তৃণমূলের ‘পাল্টা’ মিছিলের ধারা অব্যাহত!
যাদবপুরে বামফ্রন্টের মিছিলের ‘জবাব’ দিতে জোড়া মিছিল হয়েছিল। রাজারহাটেও সেই একই ঘটনা। বামফ্রন্টের শনিবারের মিছিলের ‘পাল্টা’ হিসেবে রবিবার রাজারহাটে ফের মিছিল করল তৃণমূল। বামফ্রন্টের মিছিলের আগের দিন, শুক্রবারও স্থানীয় স্তরে তৃণমূলের মিছিল হয়। সেই দিক থেকে বিরোধীদের একটার ‘জবাবে’ শাসকপক্ষের দুটো এই ধারাও অব্যাহত!
অব্যাহত আর একটি ধারাও। রাজারহাটে এ দিনের মিছিলের অবসরে তৃণমূল নেতা তথা মন্ত্রীদের বক্তব্যে মনে হয়েছে, তাঁরাই রাজ্যের বিরোধী শিবিরে রয়েছেন! এই ‘পাল্টা’ মিছিলের জেরে শনিবারের মতো রবিবারও ফের আড়াই ঘণ্টা কার্যত জনজীবন রুদ্ধ থাকল রাজারহাটে। আটকে যায় বিমানবন্দরের পথও। উল্টে তৃণমূল নেতৃত্ব দাবি করেছেন, তাঁদের এই মিছিল মোটেও বামফ্রন্টের ‘পাল্টা’ নয়। রাজারহাটে সিপিএম নতুন করে যে ‘সন্ত্রাস’ তৈরি করতে চাইছে, তার বিরুদ্ধেই তাঁদের ‘শান্তি মিছিল’। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের নেতৃত্বে এ দিনের মিছিল লোকসংখ্যার বিচারে শনিবারের বামফ্রন্টের মিছিলকে ছাপিয়ে গিয়েছে বলেও তৃণমূল শিবিরের দাবি।
যা শুনে সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব বলেছেন, “না হয় মেনেই নিলাম যে, ওদের মিছিলে লোক বেশি হয়েছে। কিন্তু ভাল মিছিল করার জন্য কি সাধারণ মানুষ তৃণমূলকে সরকারে এনেছে?”
শনিবার নারায়ণপুর মণিখোলাতে বামফ্রন্ট মিছিল শেষ করেছিল। তৃণমূলের এ দিনের মিছিল শুরু হয় বিকেল সাড়ে তিনটেয় সেই নারায়ণপুর মণিখোলা থেকেই। মিছিলে যোগ দিতে বাস থেকে শুরু করে ম্যাটাডরে চেপে কাতারে কাতারে লোক আসতে থাকে নারায়ণপুরে। রাজারহাট-নিউ টাউন এলাকা ছাড়াও বাস আসতে থাকে নিউ ব্যারাকপুর, পানিহাটি, কামারহাটি, উত্তর দমদম এমনকী, কাঁচরাপাড়া থেকেও। সরু রাজারহাট রোড বিকেল তিনটে থেকেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। |
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দাবি, শুধু তাঁর জেলা থেকেই লোক এসে শনিবার বামফ্রন্টের সব জেলা থেকে আনা লোকের মিছিলকে ছাপিয়ে গিয়েছে। সেই সঙ্গেই তিনি জানিয়েছেন, রাজারহাটে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’র দাবিতে প্রতি মাসের শেষ রবিবার ‘শান্তি মিছিল’ করা হবে।
মিছিলে যোগ দিয়ে রাজ্যের আর এক মন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “বন্ধের দিন রাজারহাটে সিপিএম যা সন্ত্রাস করেছে, সে রকম যেন আর এখানে না হয়, সেটা আমাদের দেখতে হবে। তাই এই শান্তি মিছিল।” তার সঙ্গেই মদনবাবুর ‘সতর্ক-বাণী’, “বামফ্রন্ট যদি মনে করে, তারা শুধু সন্ত্রাস করবে আর আমরা বসে বসে রসগোল্লা খাব, তা হলে তারা ভুল ভেবেছে।”
