প্রবন্ধ ২...
আত্মঘাতীর সন্ধানে
মাননীয় মৃণাল সেন কিংবা গৌতম ঘোষদের মতো পরিচালকদের অনুরোধ, তাঁরা এই বেলা কৃষি নিয়ে একটা ছবি তৈরি করুন। এমন বিচিত্র বিষয় আছে খুব কম - এক দিকে কৃষি বিজ্ঞানীরা এবং সরকারি কর্তারা কৃষির সম্ভাবনা নিয়ে অসামান্য সব স্বপ্ন দেখান, অন্য দিকে চাষি না খেতে পেয়ে আত্মহত্যা করে। মঞ্চ থেকে যে ‘চাষিভাই’, মাঠে নামলে সে-ই ‘বেটা চাষা।’ চাষ করে বিশ্বায়িত বাজারে জায়গা করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তব হওয়া দূরে থাক, সন্তানদের পেট চালানোর ব্যবস্থাও করা যাচ্ছে না। কেবল টিকে থাকাই চাষির কাছে দুরূহ কাজ হয়ে উঠছে।
কেন এমন হল? উত্তর খুঁজতে চোখ রাখতে হবে বৃহত্তর ছবির দিকে।
১৯৫১ থেকে ২০১১ সালে মধ্যে জনসংখ্যা বেড়েছে ৩.৩৫ গুণ এবং খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে ৪.৭৪ গুণ। ১৯৫১ সালে মাথাপিছু খাদ্যশস্য উৎপন্ন হত দৈনিক ৪০০ গ্রাম, ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৫৪৫ গ্রাম। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে দেখা যাচ্ছে যে, কৃষির গড়পড়তা বৃদ্ধি দুই শতাংশের কম হয়েছে এবং জনসংখ্যা বেড়েছে ২.২১-২.২৫ শতাংশ, অর্থাৎ জনসংখ্যা কৃষি উৎপাদন অপেক্ষা বেশি জোর কদমে এগোচ্ছে। অর্থাৎ যত উৎপাদন প্রয়োজন, তত আমরা করে উঠতে পারছি না, আরও উৎপাদন প্রয়োজন। অন্য দিকে, যত শস্য উৎপাদন করার সামর্থ্য আমাদের রয়েছে, তার চাইতে কমই উৎপাদন হচ্ছে। এটা স্পষ্ট হয় চিনের সঙ্গে তুলনা করলে। ভারতবর্ষ ও চিন এই দুই দেশই ’৫০-’৫১ সাল নাগাদ নিজেদের নূতন জীবন শুরু করে। যদি সেই সময়কার কৃষির তুলনা করি, ভারতবর্ষ চিনের চেয়ে কয়েকটা বিষয়ে এগিয়ে ছিল:
ভারতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন চিনের চেয়ে বেশি,
পরিবার প্রতি কৃষিযোগ্য জমি চিনের চেয়ে বেশি,
পরিবার প্রতি সেচযোগ্য জমি চিনের চেয়ে বেশি,
দুই দেশের মোট কৃষিযোগ্য জমি প্রায় সমান।
অর্থাৎ, কৃষি উৎপাদনের দৌড়ে ভারতবর্ষ চিনের চেয়ে কয়েক গজ এগিয়ে ছিল। অথচ আজ, ২০১০-১১ সালে দেখা যাচ্ছে, চিনের খাদ্যশস্যের উৎপাদন ভারতের চেয়ে বেশ কয়েক গুণ বেশি। এ দেশ কৃষি উৎপাদন পিছিয়ে পড়ছে।
কৃষির ছবি, দুই রাজ্যে
পশ্চিমবঙ্গ
• পঞ্জাবে মাঝারি এবং উচ্চ উপার্জনশীল চাষিরা মোট চাষিদের ৫০ শতাংশেরও বেশি। পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা ২২ শতাংশ।
পঞ্জাব
• পশ্চিমবঙ্গে অত্যন্ত দরিদ্র এবং দরিদ্র চাষিদের সংখ্যা মোট কৃষকের ২০ শতাংশ। পঞ্জাবে তাঁরা পাঁচ শতাংশ।
• যাঁদের জমি এক হেক্টরেরও কম, পশ্চিমবঙ্গে সেই প্রান্তিক চাষিই ৮১ শতাংশ। ক্ষুদ্র চাষি (দুই হেক্টরের কম জমি) আরও ১৪ শতাংশ। পঞ্জাবে চাষিদের জমির আয়তন বড়।

