তাঁর সরকারের জমানায় প্রথম সাধারণ ধর্মঘট মোকাবিলায় সরকার এবং দলের তরফে ‘কঠোর বার্তা’ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আগামী মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি দেশ জুড়ে সাধারণ ধর্মঘটের ঠিক এক সপ্তাহ আগে এক দিকে রাজ্য সরকারের তরফে মহাকরণে নির্দেশিকা জারি করে জানিয়ে দেওয়া হল, ওই দিন সরকারি কর্মচারীরা ছুটি নিতে পারবেন না। অন্য দিকে, তৃণমূল ভবনে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী তথা দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, ওই ধর্মঘটের দু’দিন আগে থেকেই শাসক দল ধর্মঘটের বিরোধিতায় রাস্তায় নামবে। এমনকী, ধর্মঘটের দিন রাস্তায় নেমে ‘সক্রিয় বিরোধিতা’ করা হবে, এমন ইঙ্গিতও তৃণমূলের তরফে দেওয়া হয়েছে।
ধর্মঘট মোকাবিলায় মহাকরণ এবং তৃণমূল ভবনের দুই ‘হাতিয়ার’-এর মধ্যে প্রথমটি নিয়ে ইতিমধ্যেই ‘বিতর্ক’ তৈরি হয়েছে। তৃণমূল ছাড়া সরকারি কর্মচারীদের অন্য সংগঠনগুলির তরফে কিছু প্রশ্নও তোলা হয়েছে এবং রাজ্য সরকারকে পাল্টা চিঠি দিয়ে ওই নির্দেশিকা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, নির্দেশিকা প্রত্যাহার করা না-হলে তাঁরা বৃহত্তর আন্দোলনে নামবেন। কর্মচারীদের একাংশের তরফে আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। এখন দেখার, আগামী এক সপ্তাহে এই বিতর্ক কোন দিকে গড়ায়। তবে মমতা-ঘনিষ্ঠদের দাবি, বন্ধ-অবরোধের রাজনীতির বিরোধিতায় তিনি যে কতটা ‘কঠোর এবং আন্তরিক’, তার পরিচয় মুখ্যমন্ত্রী দিতে পেরেছেন।
প্রসঙ্গত, সরকারি কর্মীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার বিরোধিতা করে কিছু দিন আগেই বার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ও শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। তার পরেই এ দিনের নির্দেশিকা। যাতে বলা হয়েছে, ‘ধর্মঘটের দিন সরকারি কর্মীরা কাজে না-এলে কোনও ‘ছুটি’ (লিভ) মঞ্জুর করা হবে না।’
মোট ১০ দফা দাবিতে দেশের ১১টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ওই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। আহ্বায়কদের মধ্যে বামপন্থীরা ছাড়াও রয়েছে বিজেপি, জনতা দলের শ্রমিক সংগঠন। ধর্মঘটীদের ‘আবেদন’ মেনে ওই দিন মাধ্যমিক পরীক্ষার দিন পরিবর্তন করেছিলেন মমতা। তার থেকে ধর্মঘটীরা ভেবেছিলেন, রাজ্য সরকার তাঁদের সঙ্গে কোনও ‘সংঘাতে’ যাবে না। কিন্তু এ দিনের নির্দেশিকা সেই ধারণা নস্যাৎ করে দিয়েছে।
বন্ধ-অবরোধ বন্ধে তিনি যে ‘কঠোর’ হতে চান, এর আগে বারবার তার প্রমাণ দিয়েছেন বিরোধী নেত্রী এবং প্রশাসক দুই মমতাই। নিজে বিরোধী দলে থাকাকালীনও শেষের তিন-চার বছর তিনি বন্ধ ডাকেননি। তাঁর তৎকালীন জোটসঙ্গী এসইউসি বন্ধ ডাকলেও তা সমর্থন করেননি। ক্ষমতায় আসার পর যত্রতত্র মিটিং-মিছিল আটকাতে সর্বদল বৈঠক ডেকেছেন। বন্ধ বন্ধে আইন প্রণয়নের কথাও বলেছেন। সে দিক দিয়ে দেখলে তাঁর সরকারের এই নির্দেশিকা অবশ্য ‘প্রত্যাশিত’ই। যেমন প্রত্যাশিত তৃণমূলের ‘হুঁশিয়ারি’।
তবে এর ফলে যে ‘সংঘাতে’র পরিস্থিতি তৈরি হল, তার প্রভাবেই ধর্মঘট ‘সফল’ হয়ে যেতে পারে বলে মনে করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। প্রধান বিরোধী দল সিপিএম দাবি করেছে, তৃণমূলের ‘হুঁশিয়ারি’ এবং রাজ্য সরকারের ‘ফতোয়া’, কোনও কিছুতেই ধর্মঘটকে আটকানো যাবে না। সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তীর মন্তব্য, “ওদের আঁখি যত রক্ত হবে, মোদের আঁখি ফুটবে!” তাঁর মতে, সিপিএম ‘শেষ’ হয়ে গিয়েছে বলে যাঁরা মনে করছেন, রবিবারের ব্রিগেড সমাবেশ তাঁদের একটি ‘বার্তা’ দিয়েছে। ধর্মঘট আরও একটি ‘বার্তা’ দেবে।
