|
|
|
|
প্রবন্ধ ৩... |
প্রান্তিক মানুষ ব্রাত্য থাকলে শহর তিলোত্তমা হয় না |
যাঁরা সমাজের কেন্দ্রে বা মূলধারায়, তাঁরাই আধিপত্য করে চললে
নাগরিক উন্নয়ন খণ্ডিত এবং বিকৃতই থেকে যাবে। লিখছেন
ধ্রুবজ্যোতি দে |
আমরি অগ্নিকাণ্ডে আহত রোগীদের উদ্ধারকারী পঞ্চাননতলাবাসীদের ‘বস্তিবাসী’ বলে উল্লেখ করায় অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য সঙ্গত ভাবেই মর্মবেদনা প্রকাশ করেছেন। (‘সেই বসতি... ’, সম্পাদক সমীপেষু, ২২-১২)। আসলে, ‘বস্তিবাসী’ তথা দরিদ্র নগরবাসীদের মূল নাগরিক সমাজ প্রান্তিক মানুষ রূপে গণ্য করতেই অভ্যস্ত। যদিও এঁদের মাধ্যমেই মূলবাসীরা তাঁদের গার্হস্থ্য ও পুর পরিষেবা গ্রহণ করে থাকেন। মোট নগরবাসীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হলেন এমন প্রান্তিক মানুষ। কিন্তু কেবল এঁদের ক্লিন্ন বাসস্থান, অস্বাস্থ্যকর জীবন, অস্থায়ী উপার্জন, অদক্ষ শ্রম, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদি কারণেই যে এঁরা প্রান্তিক, তা নয়। যে কোনও প্রান্তিকতার মতোই এখানেও ক্রিয়াশীল রয়েছে মূলবাসীদের দিক থেকে প্রসারিত এক প্রকার পরোক্ষ বর্জন বা ব্রাত্যকরণ প্রক্রিয়া (এক্সক্লুশন)। এবং এই ব্রাত্যকরণ আছে বলেই প্রান্তিক মানুষদের জীবনে, আচরণে স্বতঃস্ফূর্ত মানবিক ঔদার্যের স্ফুরণগুলিকে প্রশস্তি জানাতে গিয়ে ‘বস্তির ছেলে’, ‘কাজের লোক’ ইত্যাদির উল্লেখ অনিবার্য হয়ে পড়ে। কেবল সম্ভাষণ পরিবর্তনে, ‘পল্লিবাসী’, ‘সহায়ক’ বা অনুরূপ নামকরণে এই প্রান্তিকতা দূর হবে না।
এমন নয় যে, এই ব্রাত্যকরণ মূলবাসী নাগরিকদের তরফে নির্দিষ্ট ভাবে আরোপিত। আজকের সমাজবিজ্ঞানীয় ধারণায়, জীবিকানির্বাহের সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকা, জীবনযাত্রায় স্বাধীন ভাবনা প্রয়োগের সুযোগ না পাওয়া, ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধ, সামাজিক ভাবে, বিশেষত মহিলাদের অমর্যাদাকর অবস্থান, এই সবই ব্রাত্যকরণ। এমনকী সমাজ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর (কমিউনিটি) সমস্যাদি ও সমাধানচিন্তাকে অবজ্ঞা করা, তাঁদের অভ্যাস, অভিজ্ঞতা, কুশলতা ও মতামতকে অগ্রাহ্য করাও এক ধরনের সামাজিক ব্রাত্যকরণ। এই ব্রাত্যকরণের উৎসটি রয়েছে প্রান্তিক ও মূল নগরবাসীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূলধনের প্রকৃতি ও পার্থক্যে। যদিও নগরজীবনে উন্নয়নের দায়িত্বে থাকেন প্রধানত মূলবাসী নাগরিকরাই।