তৃণমূল-নেতৃত্বের এমন বক্তব্য শুনে সিপিএমের জেলা সম্পাদক গৌতমবাবু বলেছেন, “ধর্মঘটের দিন আমাদের দলের সমর্থক গুলি খেল, আমাদের সমর্থকেরা গ্রেফতার হল, অথচ আমরা সন্ত্রাস করছি! এ রকম কথার কোনও অর্থই নেই। উল্টে আমরা একটা মিছিল করলে ওরা আমাদের ধমক দিতে পাল্টা দুটো মিছিল করছে। এত না ধমকে বরং ওরা সরকার চালানোয় মন দিক। তাতে রাজ্যের উন্নতি হবে। মিছিলের প্রতিযোগিতায় না-গিয়ে বরং তথ্য প্রযুক্তিতে কী ভাবে রাজ্যের আরও কর্মসংস্থান হয়, সেই ব্যপারে মন দিলে রাজ্যের ভাল হবে।”
সময় যতই গড়িয়েছে, ‘শান্তি মিছিল’ অবশ্য ক্রমশই ভিড়ের চাপে ‘বিশৃঙ্খল’ হয়েছে। ভিড় ঠেলে মদনবাবু বা এলাকার তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত নারায়ণতলা পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও পৌঁছতে পারেননি মুকুল রায়। মিছিল যখন নারায়ণতলা থেকে রাজারহাটের চিনারপার্কের দিকে যাওয়া শুরু করেছে, তখনও আবার উল্টো দিক থেকে ওই মিছিলে যোগ দিতে কাতারে কাতারে মানুষ আসতে থাকেন। রাজারহাট রোডের দু’দিকে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেকেই মাঝপথে আটকে পড়েন। কেউ কেউ বাস বা গাড়ি থেকে নামতেই পারেননি। মুকুলবাবুও মিছিলের মাঝখানে যোগ দেন। তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১৮২৫ দিনের জন্য ক্ষমতায় এনেছে। কিন্তু ২৬৫ দিন কাটতে না-কাটতেই বামফ্রন্ট সন্ত্রাস শুরু করেছে। মমতা যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন পাহাড় জ্বলছিল, জঙ্গলমহল জ্বলছিল। ২ লক্ষ ৪ হাজার কোটি টাকা দেনা নিয়ে সরকার কাজ শুরু করেছিল। সেই সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে যখন রাজ্যের শান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তখন ফের বামফ্রন্ট চক্রান্ত করে রাজ্যকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে। রাজারহাটেও তা-ই ঘটেছে।” মিছিলে ছিলেন শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু, সাংসদ সুব্রত বক্সী, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার, নেত্রী দোলা সেন প্রমুখ।
ধর্মঘটের দিন গণ্ডগোলের ঘটনায় এলাকার তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে। তাঁকে কিন্তু এ দিন পুরো মিছিল জুড়েই দেখতে পাওয়া গিয়েছে। সব্যসাচীবাবুর বক্তব্য, “রাজারহাট পুরসভার পুরপ্রধান পলাতক, উপ-পুরপ্রধান প্রয়াত, পুরসভায় তালা ঝুলছে। আমি কিন্তু এখানেই রয়েছি। আইনের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আমি আশা রাখি, সুবিচার পাব।” মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেছেন, “পুরোটাই সাজানো ঘটনা! সব্যসাচী নিজের দেহরক্ষীর পিস্তল কেন নিজেই চুরি করতে যাবেন?”
কিন্তু পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে কি? জবাবে বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার বলেন, “সব্যসাচীবাবুর বিরুদ্ধে এফআইআর রয়েছে ঠিকই। কিন্তু এফআইআর থাকলেই যে গ্রেফতার হতে হবে, তার কোনও মানে নেই। সেই দিন পুলিশের সামনেই পুরো ঘটনা ঘটে। আমরা যাদের গ্রেফতার করেছি, তদন্ত অনুযায়ীই তা করা হয়েছে।” |