• পঞ্জাবে নিয়মিত মাটি পরীক্ষা হয়। সেখানে কৃষি-প্রযুক্তির ভূমিকা বিপুল। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযুক্তি তৈরি হয়। নানা জাতির বীজ তৈরি, চাষিকে আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত করা, এ কাজগুলিও নিয়মিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার তুলনায় অনেক সীমিত। মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু পরীক্ষা হয় অনিয়মিত, হলেও তার ফল আসতে দেরি হয়, আবার ফল এলেও কী করে তার অর্থ উদ্ধার করতে হবে, অনেকে বোঝেন না।
কৃষির উন্নতি বেশি না হওয়ার জন্য অনেকগুলি কারণ রয়েছে। প্রথমত, দেশের মোট উৎপাদনে কৃষির অংশ কমে আসছে। কৃষি থেকে সারা দেশের মোট রোজগারের (গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট) মাত্র ১৬ শতাংশ আসে, যেখানে পরিষেবা থেকে আসে ৫৮ শতাংশ ও শিল্প থেকে আসে ২৮ শতাংশ। একটু ভেবে দেখুন, বড় ছেলে (কৃষি) যে আগে সংসারের আয়ের প্রায় সবটাই দিত, সে এখন মাত্র ১৬ শতাংশ দিচ্ছে। মেজো ভাই (পরিষেবা ক্ষেত্র) দিচ্ছে অর্ধেকের চেয়ে বেশি ও ছোট ভাই (শিল্প) দিচ্ছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এখন ভেবে দেখুন তো, এই পরিবারের তিন ভাইয়ের মাছের সাইজ বা পায়েসের বাটির আয়তন কি সমান হবে? মেজো ভাইয়ের পাতে তিন গুণ বা অন্তত দু’গুণ বড় মাছের টুকরো পড়বে। তবু গ্রামীণ এলাকার ৭০ শতাংশ মানুষ সরাসরি বা অন্য ভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অতএব, সরকারকে এবং কৃষি বৈজ্ঞানিকদের কৃষি সম্বন্ধে বড় বড় কথা বলতেই হচ্ছে। তা কার্যকর করার জন্য যে প্রচেষ্টা এবং বিনিয়োগ দরকার, তা কার্যত হচ্ছে না। মৌখিক আশ্বাস হয়ে রয়ে যাচ্ছে।
এ বার আসা যাক পশ্চিমবঙ্গের চাষির সংকটের প্রসঙ্গে। এই সূত্রে পঞ্জাবের কৃষির সঙ্গে একটা প্রতিতুলনা নীচের সারণিটি দেখলেই স্পষ্ট হবে।
অর্থাৎ আমাদের চাষিরা পঞ্জাবের চাষিদের মতোই পরিশ্রম করেন কিন্তু রোজগার করেন অনেক কম। পশ্চিমবঙ্গের চাষি যে বাকি দেশের তুলনায় বেশি বিপন্ন তার একটা বড় কারণ, তাঁদের জমি ছোট ছোট।
তা ছাড়া, রাজনৈতিক দিকটিতেও পশ্চিমবঙ্গের চাষির কণ্ঠ অনেক কমজোরি। পঞ্জাবের ধনী চাষিরা গোটা কৃষিনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, রাজনীতিতে তাঁদের জোরদার উপস্থিতির জন্য। ভারতের কৃষি নীতি তৈরিই হয় বড় চাষি, এবং গমচাষিদের কথা মাথায় রেখে। সেখানে ছোট চাষি বা ধান-পাটের চাষির কথা কেউ তেমন করে চিন্তাও করেন না।
বিশেষত পাট, যার ফলন কেবল পূর্ব ভারতে, এবং যা প্রধানত মুসলিম চাষিরা চাষ করেন, কৃষি নীতিতে একেবারেই ব্রাত্য। পাটচাষির জন্য স্তোকবাক্য ছাড়া কিছুই নেই, পাটের উৎপাদন-বিপণন নিয়ে মাথা ঘামাতে কেউ রাজি নন। সরকারি নীতির উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা, নীতির সুবিধে নিতে না পারা, পশ্চিমবঙ্গের চাষিদের অতিরিক্ত ঝুঁকি এবং অতিরিক্ত লোকসানের একটি বড় কারণ। অন্য দিকে, শস্যের বাজার সম্পর্কেও চাষি খুব কমই জানেন। তাঁর ধানের দাম কেমন পাওয়া যাবে, খরচ উঠে আসবে কি না, কোথায় গেলে বেশি দাম পাওয়া যেতে পারে, এগুলো তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। বরং নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে তাঁর মনে আতঙ্ক তৈরি করা হয়, যাতে তিনি যা পাওয়া যায় সেই দামেই ফসল বিক্রি করে দিতে পারেন। সার, বীজ, কীটনাশকের ক্ষেত্রেও চাষি অসহায়। যা বাস্তবিক দাম, তার দু-তিনগুণ বেশি দিয়ে কালোবাজারে সার কিনতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে এখন সারের দাম নিয়ে যা চলছে তা টু-জি স্ক্যামের সঙ্গে তুলনা করা চলে। শহুরে মানুষ শস্য-সবজির বাড়তি দাম দিতে নারাজ, কিন্তু চাষির সার-কীটনাশকের দাম উঠছে না ফসল বিক্রি করে। এ ভাবে কি কৃষি চলবে?
একদিকে চাষির কাছে তথ্য এত সামান্য, অন্য দিকে তাকে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। চাষ যখন লাভজনক হচ্ছে না, তখন শিল্প বা আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছে জমি বেচে দেওয়াই কি ভাল? অকৃষি জমি এ রাজ্যে যেখানে প্রায় নেই, সেখানে রাস্তা, হাসপাতাল, স্কুলের জমি চাষিকেই দিতে হবে। জমি না দিলে আখেরে চাষিরই ক্ষতি হবে না কি? ধান-গমের মতো সাবেকি ফসল না ফলিয়ে বাণিজ্যিক ফসল ফলালে লাভ বেশি হবে? এর প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তের সঙ্গে চাষির পরিবারের ভাল থাকা বা নিঃস্ব হয়ে যাওয়া নির্ভর করছে। চাষির বর্তমান ক্ষতি পরিস্থিতিকে আরও তীব্র সংকটপূর্ণ করে তুলবে।
কেন্দ্রীয় স্তরে কৃষি নীতি নিয়ে নতুন করে চিন্তা জরুরি। বহু দশক ধরে কৃষি বিষয়ে সিদ্ধান্তকে কেবল কৃষিবিজ্ঞানীদের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এটা মস্ত ভুল। প্রয়োজন জল, জমি, কৃষি, খাদ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, এমন সব দফতরের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনা করে সুসংহত কৃষি নীতি প্রণয়ন, কারণ এর সঙ্গেই চাষির বেঁচে থাকার শর্ত জড়িয়ে।

সমাজ গবেষণা সংস্থা ‘ইকনমিক ইনফর্মেশন টেকনোলজি’-র মুখ্য অধিকর্তা


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.