দুই সিপিএম নেতা খুনের ‘কেস ডায়েরি’র সঙ্গে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট জমা না দেওয়ায় পুলিশের ‘ভূমিকা’ নিয়ে শুক্রবারই প্রশ্ন তুলেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। ওই ময়না-তদন্ত রিপোর্ট সময়মতো হাইকোর্টে পেশ করতে না পারায় রবিবার ‘শো-কজ’ করা হল বর্ধমান থানার আইসি-কে। ঠিক সময়ে আইসি-কে ওই রিপোর্ট না দেওয়ার অভিযোগে সাসপেন্ড হলেন এক সাব-ইনস্পেক্টরও। বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা এ দিন সন্ধ্যায় বলেন, “কর্তব্যে গাফিলতির কারণে আইসি স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে শো-কজ এবং এসআই দুর্গাদাস ভট্টাচার্যকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।”
 |
আইসি স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় |
সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমল হালদারের প্রতিক্রিয়া, “হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে তিরস্কার না করলে, এ সব হত না।” পক্ষান্তরে রাজ্যের আইনমন্ত্রী তথা জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক মলয় ঘটকের বক্তব্য, “দু’-এক জন পুলিশকর্মীর ব্যক্তিগত গাফিলতির জন্য ময়না-তদন্তের রিপোর্ট সময়ে জমা পড়েনি। এতে রাজ্য সরকারের কোনও গাফিলতি নেই। এ থেকেই প্রমাণ, রাজ্য সরকার নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করছে।”
বর্ধমানের দেওয়ানদিঘিতে গত ২২ ফেব্রুয়ারি খুন হন দুই সিপিএম নেতা প্রদীপ তা এবং কমল গায়েন। ওই ঘটনায় পুলিশ নিজে থেকে দু’টি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করে। সেই দু’টি মামলার তদন্তকারী অফিসার ছিলেন এসআই দুর্গাদাসবাবু। পরে প্রদীপ তা-র ভাই প্রবীর তা বর্ধমান থানায় ২২ জনের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। তার তদন্তকারী অফিসার ওই থানার আইসি স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে হাইকোর্টে তিনটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়। গত শুক্রবার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জয়নারায়ণ পটেল ও বিচারপতি সম্বুদ্ধ চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চে ওই আবেদনের শুনানি হয়। ওই দিন সকালে বর্ধমান থানার পুলিশ ময়না-তদন্তের রিপোর্ট আদালতে জমা দেয়নি। এ নিয়ে আদালতের তিরস্কারের মুখে পড়ে পুলিশ। তদন্ত সংক্রান্ত আরও কিছু বিষয়ে জেলা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে আদালত। সে দিন বিকেলে ময়না-তদন্ত রিপোর্টের ‘ফটো-কপি’ বর্ধমান থানার পুলিশ জমা দিলেও হাইকোর্ট
মামলার তদন্ত-ভার সিআইডি-র হাতে তুলে দেয়।
বর্ধমান মেডিক্যালের ফরেন্সিক মেডিসিন (এফএসএম) বিভাগের তরফে অবশ্য জানানো হয়, নিহত দুই সিপিএম নেতার ময়না-তদন্তের রিপোর্ট তৈরি হয়ে গিয়েছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালেই। ২৯ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান থানার কনস্টেবল অজিত দাস তাদের কাছ থেকে ওই ময়না-তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে যান। এ খবর প্রকাশিত হতেই নড়েচড়ে বসে জেলা পুলিশ।
জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, শনিবার দুপুরে কনস্টেবল অজিতবাবু এবং এসআই দুর্গাদাসবাবুকে ডেকে পাঠান পুলিশ সুপার। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, অজিতবাবু ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় ময়না-তদন্তের রিপোর্ট এনে জমা দিয়েছিলেন দুর্গাদাসবাবুর কাছে। কিন্তু দুর্গাদাসবাবু তা আইসি স্বপনবাবুর কাছে জমা দেননি। শনিবার রাতেই দুর্গাদাসবাবুকে সাসপেন্ড করার নির্দেশ দেন পুলিশ সুপার। এ দিন বহু চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি ওই সাব-ইনস্পেক্টরের সঙ্গে।
পাশাপাশি, আইসি নিজেও কেন ময়না-তদন্তের রিপোর্ট সংগ্রহে উদ্যোগী হলেন না, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে পুলিশ-মহলে। আইসি স্বপনবাবু বলেন, “এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। যা বলার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলবেন।” জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “দুর্গাদাসবাবু অস্বাভাবিক মৃত্যুর দু’টি মামলায় তদন্তকারী অফিসার। এই মামলাগুলির সুরতহালও করেন তিনি। তাই মেডিক্যাল কলেজ থেকে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট সংগ্রহ করে আইসি-র হাতে জমা দেওয়া ছিল তাঁর দায়িত্ব। তাই রিপোর্ট পেশ করতে না পারার দায় তাঁর উপরে বর্তাচ্ছে। পাশাপাশি, আইসি নিজে ওই রিপোর্ট সংগ্রহে উদ্যোগী না হয়ে হাইকোর্টে পেশ করা কেস ডায়েরিতে লিখে দেন, রিপোর্ট এখনও মেলেনি। সে কারণেই তাঁকে শো-কজ করা হয়েছে।”
তা হলে বর্ধমান থানা হাইকোর্টে ওই জোড়া খুনের মামলায় ময়না-তদন্তের রিপোর্ট জমা দিচ্ছে কি না, তা কেন খোঁজ নিলেন না পুলিশ সুপার? পুলিশ সুপার এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি। তবে জেলার এক পুলিশকর্তার ব্যাখ্যা, “এই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব বর্ধমান থানার ছিল। থানার তদন্ত প্রক্রিয়ার উপরেই ভরসা রাখার কথা পুলিশ সুপারের।” জেলা পুলিশের একাংশের ধারণা, খুনের ঘটনায় ধৃত চার জনকে নিজেদের হেফাজতে না নেওয়ার জন্যও তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ উঠতে পারে বর্ধমান থানার বিরুদ্ধে। এক পুলিশ-কর্তার কথায়, “যত দূর খবর পেয়েছি, খুনের ঘটনায় ধৃতদের নিজেদের হেফাজতে নিতে আদালতে আবেদন জানাতে পারে সিআইডি। আদালত তা মঞ্জুর করলেই বর্ধমান থানা কেন তাঁদের হেফাজতে নিল না, সে প্রশ্ন উঠবে। তার উত্তর খুঁজতেও পুলিশি তদন্ত হতে পারে।” |