সাফল্যের গ্যারান্টি থাকলে স্যর ডন ৯৯.৯৪ নিয়ে ফেরেন না
মনিতেই পাকিস্তানকে হারিয়ে ওঠার পরের দিন। বিকেল পর্যন্ত কিছু না কিছুতে আটকে থাকতেই হচ্ছিল। তার উপর সন্ধেয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আমন্ত্রণে তাঁর বাড়িতে। পুরো টিম নয়। আমন্ত্রিত তিনি একা। সেখান থেকে বেরিয়ে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের পার্টি। প্রবল ব্যস্ত সূচির মধ্যেও সচিন তেন্ডুলকর সোমবার শততম সেঞ্চুরির বিশেষ সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজার-কে।
প্রশ্ন: ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জোড়া উৎসবের ছবি। প্রথমে আপনার শততম সেঞ্চুরির মহাকীর্তি। তার পর ৩২৯ তাড়া করে পাকিস্তানকে হারানো। কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন মুহূর্তটাকে?
সচিন: অসাধারণ মুহূর্ত। খুব উপভোগ করছি।
প্র: গত কয়েক মাস যে রকম অন্ধকার দিয়ে যেতে হচ্ছিল, সেটা ভেবে কি আরও বেশি তৃপ্তি হচ্ছে?
সচিন: স্বীকার করে নেব, গত ক’মাস ভাল যায়নি। একই সঙ্গে এটাও বলব যে, জীবনে একটা লোককেও দেখিনি যে কখনও খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যায়নি। শুধু ক্রিকেট মাঠে বলে নয়, জীবনের রাস্তাতেও সবাইকে একই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। হয়তো জীবনের সেই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের ক্রিকেটের মতো মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে বড় করে দেখানো হয় না। জীবনে উত্থান-পতন তো থাকবেই। আপনাকে দেখতে হবে, যা ঘটছে সেটাকে দু’হাতে গ্রহণ করে নিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে লোকটা ঝিমোচ্ছে? নাকি সত্যিই অন্ধকার থেকে বেরনোর রাস্তা খুঁজছে? যদি সেটা দেখার চেষ্টা করেন তা হলে দেখবেন, আমরা সেই চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু জীবনে কিছু কিছু সময় যায় যখন আপনি যত আপ্রাণ চেষ্টাই করুন, সমস্যার সমাধানটা যেন হতে চায় না। আমাদেরও সে রকম একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছিল। পৃথিবীতে এমন কোনও ফর্মুলা তো আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি যেটা আপনাকে আগে থাকতে ১০০ শতাংশ গ্যারান্টি দিয়ে দেবে যে, আপনি চেষ্টা করছেন মানে ঠিক আছে, তা হলে আপনি সফল হবেনই। এ রকম তো কোনও সওদা হতে পারে না। আপনার কাজ হল, সফল না হলেও বারবার আরও পরিশ্রমী, আরও জেদি, আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসা।
শুনুন, জীবনে সাফল্যের কোনও গ্যারান্টি হয় না। যদি হত তা হলে স্যর ডন ব্র্যাডম্যানকে ৯৯.৯৪ গড় রেখে ফিরতে হত না। ব্র্যাডম্যানের কাছে শেষ ইনিংসে চার রান কোনও ব্যাপার! যে লোকটা ইচ্ছে মতো একশো করে গিয়েছে। অথচ শেষ ইনিংসে তাঁর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলেন না। এটাই জীবন।
প্র: এত দিন ডনের ৯৯.৯৪-ই ছিল ক্রিকেটের সবথেকে আলোচিত সংখ্যা। এখন আপনার আপনার ১০০X১০০ একই রকম চর্চিত হতে থাকবে। দু’টো পাশাপাশি রেখে আপনার মধ্যে কী অনুভূতি হচ্ছে?
