|
|
|
|
আরও ২৫ টানব, আশা শতায়ু মনোহরের |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
খেলার ছলে হাতি হয়তো লুফতেন। কিন্তু ক’দিন বেঁচেছিলেন ষষ্ঠীচরণ, জানা নেই। মনোহর আইচ হাতি লোফেননি ঠিকই। কিন্তু তিনি একশো বছর পার করলেন।
হাতি না হলেও ৪ ফুট ১১ ইঞ্চির মানুষটি ৯৫ বছর বয়স পর্যন্ত হেলায় ওজন তুলেছেন। আর এখন, ১০০ বছর বয়সেও বাড়ির সামনে হনহন করে হেঁটে বেড়ান। হাতের গুলি ফুলিয়ে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। তার পর চোখ নাচিয়ে বলেন, “এখনও শরীর-স্বাস্থ্য যা বুঝছি, আরও বছর ২৫ এ ভাবেই টেনে দিতে পারব।”
কোনও বাঙালির শতায়ু হওয়া আর সচিন তেন্ডুলকরের শতরানের সেঞ্চুরি এই দুইয়ের মধ্যে কোথায় যেন এক অদৃশ্য মিল রয়েছে। নব্বইয়ের গেরো পেরিয়ে ১০০ রানে পৌঁছতে সচিন যেমন বার বার ‘নার্ভাস’ হয়ে যেতেন, তেমনই নব্বই থেকে ১০০-য় পৌঁছনোর আগে বেশির ভাগ বাঙালিই ‘অতি বৃদ্ধের’ তকমা নিয়ে ক্রিজ ছেড়ে দেন। সেঞ্চুরি করা বড় একটা হয়ে ওঠে না।
মনোহর আইচের আগে শতায়ু বাঙালি হিসেবে হাতের সামনে শেষ উদাহরণ ছিলেন লীলা মজুমদার। সে বছর পাঁচেক আগের কথা। তারও আগে যাঁরা ১০০ বছর পার করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নীরদচন্দ্র চৌধুরী, উস্তাদ আলাউদ্দিন খান, শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ, প্রভুদয়াল হিম্মতসিংকা। নাম মাহাত্ম্যে ‘বিখ্যাত’ হয়েছিলেন আরও এক শতায়ু বাঙালি, কলকাতার একটি মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হরিদাস পাল। শতরানের খুব কাছে এসেও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি অন্নদাশঙ্কর রায় (৯৮), হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (৯৭), স্বামী ভূতেশানন্দ (৯৭) ও স্বামী রঙ্গনাথানন্দ (৯৭)। |
|
বিকেলের কফি পান। ছবি: অশোক মজুমদার। |
২০০৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি শতায়ু হন লীলা মজুমদার। সে দিন থেকেই ওয়েটিং লিস্টে থাকা মনোহর আইচের পরিবার বিশ্বশ্রীর সেঞ্চুরির অপেক্ষায় দিন গুনতে শুরু করেছিল। সেই স্বপ্ন অবশেষে সফল হল। শনিবার ১০০ বছর পূর্ণ করলেন এই ব্যায়ামবীর। বাঙালি না হলেও বাঙালির কাছে পরিচিত নাম হিসেবে অভিনেত্রী জহরা সেহগলের শতবর্ষ এই বছরেই। এখনও তিনি অভিনয় করেন। সাংবাদিক খুশবন্ত সিংহ ১০০ বছরে পা দেবেন ২০১৪-য়।
শেষ কয়েকটা বছর লীলা মজুমদার লোকজন চিনতে পারতেন না। যদিও দেখতে পেতেন, শুনতে পেতেন। কিন্তু মনোহর আইচ এ সব হিসেব গুলিয়ে দিতে পারেন। এখনও ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙে তাঁর। চশমা ছাড়াই খবরের কাগজ পড়েন। ছেলেরা জিমন্যাশিয়াম চালান। মনোহরবাবু এখনও সেই জিমের প্রাণপুরুষ। প্রাতরাশ সেরে সকালে সেখানে গিয়ে বসেন। এখন আর হাতে-কলমে কাউকে কিছু শেখাতে না পারলেও মৌখিক পরামর্শ দেন প্রতি পদক্ষেপে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে দু’ঘণ্টা ঘুম তাঁর বাঁধা। বছর দেড়েক আগে একটা স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে। তার পর থেকে ব্যায়াম বন্ধ। তবে বিকেলে বাড়ির সামনে বেশ কিছু ক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে গল্পগুজব, কখনও কীর্তন শোনেন। রাতে ন’টার মধ্যে খাওয়া শেষ। সাড়ে ন’টায় বিছানা। “অন্তত আট ঘণ্টা ঘুম খুব জরুরি। শরীর একটা যন্ত্র, তাকে নিয়মিত বিশ্রাম না দিলে সে বিগড়ে যাবে। এটা সবাই জানে। কিন্তু অনেকেই মানে না। তাদের কপালে ভোগান্তি থাকে।” স্টিলের প্লেটে কফি ঢেলে, তাতে বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে খেতে বললেন তিনি।
