রাজ্যের কলেজে কলেজে ছাত্র সংঘর্ষের বহর দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তপেন সেন। মঙ্গলবার কয়েকটি কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত মামলার শুনানি চলাকালীন বিচারপতি বলেন, “কলেজে কলেজে ছাত্র সংঘর্ষ এখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।”
পরে বিচারপতি জানিয়ে দেন, যে সব কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে মামলা হয়েছে, সেখানে ওই নির্বাচন ১৫ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। ১ মার্চ থেকে মামলার শুনানি হবে। উল্লেখ্য, কলকাতার দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র (সাউথ সিটি-র নৈশ শাখা), কে কে দাস, ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ ও মালদহের রথবাড়ি কলেজের ভোট কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে।
বস্তুত, ছাত্র সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত মামলা শোনার এক্তিয়ার কলকাতা হাইকোর্টের আদৌ রয়েছে কি না, তা নিয়েই হাইকোর্টে এ দিন শুনানি হওয়ার কথা ছিল। ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে নিজেদের বিভিন্ন সমস্যার কথা জানিয়ে যাঁরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন, সেই আবেদনকারীদের তরফে আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় শুনানির শুরুতে বলেন, কলেজের ভোট সুষ্ঠু ভাবে আয়োজনের স্বার্থে ২০০৪-এ লিংডো কমিশন গঠিত হয়। ২০০৬-এ কমিশন রিপোর্ট জমা দেয়, যার ভিত্তিতে নির্দেশিকা বানাতে বলা হয়েছে সব রাজ্য সরকারকে। সুতরাং হাইকোর্ট ছাত্র সংসদ সম্পর্কিত মামলার বিচার করতেই পারে বলে সুব্রতবাবুর দাবি।
লিংডো কমিশন সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যও সুব্রতবাবু বিচারপতির কাছে জমা দেন। বিচারপতি সেন জানিয়ে দেন, লিংডো কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এই মামলা শোনার এক্তিয়ার তাঁর রয়েছে, এবং তিনি তা শুনবেনও।
এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে স্থগিতাদেশের মেয়াদও বাড়তে পারে এই আশঙ্কায় আদালতের কাছে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আর্জি জানিয়েছিলেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের আইনজীবী। তার জবাবে বিচারপতি বলেন, রায় নিয়ে আপত্তি থাকলে যে কোনও পক্ষ আপিল করতে পারেন। বিচারপতি মন্তব্য করেন, “গোটা রাজ্য জ্বলছে! প্রতি দিন সকালে খবরে দেখছি। কী হচ্ছে, তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না?” বিচারপতি সেন এ-ও জানিয়ে দিয়েছেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত সব মামলাই তিনি এক সঙ্গে শুনবেন। |
|
গোটা রাজ্য জ্বলছে!
প্রতিদিন সকালে খবরে দেখছি।
কী হচ্ছে, তা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না? তপেন সেন
বিচারপতি, কলকাতা হাইকোর্ট |
|
হাইকোর্ট-সূত্রের খবর: গত ক’দিনে কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত আরও কিছু মামলা জমা পড়েছে। আইনজীবীদের একাংশের মতে, লিংডো কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক হাইকোর্টেই মামলটির শুনানি হবে এটা জানার পরে আরও অনেক কলেজ হাইকোর্টে আবেদন জানাতে পারে। স্বভাবতই তারা এই মামলায় যুক্ত হবে। অর্থাৎ মামলার পরিধি অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু কলেজে কলেজে নিত্যনৈমিত্তিক অশান্তি নিয়ে বিচারপতির এ দিনের মন্তব্য সম্পর্কে রাজ্য সরকারের প্রতিক্রিয়া কী?.
