দখলদারি শুধুমাত্র বিষয়সম্পত্তিতেই নয়, খেলাধুলাতেও রয়েছে। এর প্রমাণ মেলে ঘর দখলের খেলায়। সমান সংখ্যক খেলোয়াড় নিয়ে দু’টি দলে এই খেলা হয়। ছেলে-মেয়ে একত্রে কিংবা পৃথকভাবেও খেলা চলে। কারা আগে ‘দান’ পাবে তা স্থির হয় ‘টসের’ মাধ্যমে।
প্রথমে দু’টি দলই আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের দলের দলপতি নির্বাচিত করে। ৩০-৪০ ফুট দূরত্বের ব্যবধানে মুখোমুখি মাটিতে দাগ দিয়ে আয়াতাকার দু’টি ঘর তৈরি করা হয়। দু’টি ঘরে দুই দলের খেলোয়াড়েরা অবস্থান করে। এরপর চলে ছদ্মনাম নেওয়ার পালা। দু’পক্ষ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করে কারা কোন বিষয়ক নাম নেবে। যেমন প্রথম পক্ষ ফুল নিলে দ্বিতীয় পক্ষকে ফল অথবা প্রথম পক্ষ পাখি নিলে দ্বিতীয় পক্ষকে পশু বিষয়ক নাম নিতে হয়। এরপর দলপতি নিজ নিজ ঘরে গিয়ে গোপনে কানে কানে নিজেদের খেলোয়াড়দের নাম নির্ধারণ করে দেয়। নামকরণের পর টসজয়ী দলের দলপতি বিপক্ষ দলের এক জনের চোখ দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে আড়াল করে। |
সুর করে ছদ্মনাম অনুযায়ী ‘আয় রে আমার টিয়া, যা টিপ দিয়া’ কিংবা ‘আয় রে আমার গরু, টিপ দে সরু’ বলে নিজের দলের খেলোয়াড়কে ডাকে। ছদ্মনাম অনুযায়ী সেই খেলোয়াড় এসে চোখ বন্ধ করা বিপক্ষের খেলোয়াড়ের কপালে সন্তর্পনে টিপ দিয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে যায়। এরপর দলপতি ‘আমার দলের খেলুরা সব, ভাত খা গবাগব্’ বলে বিপক্ষের খেলোয়াড়ের চোখ খুলে দেয়। তখন বিপক্ষ ওই খেলোয়াড় যাতে টিপ দানকারীকে চিহ্নিত করতে না পারে সেই জন্য টসজয়ী দলের সবাই একই ভঙ্গিমায় থালায় ভাত খাওয়ার ভান করে। এরপর টসজয়ী দলের দলপতি যার চোখ বন্ধ করা হয়েছিল, তাকে ছড়ার মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করে — “বলো তো ধন, তোমার কপালে টিপ দিল কোন জন?’ যাকে প্রশ্ন করা হল, সে যদি আঙুল দিয়ে সঠিক খেলোয়াড়কে দেখিয়ে দিতে পারে তাহলে তার টসজয়ীদের ঘরের দিকে একবার লাফ দেওয়ার সুযোগ মেলে। ভুল হলে টিপ দানকারী টসজয়ীদের ঘরের দিকে একলাফ দেওয়ার সুযোগ পায়। এরপর বিপক্ষ দলও একই ভাবে প্রতিপক্ষের চোখ চেপে ধরে একই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। এই ভাবে ক্রমান্বয়ে অন্য খেলোয়াড়দের নিয়ে খেলা চলে। তারই মধ্যে যে দলের কোনও একজন লাফ দিতে দিতে প্রতিপক্ষের ঘরে পৌঁছে যায় অর্থাৎ দখল নিতে পারে তারাই হয় জয়ী। ছেলেবেলায় দিনের একটা বড় সময় এই খেলায় কাটিয়েছেন ময়ূরেশ্বরের বজরহাট গ্রামের মুকুল খান, নানুরের খুজুটি পাড়ার সুবল থান্দার। তাঁরা বলেন, “বৈচিত্র্য খুঁজে পেতে আমরা ছোটবেলায় অন্যান্য খেলার পাশাপাশি ঘর দখলের খেলায় মেতে থাকতাম। বাড়িতে বিস্তর বকা খেতাম। তবু ভুলতে পারিনি ওই খেলা। বর্তমান প্রজন্ম হয়তো জানেই না খেলাটির কথা।”
|
(হারিয়ে যাওয়া খেলা পর্ব ১০) |