|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি |
|
আমি বলতে গেলে
গ্রন্থাগারেরই সন্তান |
|
বই পড়ার ঘনঘোর নেশা ধরেছিল সেই ছেলেবেলাতেই,
কিন্তু
এত বই
কোথায় পাওয়া যাবে? অতএব লাইব্রেরি। লিখছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
বরানগরের মিলনী নামে একটি গ্রন্থাগারের আজ বিশেষ আনন্দের দিন। তাদের নিজস্ব ভবনের একতলার ওপরে দোতলায় একটি ঘর খোলা হয়েছে, তার উদ্বোধন হবে। ষাট-সত্তর বছর আগে এই পল্লির কয়েকজন আদর্শবাদী মানুষ প্রচুর যত্ন ও পরিশ্রমে যে গ্রন্থাগারটি চালু করেছিলেন, (প্রথম দিকে স্থানাভাবে কারও গ্যারেজে) তাঁরা আজ আর কেউ ইহলোকে নেই, কিন্তু গ্রন্থাগারটি বেঁচে আছে, পরবর্তী প্রজন্মের আরও কয়েকজন সেই আদর্শ ও দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে ভাগ করে নিয়েছেন এবং গ্রন্থাগারটি সচল রেখেছেন। এখন নিজস্ব দোতলা ভবন তো সমৃদ্ধিরই দিকে।
সত্যিই কি তাই?
শুধু বরানগর কেন, টালিগঞ্জ কিংবা বেলেঘাটায়, ডায়মন্ড হারবার কিংবা ব্যারাকপুরে, অথবা আরও দূরে অনেক মফস্সল শহরে, এমনকী কোনও কোনও গ্রামেও ছড়িয়ে আছে এ রকম বেসরকারি ছোট-বড় গ্রন্থাগার। স্বাধীনতার ঠিক আগে বা পরে বাঙালিদের মধ্যে গ্রন্থাগার-আন্দোলনের প্রতি একটা ঝোঁক দেখা যায়। তখন কোনও রকম সরকারি সাহায্যের সম্ভাবনা ছিল না, কিছু কিছু মানুষ সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ভাবে নিজেদের পাড়ায় পাড়ায় এ রকম লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন, তাদের কোনওটি এখন সুবর্ণজয়ন্তী কিংবা হীরকজয়ন্তী পালন করছে, তা আমরা জানি। তবে সে রকম কিছু লাইব্রেরির মৃত্যু ঘটেছে কিংবা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কি না তা আমরা জানি না, সে রকম কোনও পরিসংখ্যান আছে কি?
আমি বলতে গেলে গ্রন্থাগারেরই সন্তান।
শৈশবে-কৈশোরেই বই পড়ার তীব্র নেশা জন্মেছিল, কিন্তু নতুন বই পাব কোথায়? সুতরাং পাড়ার লাইব্রেরিই ভরসা। (কিছু কিছু বই চুরিও করেছি অবশ্য। কোনও নেমন্তন্নবাড়িতে গেলেই আমি ইঁদুরের মতন এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে বেড়াতাম, কোথাও কোনও বই পড়ে থাকতে দেখলেই চট করে তুলে জামার তলায় পেটে গুঁজে নিতাম। কোনও দিন ধরা পড়িনি অবশ্য। তবে দু’-এক বার এমন অবস্থা হয়েছে, যা নিয়ে অনায়াসেই হাসির গল্প লেখা যায়। কোন কোন বাড়ি থেকে আমি কী কী বিখ্যাত বই হাপিশ করেছি, তার কিছু কিছু এখনও আমার মনে আছে, কিন্তু এত কাল পরে তার স্বীকারোক্তি দেওয়ারও কোনও মানে হয় না।) |
|
এখনও। দমদম লাইব্রেরি অ্যান্ড লিটারারি ক্লাব-এর গ্রন্থাগার। ছবি: গৌতম বসুমল্লিক |
আমাদের শৈশবে শিশুসাহিত্য খুব বেশি ছিল না, তাই একখানা বই-ই পড়তাম তিন-চার বার। তার পর খিদের জ্বালায় উইপোকার মতন বড়দের বইও খেতে শুরু করলাম। আমার মায়ের ছিল বই পড়ার প্রচণ্ড নেশা, পাড়ার লাইব্রেরির মেম্বার, কিন্তু নিজে তো যেতেন না, তাঁর হয়ে বই আনার দায়িত্ব ছিল আমার। মা রান্না করতে বসেও বই পড়তেন, কোনও দিন অবশ্য কোনও রান্নায় নুন বেশি বা কম হয়নি। মা যখন একখানা বই পড়তেন, সেই সময় অন্য বইটি কৌশল করে আমি পড়ে নিতাম। তখন অনেক লোক বলত, এখনও কেউ কেউ বলে যে, ছোটরা বড়দের বই পড়লে চরিত্র খারাপ হয়ে যায়, কিংবা বখে যায়। এই সব কথার জ্বলন্ত প্রতিবাদ আমি নিজে। গোঁফ গজাবার আগেই আমি শত শত গল্পের বই, তার মধ্যে ‘চিতা বহ্নিমান’ কিংবা ‘অথৈ জলে’-র মতন বইও ছিল, কিন্তু তার জন্য আমার চরিত্র খারাপ কিংবা বখে যাবার মতন কিছুই হয়নি। আমার আর যত দোষই থাক, এ রকম কোনও অভিযোগ কখনও শুনিনি।