রাজ্যের উচ্চশিক্ষা-সচিব সতীশ তিওয়ারি বলেন, “আদালতের রায় আমি জানি না। বিচারপতি এমন মন্তব্য করেছেন বলেও শুনিনি। তাই এ ব্যাপারে কিছু বলব না।” সরকারের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিচারপতির মন্তব্য সম্পর্কে সরাসরি প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে গিয়ে বলেন, “রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট সুখকর। তবে
দু’-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। সেই সব ঘটনাও যাতে না-ঘটে, সে বিষয়ে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী।” যদিও সরকারের শরিক কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, “মাননীয় বিচারপতির মতো আমরাও রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিশেষত কলেজ নির্বাচনে অশান্তি নিয়ে।” ‘কলেজ ইউনিয়ন ইলেকশন কমিশন’ গঠনের জন্য রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কাছে প্রদীপবাবু আর্জি জানিয়েছেন। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম অবশ্য বিচারপতির মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বিশেষ কিছু বলতে চায়নি। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্যামল চক্রবর্তীর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “রাজ্যে আগুন তো জ্বলছেই! জ্বালাচ্ছে তৃণমূল!” তবে ঘটনা হল, বিচারপতি বা নেতা-মন্ত্রীরা যা-ই বলুন, রাজ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিংসার ধারাবাহিকতায় ছেদ এখনও পড়েনি। অন্তত গত চব্বিশ ঘণ্টার ঘটনাপঞ্জি তা-ই বলছে। কী রকম?
যেমন, ছাত্র পরিষদ (সিপি)-এর সঙ্গে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর, আবার তৃণমূল ছাত্র পরিষদেরই দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে এ দিন ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগর নেতাজি শতবার্ষিকী মহাবিদ্যালয়। আহত হন ৪ ছাত্র। আতঙ্কিত ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস না-করে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। কলেজে পুলিশ পিকেট বসেছে। অধ্যক্ষ সুধানাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আগামী ৫ মার্চ কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন। এই অবস্থা চলতে থাকলে সুষ্ঠু ভাবে ভোট করা সমস্যা হবে।” উল্লেখ্য, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এই কলেজেই টিএমসিপি’র দু’টি গোষ্ঠীর সংঘর্ষে জখম হয়েছিলেন চার জন। সে বার অধ্যক্ষ থানায় লিখিত অভিযোগও করেছিলেন। এ দিন কালিয়াগঞ্জ কলেজেও প্রার্থীদের পরিচয়পত্র সংগ্রহ ঘিরে টিএমসিপি-সিপি সংঘর্ষে তিন জন জখম হয়েছেন। আজ, বুধবার ওখানে সংসদের নির্বাচন হওয়ার কথা।
|
হিংসা-তালিকা |
২০১১ |
২০১২ |
২৯ জুলাই
রবীন্দ্রভারতীতে ছাত্রের
হামলায় শিক্ষাকর্মীর মৃত্যু
২৩ সেপ্টেম্বর
জঙ্গিপুর কলেজে অধ্যক্ষের
ঘরে ভাঙচুর
২৫ নভেম্বর
বহরমপুর কলেজে ছাত্র সংঘর্ষ, অধ্যক্ষের ঘরে তাণ্ডব
১৩ ডিসেম্বর
মনোনয়ন প্রত্যাহার ঘিরে দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজে সংঘর্ষ, আহত ১৫
২৪ ডিসেম্বর
বনগাঁর দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়ে বিধায়কের উপস্থিতিতে হাঙ্গামা
২৪ ডিসেম্বর
ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজে ছাত্র সংঘর্ষ, শহর অবরুদ্ধ
|
৫ জানুয়ারি
রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে লাথি-ঘুষি
৬ জানুয়ারি
গঙ্গারামপুর কলেজে শিক্ষকেরা তালাবন্দি
৭ জানুয়ারি
নদিয়ার মাজদিয়া কলেজে অধ্যক্ষ নিগ্রহ
২০ জানুয়ারি
ছাত্র-ভোট ঘিরে নেতাজিনগর কলেজে সংঘর্ষ
|
|