কলেজে পরীক্ষা ছিল। সময়মতো পৌঁছনোর জন্য এক জন ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনে ঝুলতে ঝুলতে রওনা হয়েছিলেন।
তাড়া ছিল অন্য জনেরও। এক আত্মীয়ের অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দেওয়ার তাড়া।
রেল অবরোধের জেরে প্রাণ গেল দু’জনেরই। দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে দু’টি আলাদা ট্রেনে উঠে ভিড়ের চাপে ছিটকে পড়ে মারা যান তাঁরা। সোমবার সকালে দু’টি দুর্ঘটনাই ঘটেছে দুর্গানগর স্টেশনে।
প্রাণ হাতে নিয়ে ভিড় ট্রেনে ঝুলতে ঝুলতে যাতায়াত করাই শিয়লাদহ-বনগাঁ শাখার যাত্রীদের বারোমাস্যা। গোদের উপরে বিষফোড়ার মতো সকালের ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টাখানেকের অবরোধ সেই পরিস্থিতিকে কতটা ভয়াবহ করে তুলতে পারে, ১৯ বছরের কলেজছাত্রী প্রিয়াঙ্কা সিংহ এবং ২৮ বছরের মির ইমান আলির মৃত্যু সোমবার তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
অফিসের ব্যস্ত সময়ে ট্রেন বাতিল হওয়ায় বারাসত স্টেশনে অবরোধ শুরু হয়েছিল। অবরোধ চলে প্রায় এক ঘণ্টা। রবিবারেও হাসনাবাদ শাখার তিনটি স্টেশনে অবরোধ হয়। কারণে-অকারণে রেল অবরোধ করার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে বারে বারেই সরব হয়েছেন সাধারণ মানুষ। মুমূর্ষু শিশুসন্তানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে আটকে পড়া এক যাত্রী বামনগাছি স্টেশনে একাই অবরোধকারীদের হটিয়ে দিয়েছিলেন। তার পরে বেশ কয়েকটি জায়গায় যাত্রীদের সম্মিলিত প্রতিবাদে পিছু হটতে হয়েছিল অবরোধকারীদের। এ দিন বারাসতের অবরোধেও প্রতিবাদ এসেছে কয়েক জন মহিলা যাত্রীর কাছ থেকে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরাও তাতে সামিল হন। কিন্তু তাতে কর্ণপাত করেননি হাজার দুয়েক অবরোধকারী। পুলিশও এগিয়ে আসেনি অবরোধ সরাতে।
ঠিক কী হয়েছিল এ দিন? |
পুলিশ জানায়, প্রিয়াঙ্কা বঙ্গবাসী কলেজ অফ কমার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তাঁর বাড়ি দুর্গানগরের বকুলতলায়। বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। ওই পরীক্ষায় পাশ না-করলে পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় বসা যায় না। এ দিন ৯টা নাগাদ ‘মহিলা স্পেশ্যাল’ ট্রেন ধরার জন্য দুর্গানগর স্টেশনে পৌঁছন তিনি। কিন্তু বারাসতে অবরোধ চলায় ট্রেনটি আটকে পড়ে। বাধ্য হয়েই প্রিয়াঙ্কাকে উঠতে হয় ভিড়ে ঠাসা মধ্যমগ্রাম-শিয়ালদহ লোকালে। বাদুড়ঝোলা ট্রেনটিতে কোনও মতে পা রাখতে পারলেও তাঁর শরীরের বেশির ভাগটাই ঝুলে ছিল দরজার বাইরে। ট্রেনটি প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার কয়েক সেকেন্ড পরেই ভিড়ের প্রচণ্ড চাপে হাত ফস্কে লাইনের ধারে ছিটকে পড়েন প্রিয়াঙ্কা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর।
দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি ঘটে বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ। অবরোধ উঠে যাওয়ার পরে বারাসত থেকে দুর্গানগরে আসার ট্রেনে উঠেছিলেন ইমান। সকালেই তিনি খবর পেয়েছিলেন, তাঁর এক পিসতুতো ভাই মারা গিয়েছেন। ভাইয়ের কবরে মাটি দিতে যাওয়ার তাড়ায় ভিড়ে গাদাগাদি করেও উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্গানগর স্টেশনে ট্রেন ঢোকার মুখেই ভিড়ের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন ওই যুবক। মুহূর্তে শরীর চলে যায় ট্রেনের চাকার তলায়।
দু’টি দুর্ঘটনারই প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অবরোধের জেরে দীর্ঘ ক্ষণ ট্রেন বন্ধ থাকায় এ দিন ট্রেনে ভিড় ছিল অস্বাভাবিক। কামরা উপচে বহু যাত্রীই বাইরে ঝুলছিলেন। দু’টি কামরার মাঝখানেও উঠে পড়েছিলেন অনেকে। দুর্গানগর স্টেশন থেকে প্রতিদিনই ট্রেনে ওঠানামা করতে হয় কার্যত প্রাণ হাতে নিয়েই। এ দিন এমন ভিড় ছিল যে, সে-ভাবেও উঠতে পারেননি বহু যাত্রী। অনেকেই বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু জরুরি পরীক্ষা থাকায় প্রিয়াঙ্কা ঝুঁকি নিয়েই ট্রেনের দরজায় ঝুলতে ঝুলতে রওনা দেন। সাধু মণ্ডল নামে রেললাইনের ধারের এক ঝুপড়িবাসী বলেন, “মেয়েটি কামরা থেকে ছিটকে পাশের একটি নালায় গিয়ে পড়ে। আমরাই নালা থেকে তুলি। দু’-এক বার নড়াচড়া করার পরেই ও নিথর হয়ে গেল।”