সচিন: স্যর ডনের ৯৯.৯৪ টেস্ট গড় একটা অভাবনীয় প্রাপ্তি। শুধু আমি একা নই, সারা পৃথিবী সেই প্রাপ্তি নিয়ে কথা বলে। ৯৯.৯৪ সব সময়ই খুব স্পেশ্যাল থাকবে।
প্র: ক্রিকেট দিয়ে কি তা হলে সত্যিই জীবনকে ব্যাখ্যা করা যায়?
সচিন: অবশ্যই ব্যাখ্যা করা যায়। যখন আপনাকে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আর আপনাকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। লোকে ধরে নেবে আপনি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছেন। বলে বেড়াবে, আর আপনাকে দিয়ে কিছু হবে না। আর আপনি সফল হয়ে তাদের চমকে দেবেন। মাঝেমধ্যে লোককে চমকে দেওয়াটা মনে হয় খারাপ নয়।
প্র: শততম সেঞ্চুরি করে বলেছিলেন, গত এক বছর জীবনের সবথেকে কঠিন সময়। এ সব কারণেই কি বলেছিলেন?
সচিন: না, আসল কারণ হচ্ছে এক বছর ধরে আমি সেঞ্চুরি করিনি। আর এই এক বছরে যত বার ব্যাট করতে গিয়েছি, প্রত্যেকটা সময় দেখেছি মানুষের চোখেমুখে হতাশা। সবাই রোজ আশা করে বসে আছে আমার শততম সেঞ্চুরি আজ হবে আর সেটা হচ্ছে না। সেটা দেখে আমারও খুব খারাপ লাগত। এর পাশাপাশি, অনেকে নানা রকম মন্তব্য করে যাচ্ছিল। আমার এটা করা উচিত না, ওটা করা উচিত। সবাই খুব স্বচ্ছন্দে ভুলে যাচ্ছিল যে, আমি এর আগে ৯৯টা সেঞ্চুরি করেছি। এরা কেউ ক্রিকেট এক্সপার্ট। কেউ প্লেয়ার। সবাই উপদেশ দিতে শুরু করে দিল, কী ভাবে সেঞ্চুরি করতে হয়। ভুলে গেল যে লোকটাকে উপদেশ দিচ্ছে, তার ৯৯টা সেঞ্চুরি আছে!
প্র: এদের কারও কারও সঙ্গে অতীতে একই ড্রেসিংরুমে কাটিয়েছেন দেখে কি আরও খারাপ লাগছিল? কোনও সাংবাদিক কিছু লিখল সেটা এক ব্যাপার। কিন্তু কোনও প্রাক্তন সতীর্থ যখন বলে তখন তো ব্যাপারটাই অন্য রকম হয়ে দাঁড়ায়।
সচিন: ক্রিকেটীয় লোক, কী অক্রিকেটীয়। অন্যরা কী লিখছে তা নিয়ে যেমন আমার কোনও কৌতূহল নেই তেমন এই প্লেয়ারগুলো কী বলছে সেটা নিয়েও আগ্রহ নেই। আমাকে এ সব কোনও ভাবে ভাবায় না। আমি জানি আমি কোন কোন প্লেয়ারকে সম্মান করি। আর সেই ব্র্যাকেটে খুব বেশি প্লেয়ার আসবে না। আমি এদের নিয়ে ভাবতেই চাই না। আমার প্লেটে এই সব প্লেয়ারদের ক’টা মন্তব্যের চেয়ে সুস্বাদু খাবার আছে। সেটা হচ্ছে দেশের হয়ে খেলা আর রান করে যাওয়া। আমার মনে হয় ব্যাট হাতে দেশের হয়ে পারফর্ম করাটা পেন হাতে কিছু মন্তব্য লিখে দেওয়ার চেয়ে বেশি দায়িত্ববোধের পরিচয়। মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় ধুর, এদের মন্তব্য নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়াই দেখানো উচিত নয়।
আমি জানি আমাকে আক্রমণ করতে থাকা ওই লোকগুলোর মধ্যে খুব সিনিয়র কিছু নাম আছে। আমার সমালোচনা করার সময় এরা সবার আগে লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে। কিন্তু একই লোক যখন কোনও ক্রিকেটীয় কীর্তি স্থাপন করবে অভিনন্দন জানিয়ে একটা মেসেজ পর্যন্ত আসবে না। এই লোকগুলোর মানসিকতা তো এটা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি ওদের নিয়ে কী ভাবব! ওদের নিজেদেরই উচিত নিজেদেরকে নিয়ে ভাবা।
ব্যাটিং যদি শিল্প হয়, তা হলে
সচিন হল পিকাসো।


-গ্রেগ চ্যাপেল
প্র: এরা কারা...
