধ্য হন। তখন তাঁহারা বুঝিতে পারেন, জনসাধারণের প্রয়োজন সর্বদা দলীয় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। রাস্তায় দাঁড়াইয়া স্লোগান দিবার সময় কিংবা মঞ্চে শাসকের বিরুদ্ধে তোপ দাগিবার সময় যাহা উচ্চকণ্ঠে বলা চলে, নিজে শাসক হইয়া তাহার অনেক কিছুই গিলিয়া ফেলিতে হয়। জয়রাম জয়ললিতা কেন্দ্রীয় শাসক জোট ইউপিএ-র শরিক নহেন। কিন্তু রাজ্যের উন্নয়নের জন্য বর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মিটাইতে হইলে ইউপিএ সরকারের পরমাণু বিদ্যুৎ কর্মসূচির রূপায়ণ যে আবশ্যক, ইহা উপলব্ধি করার মানসিকতায় তিনি ঋদ্ধ। বাস্তববোধ না থাকিলে শাসক হওয়ার যোগ্যতাও তৈরি হয় না। |