বন্ধ উপলক্ষে মহাকরণে মুখ্যসচিবের জারি করা একটি বিজ্ঞপ্তি। আর তাতেই সরগরম রাজ্য সরকারি কর্মচারী মহল।
বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে বন্ধ, ধর্মঘট উপলক্ষে সরকারের তরফে যে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হত, মঙ্গলবার মুখ্যসচিব সমর ঘোষের জারি করা নতুন নির্দেশিকার সঙ্গে তার মাত্র একটি বাক্যের তফাত। আগের নির্দেশিকায় বলা হত ‘ধর্মঘটের দিন সরকারি কর্মীরা অফিসে আসতে না পারলে বিধি অনুযায়ী তাঁদের ছুটির আবেদন করতে হবে’। নতুন নির্দেশিকায় এই বাক্যটি পরিবর্তন করে বলা হয়েছে ‘ধর্মঘটের দিন সরকারি কর্মীরা কাজে না এলে তাঁদের কোনও ছুটি মঞ্জুর করা হবে না’।
এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, জরুরি কারণে সে দিন কেউ ছুটি নিলে সরকার কী করবে? এ প্রসঙ্গে মুখ্যসচিব বলেন, “সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মী সরকারের কাছে আবেদন করবেন। সেই আবেদনপত্র খতিয়ে দেখে বিবেচনা করা হবে।” সরকার যদি অনুপস্থিত কর্মচারীর আবেদন না-মঞ্জুর করে? কী হতে পারে সে ক্ষেত্রে? কর্মচারী ইউনিয়নগুলির বক্তব্য, সে ক্ষেত্রে অনুপস্থিত কর্মচারীর এক দিনের বেতন কাটা যেতে পারে। হতে পারে ‘ব্রেক অফ সার্ভিস’। পেনশন বা পদোন্নতির ক্ষেত্রেও সমস্যা হতে পারে। তবে সবই নির্ভর করছে সরকারের ‘বিবেচনা’র উপরে।
বাম আমলে রাজনৈতিক দলের ডাকা বন্ধ কিংবা ট্রেড ইউনিয়নের ডাকা ধর্মঘটের দিন মহাকরণ-সহ যে কোনও সরকারি অফিসে কর্মীদের উপস্থিতির সংখ্যা থাকত নগণ্য। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে আইন সংশোধন করে সরকারি কর্মীদের ধর্মঘটের অধিকার দিয়েছিল বামফ্রন্ট। এবং সে কারণে কারও বেতন কাটা হত না। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, আগে এই সব দিনে যাঁরা ধর্মঘটের সমর্থনে অফিস করতেন না, তাঁরা সে কথা জানিয়ে দিতেন সশ্লিষ্ট দফতরের আধিকারিককে। অন্য দিকে যাঁরা ধর্মঘট সমর্থন না করলেও মূলত যানবাহনের অভাবে অফিসে যেতে পারতেন না, তাঁদের ছুটির আবেদন করতে হত। দু’টি ক্ষেত্রেই সরকার কারও বেতন কাটত না। এ বার নির্দেশিকা অনুযায়ী সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন হতে চলেছে। |
ধর্মঘটের প্রতিবাদে মিছিল মহাকরণে। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র |
এ দিন মুখ্যসচিবকে প্রশ্ন করা হয়, সার্ভিস রুলে কর্মীদের ধর্মঘটের অধিকার দেওয়া আছে। সেই সার্ভিস রুল পরিবর্তন না করে কী করে এই নির্দেশিকা জারি হল? সমরবাবু এই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন। ধর্মঘটে সামিল হবে জানিয়ে কো-অর্ডিনেশন কমিটি ১৪ দিনের নোটিস দিয়েছে সরকারকে। নিয়ম মতো কোনও কমিটি কি সেই নোটিস খতিয়ে দেখেছে? মুখ্যসচিবের উত্তর, “এখন সেই সুযোগ নেই। কারণ ওই কমিটি তৈরি হয়নি।”
স্বাভাবিক ভাবেই এই নতুন নির্দেশিকাকে ঘিরে কর্মী-সংগঠনগুলির মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সিপিএম প্রভাবিত কো-অর্ডিনেশন কমিটি এই নির্দেশিকার তীব্র বিরোধিতা করেছে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অনন্তবাবু বলেন, “এই নির্দেশিকা জারির পরেও আমরা ধর্মঘটে আছি এবং থাকবও।” তিনি আরও বলেন, “রাজ্য সরকার এখনও কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নিতে পদক্ষেপ করেনি। আমাদের সংগঠন করার অধিকার, ধর্মঘট করার অধিকার এখনও স্বীকৃত। এর পরেও সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার হলে নেবে।”
সরকারি কর্মীদের আর এক সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (নবপর্যায়)-এর সাধারণ সম্পাদক সমীররঞ্জন মজুমদার বলেছেন, “সরকারের এই বিজ্ঞপ্তি এক অর্থে অভূতপূর্ব। যাঁরা ধর্মঘটকে সমর্থন বা বিরোধিতা কোনওটাই করেন না, তাঁদেরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অফিসে আসতে হবে, এটা হতে পারে না! এই বিজ্ঞপ্তির মানে, ওই দিন অফিসে না এলে এক জন কর্মচারীর ‘ব্রেক অফ সার্ভিস’, পদোন্নতি বা পেনশনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। এমনকী, তিনি চাকরি থেকে বরখাস্ত পর্যন্ত হতে পারেন। বামফ্রন্ট সরকারের অন্তত একটা গণতন্ত্রের মুখোশ ছিল। এদের তা-ও নেই।” সমীরবাবু জানান, তাঁদের সংগঠনের সদস্যরা নৈতিক ভাবে ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়ে ওই দিন কাজে যোগ দেবেন না।
আইএনটিইউসি প্রভাবিত কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত ভট্টাচার্য ধর্মঘটকে সমর্থন না করলেও নির্দেশিকার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তাঁর কথায়, “এমন আদেশ দেওয়ায় ওই দিন কোনও কর্মী ব্যক্তিগত কারণে অফিসে না গেলে তাঁর ‘ব্রেক অফ সার্ভিস’ হতে পারে। আমরা এর প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।”
তৃণমূল কর্মী সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে অবশ্য সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছে। স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের রাজ্য কমিটির সভাপতি মনোজ চক্রবর্তী বলেন, “বিপন্ন কর্মসংস্কৃতিকে সচল করার চেষ্টা চালাচ্ছে এই সরকার। বন্ধ সেই কর্ম সংস্কৃতিকে আরও বিপন্ন করে। আমরা ওই দিন সরকারি দফতর সচল রাখব।” মহাকরণে তৃণমূল প্রভাবিত ইউনাইটেড স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের নেতা বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, সৌম্য বিশ্বাসরা বলেছেন, “২৮ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘটের সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের কোনও সম্পর্ক নেই।” তাঁদের কথায়, “যানবাহন না পেয়ে কেউ কাজে যোগ দিতে না পারলে সরকার যেন তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।” |