ছেলের কাছে পড়ে ছোটদের পড়াচ্ছেন আদিবাসী বধূ
লে কুমির, ডাঙায় বাঘ, ঘরে অভাব।
সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত এলাকায় জালে ঘেরা ঘরে বসে এ সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এলাকার আদিবাসী ছেলেমেয়েদের ‘লড়াই’ শেখাচ্ছেন সীতারানি মালি।
‘লড়াই’ অশিক্ষা আর দারিদ্রের বিরুদ্ধে। এবং নিজের সঙ্গেও।
হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের ২ নম্বর সামশেরনগর গ্রামের আদিবাসী বধূ সীতারানির দু’চোখে অনেক স্বপ্ন। ছোট ছেলে সঞ্জয়কে এম এ পাশ করাতে হবে। শিক্ষিত করতে হবে এলাকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও। সীতারানি তাই প্রতিদিন নিয়ম করে নিখরচায় প্রাথমিকের পাঠ দিচ্ছেন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের। যাতে বড় হয়ে তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে, নিজেদের ভালমন্দ বুঝতে পারে। যাতে জলের কুমির আর ডাঙার বাঘের আতঙ্ক নিয়ে জঙ্গল থেকে কাঠ, মাছ বা কাঁকড়া জোগাড় ছেড়ে বিকল্প কোনও জীবিকার সন্ধান করতে পারে। এ জন্য নিজেও ছোট ছেলের কাছে পড়াশোনা শেখেন।
ছোটদের প্রাথমিকের পাঠ দিচ্ছেন সীতারানি। নিজস্ব চিত্র
অর্থাভাবে পঞ্চম শ্রেণির পরে আর স্কুলে পড়া হয়নি সীতারানির। কিন্তু তিনি পড়াশোনা থামাননি। সীতারানির কথায়, “এখানে খুব কষ্টে দিন কাটাতে হয়। যে কোনও সময় বাঘ হামলা করতে পারে। যে টুকু পড়াশোনা করেছি, বুঝেছি, শিক্ষা ছাড়া কিছু হয় না। তাই চাই আমার ছোট ছেলেটা এম এ পাশ করুক। আর এলাকার ছেলেমেয়েগুলো যাতে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তার জন্য একটু সাহায্য করি মাত্র।”
মাঝখানে কুঁড়েখালি নদী। এক পাড়ে সুন্দরবনের আঁড়বেসে জঙ্গল। অন্য পাড়ে লোকালয়। জঙ্গল থেকে দূরত্ব মেরেকেটে ৩০ ফুট। নদীর ধারেই সীতারানির বাড়ি। লোকালয়ে বাঘের আনাগোনা ঠেকাতে নদীর ধার জালে ঘিরেছে বন দফতর। সীতারনির মতো অনেকেই বাঘের হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের বাড়িও জালে ঘিরেছেন।
তবু অনেক সময়েই বাঘ লোকালয়ে চলে আসে।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গল থেকে জ্বালানি কাঠ, মাছ এবং কাঁকড়া সংগ্রহ করে সংসার চালান বছর পঁয়তাল্লিশের সীতারানি। এ ছাড়া, বাড়িতেই একটি মুদি দোকান খুলেছেন। ভোর হওয়ার আগেই চলে যান জঙ্গলে। ফিরতে সকাল ৮টা বেজে যায়। তার পরে সাংসারিক কাজ। এর ফাঁকেই নিজের পড়াশোনা আর নিখরচায় এলাকার ছেলেমেয়েদের পড়ানো।
স্বামী দুখেরাম মালি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। মাধ্যমিক পাশ করার পরে পড়াশোনা ছেড়ে বড় ছেলে সুব্রত কাজের খোঁজে বেঙ্গালুরু চলে গিয়েছে। অর্থাভাবে মেজো ছেলে সুশান্তকে চতুর্থ শ্রেণির বেশি পড়াতে পারেননি সীতারানি। সে জনমজুরি করে। সীতারানির এখন যাবতীয় স্বপ্ন ছোট ছেলে সঞ্জয় এবং এলাকার ছেলেমেয়েদের ঘিরে।
সঞ্জয় স্থানীয় গোবিন্দকাটি হাইস্কুলের ছাত্র। সে জানে তার মায়ের স্বপ্নের কথা। সঞ্জয়ের কথায়, “মা বলে, জীবনে কিছু করতে হলে পড়াশোনা জরুরি। মা এখনও প্রতিদিন আমার কাছ থেকে পড়াশোনা শেখে। জানার ইচ্ছে প্রবল। মা বলে, মাছ-কাঁকড়া ধরে সংসার চলবে না। আমাকে চাকরি পেতে হবে।”
ওই এলাকাতেই বাপেরবাড়ি সীতারানির। বছর ২০ আগে বিয়ে হয়। প্রথম দিকে ভাসুর-ননদের ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। পাড়ার মহিলাদেরও পড়াশোনা শেখানোর চেষ্টা করেছেন। সফল হননি। ওই সব মহিলাদের ছেলেমেয়েরাও তাঁর কাছে প্রথম দিকে আসতে চাইত না। হাল ছাড়েননি সীতারানি। পাড়ার বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েছেন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। এখন সীতারানির ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৩৫।
সীতারানির বাড়ির কাছেই আদিবাসী শিশু শিক্ষাকেন্দ্র। সেখানে এলাকার ছেলেমেয়েরা পড়তে যায়। আর সকাল-সন্ধে চলে আসে ‘দিদিমণি’ সীতারানির বাড়িতে। স্থানীয় বাসিন্দা ভবেশ মাহালির কথায়, “দিদিমণি যে ভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে পড়ান, তাতে আমরা কৃতজ্ঞ।” আর এক বাসিন্দা নিতাই সর্দার বলেন, “আমি তো আর ছেলেমেয়েদের সে ভাবে দেখতে পারি না। দিদিমণি বড় ভরসা দিয়েছেন।” সীতারানির এই শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টার কথা প্রশাসনের কাছেও পৌঁছেছে। হিঙ্গলগঞ্জের বিডিও ইন্দ্রকুমার নস্কর বলেন, “আদিবাসী ছেলেমেদের শিক্ষার জন্য ওই গৃহবধূ যে ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। সরকারি ভাবে যাতে তাঁকে সাহায্য করা যায়, তার চেষ্টা করা হবে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.