পাড়ার লাইব্রেরিটি ছোট থেকে ক্রমশ বড় হচ্ছিল, কয়েকজন পাড়ার মানুষের নিষ্ঠায়। তাঁদের মধ্যে এক জন মানুষের কথা আমার বিশেষ ভাবে মনে আছে। পুরো নাম জানি না, সবাই ডাকত মিত্তিরদা, ছোট্টখাট্টো চেহারার ছটফটে মানুষটি। আমি যে দিনই যেতাম, তাঁকে দেখেছি। উপস্থিত প্রত্যেকের সঙ্গে ডেকে-ডেকে বাড়ির খবর নিতেন। শুনেছি, তিনি রোজ বিকেলে তালা খোলার সময় থেকে রাত ন’টায় তালা বন্ধ করা পর্যন্ত নিজে থাকতেন। কোনও সদস্য বই নিয়ে আট-দশ দিনের মধ্যে ফেরত না দিলে সোজা চলে যেতেন তার বাড়ি। তিনি কিন্তু লাইব্রেরিয়ান ছিলেন না, কোনও বিশেষ বিভাগের ভার ছিল না তাঁর ওপর, বরং বলা যায়, তিনি যেন ছিলেন কোনও সদাশয় অভিভাবকের মতন। কোনও হঠাৎ ছুটি উপলক্ষে লাইব্রেরি বন্ধ রাখার প্রস্তাব করলে তিনি প্রতিবাদ জানাতেন। পরবর্তী কালে আমি ভেবেছি, ওঁর নিজের বাড়ি-ঘর, সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে, তবু প্রতিদিন সন্ধেটা যে ব্যয় করতেন লাইব্রেরিতে এসে, তা কীসের টানে? এর উত্তর পাওয়া সহজ নয়।
এই মিত্তিরদার মতন অন্যান্য পাড়ার লাইব্রেরিতেও এ রকম নিষ্ঠাবান এক-এক জন মানুষ থাকতেন, যাঁদের জন্য লাইব্রেরি বেঁচে থেকেছে। শুধু বাঁচা নয়, গ্রন্থাগারের আয়তন বেড়েছে, পাকা বাড়ি হয়েছে এখন। তবু সত্যিকারের উন্নতি হয়েছে কি?
অনেক জায়গাতেই শুনতে পাই, বইয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, টাকাপয়সার সমস্যাও অনেকটা মিটেছে, সরকারি সাহায্যও পাওয়া যায়, কিন্তু কমে যাচ্ছে সদস্য-সংখ্যা। অনেক লাইব্রেরিতে এখন ভিড় নেই, দুপুর-বিকেল খাঁ-খাঁ করে, সন্ধেবেলাতেও লাইব্রেরিতে যাওয়ার চেয়ে বাড়িতে টিভি দেখার আকর্ষণ বেশি। ছোট ছোট লাইব্রেরিতে যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেও কি কমে যাচ্ছে পাঠকের সংখ্যা?
ওই মিত্তিরদার কাছে আমি একদিন ধমক খেয়েছিলাম। মায়ের জন্য রোজ দু’টি উপন্যাস নিয়ে যাবার কথা, একদিন তার মধ্যে ‘শেষের কবিতা’ নামে একটি বই দেখে আমি বলেছিলাম, না না, কবিতার বই চাই না, কবিতার বই চলবে না। সে কথা শুনে মিত্তিরদা বলেছিলেন, রবি ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’র যে নাম শোনেনি, তার কান ধরে দু’মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা উচিত। কান ধর, কান ধর!
তিনি আমাকে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিয়েছিলেন। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। ক্লাস সিক্সের ছেলের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের ওই উপন্যাস সম্পর্কে না-জানা কি অমার্জনীয় অপরাধ? বাড়ি ফিরেই ‘শেষের কবিতা’ খুলে বসি। আমার জীবনে সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের কোনও উপন্যাস পাঠ। ও রকম ধমক খাবার জন্যই বোধহয় সেই পাঠের স্মৃতি আজও অমলিন হয়ে আছে। |
|
|
|
|
|