প্রান্তীয় দরিদ্র নগরবাসীদের জীবনের সামাজিক মূলধন হল তাঁদের যূথবদ্ধতা, পারস্পরিক আস্থা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা, যৌথ অভিজ্ঞান, উদ্যোগ ও তৎপরতা, এমনকী যৌথ ভবিষ্যৎভাবনা। যৌথ মূল্যবোধ, কুশলতা ও উদ্ভাবনী প্রয়াস এঁদের অন্যতম সাংস্কৃতিক মূলধন। এর সাহায্যেই এঁরা নিজ জীবনযাত্রা পরিচালনা করেন, মোকাবিলা করেন আর্থিক অনটন, সংশোধন করেন ভুল বা অসংযত পদক্ষেপ। অসচ্ছলতা নিয়েও পারস্পরিক সাহচর্যে তাঁরা টিকে থাকেন। অন্য দিকে, মূলবাসীদের সামাজিক মূলধন হল ব্যক্তিগত যোগসূত্রের বিস্তার, সম্ভব হলে ক্ষমতার নানা কেন্দ্র পর্যন্ত তার সম্প্রসারণ। এই ভাবে অনুকূল পরিচিতি ও স্বীকৃতির মাধ্যমে গড়ে ওঠে তাঁদের স্থিতিশীল প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কাদি। |
|
পশ্চাতে টানিছে। প্রান্তজীবন। |
এই সামাজিক মূলধনের সাংস্কৃতিক ভিত্তি হল উচ্চবর্গীয় ভাষাজ্ঞান ও আচার-আচরণ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, আইনি ও প্রশাসনিক ধারণা ইত্যাদি। ফলে মূলবাসীদের পক্ষে আধিপত্যের সঙ্গে প্রশাসনিক রীতি অনুসরণ ও ব্যবহার যেমন সম্ভব, প্রান্তবাসীদের পক্ষে তা নয়।
প্রান্তীয় ও মূল নাগরিকদের সামাজিক সাংস্কৃতিক মূলধনের পার্থক্য বিশেষ ভাবে প্রতিফলিত হয় দরিদ্র নগরবাসীদের আর্থ-সামাজিক ও আইনি-প্রশাসনিক ব্রাত্যকরণে। দু’একটি উদাহরণ দিই।
১) ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে (২০০৫-০৬)’-এর তথ্য অনুযায়ী দেশে দরিদ্র নগরবাসী মহিলাদের ৫৯ শতাংশ রক্তাল্পতার শিকার। উল্লেখ্য, এমন দরিদ্র মহিলাদের মাত্র ১০.১ শতাংশের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন।
২) ‘ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশন’-এর ২০০৫-এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ৭৫ শতাংশ বস্তিবাসী পরিবারগুলির কাছে দারিদ্র মোচনকারী সরকারি কার্যক্রমগুলির সহায়তা পৌঁছয়নি।
৩) দরিদ্র নগরবাসীরা অধিকাংশই অসংগঠিত স্বনিযুক্ত কর্মী। ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ঋণ এঁদের স্বনির্ভর করতে সক্ষম। ‘ন্যাশনাল কমিশন ফর এন্টারপ্রাইজ ইন দি আনঅর্গানাইজড সেক্টর (২০০৯)’ দেখিয়েছে ২০০২-০৩-এ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক প্রদত্ত ঋণ (নেট ব্যাঙ্ক ক্রেডিট)-এর মাত্র ২.২ শতাংশ অতিক্ষুদ্র (মাইক্রো) উদ্যোগীদের দেওয়া হয়েছে, যা ২০০৭-০৮-এ কমে হয়েছে ১.২ শতাংশ। যে প্রশাসনিক/প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা এই ব্রাত্যকরণ কমাতে পারে, তা নিজ স্বার্থে টেনে আনার মতো উপযুক্ত সামাজিক সাংস্কৃতিক মূলধন দরিদ্র প্রান্তিক নগরবাসীদের নেই। অতএব এর অনিবার্য পরিণাম নগরজীবনের অসম বিকাশ।