সচিন: কোনও নাম নেব না। ওটা ওদের ধর্ম হতে পারে। আমার নয়।
প্র: তা হলে শততম সেঞ্চুরির জন্য যে মেসেজগুলো পেলেন সেগুলো নিয়ে বলুন...
সচিন: প্রচুর মেসেজ পেয়েছি। কোন মেসেজটার ভাষা সবথেকে ভাল সেটা বড় কথা নয়। এটা একটা অনুভূতির ব্যাপার। এবং প্রত্যেকটা মেসেজই আমার কাছে একটা বিশেষ অনুভূতি। যদি কেউ একটা ছোট্ট ‘ওয়েল ডান’-ও পাঠিয়ে থাকে সেটার গুরুত্বও আমার কাছে অপরিসীম। একটা একশো শব্দের মেসেজকে যেমন সম্মান করি, তেমন দু’টো শব্দকেও করি।
প্র: এই যে হোটেলের ঘরে একা একা কাটানো...সব জায়গায় পরিবার থাকে না...তখন শততম সেঞ্চুরির চাপটা আরও অসহনীয় লাগত না?
সচিন: ভীষণ ভাবেই লাগত। রুম সার্ভিস অর্ডার করেছি। খাবার দিতে যে এসেছে, সে বলছে হান্ড্রেড্থ সেঞ্চুরির কথা। লন্ড্রি দেব বলে ডেকেছি। যে ছেলেটা এসেছে সে বলছে, স্যর, আজ হান্ড্রেড্থ সেঞ্চুরি করনা হ্যায়। আমার অনেক হাল্কা লাগছে যে, ব্যাপারটা হয়ে গেছে। এখন নিশ্চয়ই মতামতগুলোও অদৃশ্য হয়ে যাবে যে, আমার এটা করা উচিত। আমার এটা করা উচিত নয়। আমি এখন হাল্কা। যাক, মতামতগুলোও বিশ্রাম করুক।
প্র: এই মন্তব্য, মতবাদ, আক্রমণগুলো আপনাকে ব্যথিত করে?
সচিন: না, এগুলোকে তো আমি বুকের মাঝে স্থানই দিই না। শুধু আমি যাদের সম্মান করি তারা কিছু বললে মনে আঘাত পাওয়ার প্রশ্ন থাকে। কতগুলো লোকের কী মনে হয়েছে সেটা নিয়ে তারা বলছে বা লিখছে...তাতে আমি নিজেকে আঘাত পেতে দেব কেন? তার চেয়ে আমি নিজের কাজ করে যাই। স্কুলজীবন থেকে আমি এ ভাবেই বড় হয়েছি। এক্স-ওয়াই-জেড কী বলছে তা নিয়ে এখনও ভাবি না।
প্র: শততম সেঞ্চুরির সেলিব্রেশন কী হল?
সচিন: সেলিব্রেটই করিনি সে ভাবে। কেক কাটা হয়েছে। শ্যাম্পেন খোলা হয়েছে। পার্টি-টার্টি কিছু হয়নি। এশিয়া কাপটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর কিছু হতে পারে। তখন মাথায় পরের ম্যাচে কী হবে সেই ভাবনাটা থাকবে না তো। একমাত্র তখনই খোলা মনে সেলিব্রেশন করতে পারব।
প্র: সাড়ে তেইশ বছর আগে করাচিতে যখন টেস্ট অভিষেক ঘটাতে নামছিলেন তখনও কি মাথায় ছিল আমায় লম্বা খেলতে হবে? আমি এতগুলো সেঞ্চুরি করতে চাই?