|
সেঞ্চুরির দৌড়ে |
রমাপদ চৌধুরী ৯০ |
স্বামী আত্মস্থানন্দ ৯৩ |
মান্না দে ৯৩ |
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ৯২ |
বিজয়া রায় ৯৫ |
|
পাশেই ছিলেন মেয়ে বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, “পৃথিবী এক দিকে, আর বাবার ঘুম এক দিকে। হয়তো বাড়িতে কোনও সমস্যা চলছে। আমরা সকলে সেটা নিয়েই আলোচনা করছি। হঠাৎ শুনি নাক ডাকছে। বাবার তখন ঘুমের সময় হয়ে গিয়েছে। তাই পার্থিব কোনও সমস্যায় তাঁকে আর তখন পাওয়া যাবে না।”
মনোহরবাবু মৃদু হাসলেন। “এটাই হল ডিসিপ্লিন! অনেক লড়াই করেছি জীবনে, কিন্তু এর সঙ্গে আপস করিনি কখনও। জীবনে এক দিনও মদ ছুঁইনি। সিগারেট খেয়েছিলাম কিছু দিন। তার পর মনে হল, আত্মঘাতী কাজ করে কী লাভ? ছেড়ে দিয়েছি।” অনেকটা যেন সেই কথারই প্রতিধ্বনি, যা বলেছিলেন জ্যোতি বসুকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে। জ্যোতিবাবুর তখন প্রায় শেষ অবস্থা। তাঁর থেকে বয়সে বড় মনোহর আইচ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সামনে পেশি ফুলিয়ে বলেন, “ডিসিপ্লিন! ডিসিপ্লিন! আমার সংযম আছে। জীবনে খাওয়া, চলাফেরা সব কিছুতেই সংযম দরকার। তবেই মানুষ সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকতে পারে।”
জেরেন্টোলজিস্টরা বলছেন, দীর্ঘ জীবন কিছুটা জিনের উপরে নির্ভরশীল। কিছুটা জীবনযাত্রার উপরে। একটা সময়ে ভারতীয়দের গড় আয়ু ছিল ৩৫ বছর। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আয়ু। মানুষ ভাল ভাবে বেশি দিন বেঁচে থাকার অনেক উপায়ও আয়ত্ত করেছে। জেরেন্টোলজিস্ট দিলীপ চক্রবর্তীর কথায়, “পরিমিত আহার আর ব্যায়াম করে শরীরটাকে ঠিক রাখতে অনেকেই পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হল মন। সেটাকে ঠিক রাখাই দীর্ঘ আয়ুর রহস্য। টেনশন চলবে না কোনও পরিস্থিতিতেই।” কিন্তু মনোহর আইচ তো সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মাননি। তিনি দারিদ্র দেখেছেন। খুব স্বচ্ছল অবস্থা তাঁর কোনও দিনই ছিল না। ‘পকেট হারকিউলিস’ নামে পরিচিত শতায়ু বিশ্বশ্রীকে বরং আজন্ম লড়তেই হয়েছে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই পেশি চর্চার প্রতি আকর্ষণ জন্মেছিল মনোহরের। ১৯৪২ সালে তিনি যোগ দেন রয়্যাল এয়ার ফোর্সে। সেখানে নিয়মিত শরীরচর্চার সুযোগ পেতেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন-কর্তৃপক্ষের ঔপনিবেশিক মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় জেলে যেতে হয় তাঁকে। মনোহরবাবুর কথায়, “সেটা অবশ্য শাপে বর হয়েছিল। জেলে কিছু করার ছিল না। দিনে ১২ ঘণ্টা শরীরচর্চা করেই কাটিয়ে দিতাম। যন্ত্রপাতি ছাড়া।” শরীরচর্চায় তাঁর এই ভালবাসাকে জেল-কর্তৃপক্ষ সম্মান জানিয়েছিলেন। বিশ্বশ্রীর কথায়, “ওরা আমার জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করেছিল।” |