উন্নয়নের মূল লক্ষ্য যখন মানুষে মানুষে বৈষম্য হ্রাস এবং সকলের জন্য সুস্থ সৃজনশীল শান্তিময় জীবনের আশ্বাস, তখন প্রান্তিক ও মূলবাসী নাগরিকদের মধ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূলধনের ইতিবাচক সম্প্রসারণ ছাড়া উপায় নেই। সীমাহীন দারিদ্র ও তার দুর্ভোগগুলি থেকে ২০১৫-র মধ্যে পৃথিবীকে যত দূর সম্ভব মুক্ত করতে রাষ্ট্রপুঞ্জ নির্ধারিত ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যকে মান্যতা দিয়ে দেশে দেশে এমন উদ্যোগ চালু হয়েছে। এই প্রচেষ্টার দু’টি ধারা বর্তমান।
প্রথমত, বস্তিবাসী তথা দরিদ্র নগরবাসীদের চিহ্নিত করে উন্নয়নে তাঁদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সামাজিক মূলধন বাড়িয়ে তোলা। ভারতে যোজনা কমিশন অক্টোবর ২০১১-তে ‘আর্বান পভার্টি, স্লামস অ্যান্ড সার্ভিস ডেলিভারি সিস্টেম’-এর ওপর যে রিপোর্ট পেশ করেছে, তাতে দারিদ্র সীমারেখার বিতর্ক সরিয়ে বস্তিবাসী পরিবারগুলির আর্থিক, সামাজিক ও অন্যান্য দৌর্বল্য চিহ্নিত করে আইনি-প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। প্রত্যাশা এই: ঘিঞ্জি, অস্থায়ী, অস্বাস্থ্যকর আস্তানার পরিবর্তে জীবিকানির্বাহের সুযোগ-সহ উপযুক্ত বাসস্থান, বসতে মহিলাদের স্বত্বাধিকার, অশক্তদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা, অদক্ষ কর্মীদের দক্ষতা ও স্বনিযুক্তদের সামর্থ্য বৃদ্ধি, পরিষেবা প্রদানে কমিউনিটির অংশগ্রহণ, ইত্যাদির মাধ্যমে প্রান্তবাসীদের উন্নীত করে বস্তিবিহীন নগর গড়ে তোলা হয়তো সম্ভব হবে।
দ্বিতীয় ধারাটি হল, দরিদ্র বস্তিবাসীদের সামাজিক সাংস্কৃতিক মূলধনকে সংগঠিত করে তাঁদের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যোগকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে মিলিত করা। ‘সরকারি প্রচেষ্টায় জনগণের অংশগ্রহণ’ পাল্টে ‘জনগণের প্রচেষ্টায় সরকারের অংশগ্রহণ’-এর পক্ষে সওয়াল করছেন ‘স্লাম ডোয়েলার্স ইন্টারন্যাশনাল’। ভারতে বস্তিবাসীদের নিজস্ব পত্রিকা ‘স্লাম জগত্তু’-র সম্পাদক আইজ্যাক অরুল সেলভা এক জন স্কুলছুট বস্তিবাসী। কন্নড় ভাষার এই বিজ্ঞাপনবিবর্জিত পত্রিকাটি বেঙ্গালুরুর বস্তিবাসীদের মধ্যে প্রচারিত। লেখকও তাঁরাই, বিষয়বস্তু বস্তিজীবন। এ সব প্রয়াস সত্ত্বেও দ্বিতীয় ধারাটি যথেষ্ট দুর্বল। এর বাইরে তৃতীয় কোনও ধারাও তৈরি হতে পারে।
শেষ কথা হল, চাই মূলবাসীদের পাশাপাশি প্রান্তিক নাগরিকদের ক্ষমতায়ন, যাতে উন্নয়ন সার্বিক, সর্বজনীন ও সুস্থায়ী হতে পারে। তবেই নগরী হয়ে উঠবে তিলোত্তমা। |
|
|
|
|
|