সচিন: প্রথম টেস্টের অনুভূতিটাই অন্য রকম ছিল। ভীষণ স্পেশ্যাল একটা মুহূর্ত হিসেবে থেকে যাবে সেটা। পাকিস্তানে খেলতে যাচ্ছি অভিষেক সফরে। একদম টগবগ করছিলাম। স্বপ্ন সফল হওয়ার মতো ছিল। ওই সময় ভাবার সুযোগ ছিল না যে, আমি সাড়ে তেইশ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাটিয়ে দেব। তেইশ বছর দূরের কথা, দশ বছর পর কী হবে সেটা নিয়ে পর্যন্ত ভাবিনি।
প্র: অভিষেক সফরের কোনও স্মারক আছে আপনার কাছে?
সচিন: আমি খুব একটা স্মারক রাখি না। কোনও দিনই এ ব্যাপারে আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তাই প্রথম সফরেরও কিছু নেই।
প্র: শততম সেঞ্চুরির ম্যাচের কোনও স্মারক নিশ্চয়ই রেখেছেন।
সচিন: আরে না তো! আমি কিছুই নিইনি। মনেই ছিল না! এই আপনি মনে করালেন।
প্র: বলছেন কী? কিছুই না?
সচিন: ম্যাচ থেকে কিছুই রাখিনি। আমার খেয়ালই ছিল না। এখন মনে হচ্ছে, গ্রাউন্ডসম্যানের কাছ থেকে একটা স্টাম্প চাইতে হবে, যদি থেকে থাকে।
প্র: সাড়ে তেইশ বছরের এই ক্রিকেট যাত্রায় সেরা প্রাপ্তি কী?
সচিন: বিশ্বকাপ। দ্বিতীয় কোনও ভাবনার জায়গাই নেই। আঠাশ বছর ধরে দেশের মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমাদেরও অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর পাশে কোনও কিছুই আসতে পারে না।
প্র: বিশ্বকাপ জিতে আপনি কী ভাবে সেলিব্রেট করলেন সেটা কেউ জানতে পারল না। আজ বলে দিন...
সচিন: ঠিক আছে...বলছি...আসল সেলিব্রেশনটা করেছিলাম বিশ্বকাপ জেতার দিন দুই পরে। অঞ্জলি খুব তাড়াহুড়ো করে একটা পার্টির আয়োজন করল। শুধু আমাদের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে। পুরো পার্টিটা আয়োজন করা হয়েছিল এসএমএস আর বিবিএম-এ। মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে। একটাই কমন মেসেজ পাঠানো হচ্ছিল সবাইকে টুনাইট উই আর মিটিং। সেলিব্রেট!!! দেড়শো জন মতো বন্ধুকে পাঠানো হয়েছিল। তারা সবাই তো এসেছিলই, আরও অনেকে খবর পেয়ে চলে আসে। অসাধারণ একটা সন্ধ্যা আমরা কাটিয়েছিলাম।
প্র: আপনার অভিষেক টেস্ট ম্যাচের সেই স্কোরবোর্ডটা দেখছিলাম। সেই ম্যাচের অন্যান্য প্লেয়াররা কেউ আইপিএল টিমের বোলিং কোচ। কেউ দেশের কোচিং করিয়ে কমেন্ট্রি বক্সে ঢুকে পড়েছেন। কেউ সাংসদ। আপনি এখনও খেলে চলেছেন শুধু না, পাকিস্তান-ম্যাচে স্কুপ শট মারছেন!
সচিন: আমার মনে হয় আমি যেখানে আছি সেখানেই সবথেকে ভাল আছি (হাসি)।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.