দীর্ঘদিন সুস্থ ভাবে বাঁচতে |
• প্রাণ খুলে হাসুন, হাসলে মন ভাল থাকে |
• হাসি এক ধরনের ব্যায়াম, ক্যালোরিও ঝরে |
• বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিন |
• দাম্পত্য জীবনে সুখী থাকার চেষ্টা করুন |
• সেতার, সরোদ বা কোনও যন্ত্র বাজান |
• বাড়িতে কোনও পোষ্য রাখুন |
• পরিমিত আহার করুন, ওজন বাড়া চলবে না |
• বাড়িতে অফিসের কাজ নয় |
• ধূমপান, মদ্যপান বন্ধ |
• একাগ্রতা বাড়াতে ধ্যান |
মনোহর আইচের টোটকা |
|
১৯৫২ সালে তিনি বিশ্বশ্রী খেতাব পেয়েছিলেন। তার পরেও লড়াই থামেনি। ১১ বছর আগে স্ত্রীর মৃত্যু তাঁকে অনেকটাই একা করে দিয়েছে। তাঁর এতদিন সুস্থ হয়ে বাঁচার মূল রেসিপি যে সুখী বৈবাহিক জীবন সে কথা বার বার মনে করিয়ে দিয়েও ১০০ বছরের যুবক বলছেন, “সত্যকে সহজ ভাবে স্বীকার করতেই হবে। আমিও মেনে নিয়েছি ওই মৃত্যু।”
পুজো-আচ্চায় বিশ্বাস নেই। বিশ্বাস নেই জ্যোতিষেও। স্ট্রোকের পরে মেয়ে একটা মুক্তোর আংটি পরিয়েছেন। কিন্তু নিজেই বললেন, “ও সবে কিস্যু হয় না। আর পুজোটুজোতেই বা কী হবে? নিজের কাজ, নিজেই বাছ!”
জীবনে কখনও হারেননি?
বিজেপির প্রার্থী হিসেবে লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন এক বার। হেরে গিয়েছিলেন।
তবে রাজনীতি তাঁর মনে কোনও প্রভাবই ফেলতে পারেনি বলে দাবি তাঁর। যদিও বিজেপির শীর্ষ নেতারা এখনও মনে রেখেছেন তাঁকে। লালকৃষ্ণ আডবাণী বলেন, “অবিশ্বাস্য! ওঁকে দীর্ঘদিন জানি। উনি শতায়ু হলেন, আমি তো এটা ভাবতেই পারি না। ওঁর দেহমন্দিরের ভাস্কর্য আমাদের কাছে বিস্ময়। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি উনি সুস্থ থাকুন।”
আর একটা জায়গাতেও তিনি হেরে গিয়েছেন বলে মনে করেন মনোহর আইচ। সেটা কী? বললেন, “রাগ। রাগকে জয় করতে পারিনি অনেক সময়েই। সেটা করতে পারলে ১০০-য় ১০০ নম্বর পাওয়া উচিত।” ১০০ বছর বেঁচে থাকার রহস্যটা কী? বৃদ্ধ হাসেন। হাতের টানটান চামড়ায় হাত বুলিয়ে, ট্রাইসেপ দেখিয়ে বলেন, “সুখী থাক, হাসিখুশি থাক। আর...।”
আর? এক গাল হেসে বললেন, “আর ওই পান্তা। পান্তা ভাতের জল, তিন জোয়ানের বল!”
|
|
২৫ থেকে ৬০ বছর |
• সকালে এক কাঁসি পান্তা ভাত |
• দুপুরে ভাত, ডাল, প্রচুর শাক-সব্জি, চুনো মাছ, দুধ |
• খাওয়ার পরে যে কোনও একটা ফল |
• রাতে পান্তা ভাত, মসুর ডালের বড়া, শুকনো লঙ্কা ভাজা |
• শেষ পাতে দুধ |
৬০ থেকে ৯০ বছর |
• সকালে এক কাঁসি পান্তা ভাত |
• দুপুরে ভাত, ডাল, সব্জি, এক টুকরো মাছ অথবা দু’টুকরো মুরগির মাংস, দুধ |
• খাওয়ার পরে একটা কলা |
• রাতে ভাত, ডাল, অল্প সব্জি, পাতলা মাছের ঝোল, দুধ |
|
৯০ বছরের পর থেকে |
• সকাল ৮:০০:
এক কাপ কফি, ২টি বিস্কুট |
• সকাল ৯:০০:
দুধ, চিঁড়ে সেদ্ধ |
• দুপুর ১২:০০:
ভাত, ডাল, গলানো সব্জি, পাতলা মাছের ঝোল |
• দুপুর ১২:৩০:
একটি পাকা কলা |
• বিকাল ৪:৩০:
এক কাপ কফি, ২টি বিস্কুট |
• রাত ৮:৩০:
ভাত, পাতলা মাছের ঝোল, শেষ পাতে দুধ |
|
|
|
|
|
|