বিহারের পরে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনেও ইঙ্গিত মিলছে, ভারতীয় রাজনীতির জোট-অধ্যায় এখনও শেষ হয়নি।
উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনী ফলাফল শেষ পর্যন্ত যা-ই হোক না কেন, প্রকাশিত বিভিন্ন বুথ ফেরত সমীক্ষা থেকে এটা স্পষ্ট যে, নির্বাচনী রাজনীতির ফায়দা তোলার প্রশ্নে রাহুল গাঁধীর ‘একলা চলো’ নীতি এখনও সঠিক কৌশল নয়। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারাও আজ বলছেন, মায়াবতী এবং মুলায়ম (লখনউয়ের পরিভাষায় মা-মু), দু’পক্ষ থেকেই সমদূরত্ব বজায় রেখে রাহুল গাঁধী যে তাঁদের সমালোচনা করেছেন, তা সব অর্থেই ঠিক হয়েছে। এক পক্ষের দুর্নীতি, অন্য পক্ষের ‘গুণ্ডাগর্দি’ দুইয়েরই সমালোচনা করে উত্তরপ্রদেশে দলের হৃতগৌরব ফিরে পেতে চেয়েছেন তিনি। কিন্তু ভোটের ঠিক মুখে মুলায়মের সঙ্গে জোট বেঁধে মায়াবতীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামলে ভোটের অঙ্কে কংগ্রেসের অনেক বেশি ফায়দা হত বলে মনে করছেন দলের নেতাদের একাংশ। সে ক্ষেত্রে মুলায়মের পক্ষে যে হাওয়া ছিল, তার ফায়দা কংগ্রেসও পেতে পারত। যেমন পশ্চিমবঙ্গে মমতার সঙ্গে থেকে ভোটের ফলে কংগ্রেসের লাভ বই লোকসান হয়নি।
বস্তুত জোট রাজনীতি না একলা চলো, এই বিতর্ক কংগ্রেসে দীর্ঘদিনের। পচমড়ী কংগ্রেস অধিবেশনে এ নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়। তার পরে বেঙ্গালুরু, গুয়াহাটি, মাউন্ট আবু এবং তার পরে শিমলায় মুখ্যমন্ত্রী সম্মেলনগুলিতেও এ নিয়ে বিতর্ক হয়। পরবর্তী কালে রাহুল গাঁধীর হস্তক্ষেপে ‘একলা চলো’ নীতি গৃহীত হয় কংগ্রেসে। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ২০০ আসন পাওয়ায় সেই নীতি আরও সমর্থন পায়। কিন্তু দলের অনেকেই মনে করেন, নরেন্দ্র মোদী-বরুণ গাঁধীর প্রচারের ফলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হয়ে কংগ্রেসের আসন যে বেশ কিছুটা বেড়েছিল, তা-ও সে সময় হিসেবের মধ্যে রাখা উচিত ছিল।
কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির এক সদস্যের কথায়, “মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ধুতি পরতেন। নেহরু কুর্তা-পাজামা পরে আধুনিক ভারতের রূপকার হয়েছিলেন। আর আজ রাহুল গাঁধী বা অখিলেশ যাদব কিন্তু জিনস পরেও আধুনিক রাজনীতি করতে পারেন না! তাঁদের জাতপাতের রাজনীতি করতে হয়!” ওই কংগ্রেস নেতার ব্যাখ্যা, “নেহরু-গাঁধী জমানা যেমন আর ফিরে আসবে না, তেমনই জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের একক প্রাধান্য লাভের সম্ভাবনাও এখন অলীক স্বপ্ন। ইন্দিরা গাঁধী থেকে রাজীব গাঁধী কংগ্রেস যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে, নরসিংহ রাওয়ের সময় থেকে তার অবক্ষয় শুরু হয়। এর পর ভারতীয় রাজনীতিতে এসেছে জোট-অধ্যায়। হয় এনডিএ, নয় ইউপিএ। দুই বৃহৎ জাতীয় দল কংগ্রেস ও বিজেপি, কে কতটা জোট রাজনীতি করতে পারছে, তার
উপরই নির্ভর করেছে তাদের রাজনৈতিক সাফল্য।”
সমাজতত্ত্ববিদ আন্দ্রে বেতেই বলেন, “স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন কংগ্রেস ছিল এমন একটা মঞ্চ, যেখানে নানা ভাষা, নানা জাত, নানা ধর্ম, নানা আঞ্চলিক প্রত্যাশার প্রতিনিধিত্ব হয়েছে। কিন্তু নেতৃত্বের সঙ্গে আমজনতার বিচ্ছিন্নতার ফলে, আঞ্চলিক প্রত্যাশা পূরণের বিবিধ কারণ থেকে কংগ্রেসের পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক দল গড়ে ওঠে।” গাঁধী কংগ্রেসকে অভিজাততন্ত্র থেকে আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন, এ কথা বলে বেতেইয়ের মন্তব্য, “কংগ্রেস নেতৃত্ব মানুষের থেকে আবার বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে নানা ধরনের জাতপাত ও ধর্মনির্ভর আঞ্চলিক দলগুলি বিকশিত হয়।” |
সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দী বলেন, “ভারত একটা বহুত্ববাদী দেশ ও সমাজ। এখানে নানা রাজ্যে নানা ধরনের রাজনৈতিক জটিলতা ও সমীকরণ রয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস সব সময়ই চাইবে, আবার ‘সর্বজনহিতায়’ একটা দলে পরিণত হতে। কিন্তু আজকের দিনে, বিশেষত উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে ‘কাস্ট-ইঞ্জিনিয়ারিং’ একটা মস্ত বড় বিষয়। এই ‘কাস্ট-ইঞ্জিনিয়ারিং’ আবার রাজ্যস্তরে জোট সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণে। এই আপাত বিরোধের মধ্যে দিয়েই রাজনৈতিক দলগুলি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে এগোচ্ছে।”
বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ ভারতের রাজনীতিতে মণ্ডলায়নের স্থপতি। কংগ্রেসের এক নেতার বক্তব্য, গোড়ায় না চাইলেও পরবর্তী কালে জাতপাতের পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছে দল। এ বার উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে রাহুল গাঁধী কিন্তু অন্য অঙ্ক কষেছিলেন। দলিত, সংখ্যালঘু ও উচ্চবর্ণের হিন্দুভোট, তিনটিতেই থাবা বসাতে চেয়েছিলেন তিনি। কংগ্রেস নেতারা বলছেন, দলের সংগঠন এবং রাজ্য স্তরে কাঠামো না থাকায় শুধু
রাহুল গাঁধীর জনসভা দিয়ে এটা করা কঠিন ছিল।
কংগ্রেস নেতৃত্বের বক্তব্য, ভোটের ফল প্রকাশের পরে দলের প্রধান আলোচ্য বিষয়ই হবে, আর ‘একলা চলো’ নীতি নয়। কী ভাবে জোট-রাজনীতিকে সফল করা যায়, তার পথ খুঁজে বের করা। |