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থবাবুর কথায়, “রাজ্যের উন্নয়নের বিরুদ্ধে সিপিএম-সহ বেশ কিছু বামপন্থী দলের শ্রমিক সংগঠনের ডাকা বন্ধের বিরোধিতা করছে তৃণমূল। রাজনৈতিক স্বার্থে ডাকা ওই বন্ধ ব্যর্থ করতে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ ভাবে আগামী শনি ও রবিবার রাস্তায় নেমে মানুষকে বোঝানো হবে। রাজ্যের প্রতিটি ব্লকে মিটিং-মিছিল করে সক্রিয় ভাবে বন্ধের বিরোধিতা করতে বলা হবে।” এক তৃণমূল নেতার কথায়, “প্রতিদিনই এলাকায় এলাকায় বন্ধ উপেক্ষা করার জন্য মানুষকে বোঝানো হবে। ধর্মঘটের দিনও পরিবহণ ও জনজীবন সচল রাখতে পথে নামবে তৃণমূল।” ‘শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক’ পথে তৃণমূলের ধর্মঘট-বিরোধিতা প্রসঙ্গে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্যামলবাবু বলেন, “ওঁরা এমন বলেন। কিন্তু শেষে তাতে আর গণ থাকে না। তান্ত্রিক হয়ে যায়! ওঁদের শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচির জেরে বিধানসভা নির্বাচনের আগে-পরে আমাদের হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক ঘরছাড়া। ভোটের পর থেকে ৫৫ জন বাম কর্মী-সমর্থক খুন হয়েছেন, বহু টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। শ্রমিক-কর্মচারীদের শান্তিপূর্ণ ভাবেই ধর্মঘটে সামিল হতে বলব। কিন্তু বাধা দিলে কী হবে, তখন বোঝা যাবে।”
এই পটভূমিকাতেই ‘সংঘাতে’র আশঙ্কা করছে সরকারের জোট শরিক কংগ্রেস। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, “পথে নেমে তৃণমূল বিরোধিতা করতেই পারে। তবে ধর্মঘটে সামিল না-হওয়ার অধিকারের মতোই সামিল হওয়ার অধিকারও আছে। দুই স্তরের মানুষের অধিকারই স্বীকার করে নেওয়া উচিত সব রাজনৈতিক দলের। তাই ধর্মধটের দিন রাস্তায় সংঘাত এড়াতে সকলকেই সতর্ক থাকতে হবে।”
পার্থবাবু এ দিন বলেন, “শ্রমিক সংগঠনগুলি দিল্লিতে গিয়ে ধর্নায় বসুক। এ রাজ্যকে বেছে নিয়ে উন্নয়নের গতি থমকে দিচ্ছে কেন?” এক দিনের বন্ধ-ধর্মঘটে রাজ্যের আর্থিক ক্ষতির উল্লেখ করে তৃণমূলের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও বলেন, “রাজ্যের এই আর্থিক অবস্থায় এক দিনের ক্ষতিও অনেক। সরকারি কর্মীরা ধর্মঘটে সামিল হলে, তাঁদের বেতনের টাকার জোগান যে ব্যাহত হতে পারে, সেটা কি তাঁরা বুঝছেন না?”
আর শ্যামলবাবুর জবাব, “কেউ ধর্মঘট-বিলাসী নন। প্রয়োজনেই তাঁরা ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হন।” সরকারি কর্মচারীদের ছুটি সংক্রান্ত নির্দেশিকার প্রেক্ষিতে তাঁর বরং পাল্টা প্রশ্ন, “কেউ ক্যাজুয়াল লিভ (সিএল) নিলে সরকার কী করবে? সরকারের নীতি এবং নির্দেশের বাইরে গিয়ে সিএল নিলে তাঁদের এক দিনের বেতন কাটা যাবে। প্রথমত, এর বিরুদ্ধে কর্মচারীরা আদালতে যেতেই পারেন। দ্বিতীয়ত, আমাদের ধর্মঘটে অসংগঠিত ক্ষেত্রের যে সব শ্রমিকেরা যোগ দেবেন, তাঁরা তো এক দিনের উপার্জন বিসর্জন দিয়েই আসবেন। সরকারি কর্মচারীদেরও এই ফতোয়া দিয়ে আটকানো যাবে না।” ‘সংঘাতে’র আবহ অতএব, তৈরি। সম্ভবত আতঙ্কেরও। |