অন্য ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী রাজু বিশ্বাস স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওই যুবক বলেন, “ট্রেনটা সবে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছিল। দেখলাম, ভিতর থেকে ধাক্কার চোটে ছিটকে চাকার তলায় চলে গেল ছেলেটি। তার পরেই একটা শব্দ। ছুটে গিয়ে দেখি, ধড় আর মাথা আলাদা হয়ে গিয়েছে।” |
ইমানের বাড়িও দুর্গানগরের সাঁপুইপাড়ায়। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই শয্যা নিয়েছেন ইমানের বাবা। এক আত্মীয়ের মৃত্যুসংবাদ তো ছিলই। তার উপরে এমন দুঃসংবাদের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না পরিবারের কেউই। ইমানের স্ত্রী-পুত্র কয়েক দিন আগে তাঁর আটঘরার শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছেন। খবর পাঠানো হয় সেখানেও। একই চিত্র প্রিয়াঙ্কার বাড়িতেও। তাঁরা এক ভাই, এক বোন। তাঁর বাবার ব্যবসা রয়েছে। মেয়ের মৃত্যুর খবর শোনার পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রিয়াঙ্কার বাবা-মা।
কিন্তু এই অবরোধ কেন? পূর্ব রেলের কর্তাদের বক্তব্য, বারাসত-বসিরহাট ডবল লাইনের জন্য ওই শাখার সন্ডালিয়া স্টেশনে সিগন্যালের কাজ চলছে। সেই জন্য মঙ্গলবার থেকে ১৩ দিনের জন্য বাতিল করা হয়েছে সকাল ৮টা ১৫ মিনিটের শিয়ালদহমুখী বারাসত লোকাল। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও তা জানানো হয়েছে। কিন্তু ওই ট্রেন বাতিল করা যাবে না বলে দাবি তুলে এ দিন সকাল ৮টা নাগাদ বারাসত স্টেশনে প্রথমে স্টেশনমাস্টারের ঘরে চড়াও হন এক দল যাত্রী। পরে প্রায় দু’হাজার যাত্রী একই দাবিতে অবরোধ শুরু করেন। শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ ও বসিরহাট শাখার আপ ও ডাউন লাইনের সব ট্রেনই আটকে যায়। বারাসতের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন ম্যানেজার প্রদীপ পাল বলেন, “অবরোধের জন্য প্রায় এক ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়।”
ব্যস্ত সময়ে ওই যাত্রীরা অবরোধে বসলেন কেন? অবরোধকারীদের বক্তব্য, এমনিতেই ট্রেনের সংখ্যা না-বাড়ায় এই শাখার সব ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড় থাকে। প্রতিশ্রুতি থাকলেও চালু হয়নি ১২ কামরার ট্রেন। তাই অফিসের সময়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন বাতিল করা হলে যাত্রীরা ভীষণ বিপদে পড়বেন। সে-কথা ভেবেই তাঁরা অবরোধে সামিল হয়েছিলেন বলে তাঁদের দাবি। ওই অবরোধের ফলে বিভিন্ন স্টেশনে পরপর ট্রেন দাঁড়িয়ে যায়। এ দিন ছিল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। বিভিন্ন স্কুল-কলেজেও পরীক্ষা চলছে। ট্রেন না-পেয়ে পরীক্ষার্থীরা ছোটাছুটি করতে থাকেন। অনেকেই বিকল্প ব্যবস্থা করে রওনা হন সড়কপথে। কিন্তু সেখানেও যানজটে আটকে পড়তে হয় তাঁদের। কেউ কেউ উপায় না-দেখে স্টেশনে ফিরে আসেন। কয়েক জন মহিলা যাত্রী অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। অবরোধকারীরা তাতে রাজি না-হওয়ায় দু’পক্ষে ধাক্কাধাক্কিও হয়।
রেল পুলিশ ও রেলরক্ষী বাহিনী (আরপিএফ) ঘটনাস্থলে থাকলেও অবরোধ তুলতে উদ্যোগী হয়নি বলে অভিযোগ। পরে আসে জেলা পুলিশ। সওয়া ৯টা নাগাদ অবরোধ ওঠে। ফের ট্রেন চলাচল শুরু হয়। বিভিন্ন স্টেশনে আটকে থাকা ট্রেনগুলি একে একে ছাড়তে থাকে। যাত্রীদের অভিযোগ, ওই সময় ট্রেনে এমন মারাত্মক ভিড় হয় যে, বহু যাত্রীর চোট-আঘাত লাগে।
এ দিনের ঘটনার পরে বারবার প্রশ্ন উঠছে, এই প্রাণঘাতী অবরোধ করে কী লাভ? শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার তাপসরঞ্জন ঘোষ বলেন, “এই ঘটনায় অবরোধকারীদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে।” তবে এখনও কাউকে গ্রেফতার করেনি রেল পুলিশ। দু’-দু’টি মৃত্যুর পরে অবশ্য ট্রেন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নিয়েছেন রেল-কর্তৃপক্ষ। শিয়ালদহের ডিআরএম সুচিত্র দাস বলেন, “উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন লোকাল ট্রেনগুলি বাতিল করা হবে না বলে এ দিনই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।” |