জেলাস্তরে স্বাস্থ্য-পরিষেবা বাড়াতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে পিপিপি) যতই জোর দিন, বাস্তব পরিস্থিতিতে কিন্তু তার তেমন প্রতিফলন নেই। গ্রামীণ হাসপাতালে পিপিপি-ভিত্তিতে প্যাথলজিকাল ল্যাবরেটরি এবং এক্স রে-আলট্রাসোনোগ্রাফি কেন্দ্র চালু করার প্রকল্প কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ বার জানা যাচ্ছে, পিপিপি মডেলে মানসিক হাসপাতাল খোলার প্রস্তাবিত প্রকল্পেও বিশেষ সাড়া মিলছে না।
পশ্চিমবঙ্গে মানসিক হাসপাতাল এমনিতেই হাতে গোনা। কলকাতায় পাভলভ, লুম্বিনী পার্ক এবং ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়্যাট্রি ছাড়া রয়েছে পুরুলিয়া ও বহরমপুর মানসিক হাসপাতাল। স্বাস্থ্য-কর্তারা জানিয়েছেন, কোচবিহারের তুফানগঞ্জে আর একটা হাসপাতাল চালু হতে চলেছে। কিন্তু রাজ্যের মানসিক রোগীদের জন্য সব মিলিয়ে এই হাজারখানেকের মতো শয্যা যে প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য, সংশ্লিষ্ট সকলেই তা মানেন।
এই সমস্যার সুরাহার লক্ষ্যেই যৌথ উদ্যোগে মানসিক হাসপাতাল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নতুন সরকার। স্বাস্থ্য-কর্তাদের যুক্তি ছিল, নতুন হাসপাতালে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী জোগাড় করা ও খরচ সামলানো সরকারের পক্ষে মুশকিল। তাই হাসপাতাল তৈরির জায়গা দেবে সরকার, সেখানে পরিকাঠামো নির্মাণ ও কর্মী-চিকিৎসক নিয়োগ করুক সহযোগী সংস্থা। এক কর্তা বলেন, “শর্ত ছিল, হাসপাতালের কিছু শয্যায় সরকার রোগী পাঠাবে। তাঁদের খাবার ও ওষুধের খরচ সরকার দেবে। বাকি বেডে রোগী ভর্তি করবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা।”
প্রস্তাবিত প্রকল্পে সামিল হতে আগ্রহী বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছ থেকে স্বাস্থ্য দফতর আবেদন চেয়েছে মাস তিনেক হয়ে গেল। অথচ এখনও একটিও আবেদনপত্র জমা পড়েনি। তা হলে কি সূচনার আগেই প্রকল্পে দাঁড়ি পড়ে গেল?
সরকারি মহলের ব্যাখ্যা, প্রকল্পে ‘সহযোগী’ আহ্বানের প্রক্রিয়ায় কিছু ত্রুটি ছিল। তা শুধরে নতুন করে প্রস্তাব তৈরি হচ্ছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব সঞ্জয় মিত্রের কথায়, “আমরা কী কী সুবিধা দিতে পারব, আর বেসরকারি সংস্থাকে কী কী করতে হবে, প্রথম বার সে সব অতটা নির্দিষ্ট ভাবে বলা
ছিল না। তাই হয়তো কেউ আগ্রহ দেখায়নি।
এ বার বিজ্ঞপ্তিটি দেওয়া হবে অনেক নির্দিষ্ট ভাবে, ‘পলিসি’ হিসাবে।”
তবে অনাগ্রহের পিছনে আর্থিক কারণও উড়িয়ে দিচ্ছেন না স্বাস্থ্য-কর্তাদের একাংশ। দফতরের মানসিক চিকিৎসা বিভাগের এক শীর্ষ কর্তার মন্তব্য, “পুরোটাই মুনাফার ব্যাপার। এই ক্ষেত্রের অধিকাংশ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এক-এক জন মানসিক রোগীর চিকিৎসার জন্য ১০-১৫ হাজার টাকা নেয়। সরকারের সঙ্গে চিকিৎসাকেন্দ্র খুললে লাভ কমে যাবে।
কারণ, সরকারের পাঠানো রোগীদের থেকে টাকা নেওয়া যাবে না।”
যদিও অন্য পক্ষের তরফে অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি সংস্থার বক্তব্য: সরকার ডাক্তার-নার্স-চিকিৎসাকর্মী জোগাড় করবে না, ডাক্তারদের বেতনের টাকাও দেবে না। এত দায়িত্ব তাদের পক্ষে নেওয়া অসম্ভব। আবার মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা এক বেসরকারি সংগঠনের প্রধান রত্নাবলী রায় বলছেন, “ধরা যাক সরকার ২৫ জন রোগী পাঠাল। তাঁদের দশ জনকে সুস্থ হওয়ার পরেও যদি বাড়ির লোক নিতে না চায়, তখন কী হবে? ওঁদের দেখভালের জন্য কি ইনসেনটিভ দেওয়া হবে? এ সব পরিষ্কার না-হওয়া পর্যন্ত কেউ আগ্রহ দেখাবে না”
তবে এই নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এ রাজ্যে মানসিক রোগের চিকিৎসার দিকটা যে বরাবরই অবহেলিত, তা স্বীকার করে নিচ্ছেন শীর্ষ স্বাস্থ্য-কর্তারা। অভাব এ ক্ষেত্রে নানাবিধ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের, প্রশিক্ষিত নার্সের, হাসপাতালে শয্যার। সর্বোপরি, মানসিক রোগকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়ার মানসিকতার অভাব। যার জেরে কখনও পাভলভে রোগিণীদের নগ্ন করে রাখা হয়, কখনও শারীরিক ভাবে অসুস্থ মানসিক রোগীকে সাধারণ হাসপাতালের দরজায় ঠোক্কর খেয়ে ফিরতে হয়। দফতরের এক অফিসার বলেন, “স্বাস্থ্য ভবন থেকে সবটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মানসিক রোগীদের প্রতি যে তাচ্ছিল্য অনেকের মজ্জাগত, তা এক দিনে দূর হবে না। নিয়মিত পরিদর্শনে গেলে তবেই ত্রুটিগুলো ধরা সম্ভব।” |