জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র নিয়ে সকলের সঙ্গে আলোচনা করেই এগোতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ সাত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে সে কথা জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
বাজেট অধিবেশনের আগে বিরোধী বা শরিক দলগুলির সঙ্গে নতুন করে বিরোধ তৈরির পক্ষপাতী নন মনমোহন। তিনি চাইছেন, প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে বা আলাদা করে বৈঠক ডেকে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হোক। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীরা যে সব উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা দূর করার চেষ্টা হোক। মুখ্যমন্ত্রীদের মূল অভিযোগ ছিল, ইউপিএ-সরকার রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত করার চেষ্টা করছে। তেমন কোনও অভিপ্রায় যে তাঁর সরকারের নেই, আজকের চিঠিতে সেই বিষয়টিতেই সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। যুক্তি দিয়েছেন, সারা দেশে সন্ত্রাস-দমনে সমন্বয় রক্ষাটাই জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র (এনসিটিসি) গঠনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। সেই কারণেই এনসিটিসি-কে আইবি-র আওতায় রাখা হয়েছে। তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রীদের উদ্বেগ দূর করার চেষ্টা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন মনমোহন। চিঠিতে জানিয়েছেন, “আমি আপনাদের উদ্বেগের বিষয়গুলি সম্পর্কে অবহিত হয়েছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি যাতে মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করে সেই সব উদ্বেগ দূর করা হয়।”
কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলি বাদে প্রায় সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাই জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র (এনসিটিসি) নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে আপত্তির কথা জানান নবীন পট্টনায়েক, জয়ললিতা, নীতীশ কুমার, নরেন্দ্র মোদী, মানিক সরকার ও শিবরাজ সিংহ চৌহান। প্রথম বারের চিঠির জবাব না পেয়ে অনেকে দ্বিতীয় বারও চিঠি লেখেন। প্রধান বিরোধী দল বিজেপিও মনমোহন-সরকারের ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত করার বদভ্যাস’ নিয়ে সরব হয়েছিল। আজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এনসিটিসি নিয়ে তোপের মুখে পড়তে হয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব রাজকুমার সিংহকে। বিজেপি, তৃণমূল, বাম সব দলের সাংসদরাই বলেন, এনসিটিসি তৈরির সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখে সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হোক। বাদ যাননি কংগ্রেস সাংসদরাও। কমিটির সদস্যরা চেয়ারম্যান বেঙ্কাইয়া নায়ডুকে অনুরোধ করেন, স্থায়ী কমিটির তরফেও সুপারিশ জানানো হোক।
সরকারি সূত্রের বক্তব্য, যে ভাবে কেন্দ্রের উপর চাপ বাড়ছিল, তাতে সব আপত্তি পাশ কাটিয়ে এনসিটিসি নিয়ে এগোনো যে সম্ভব নয়, তা স্পষ্ট হচ্ছিল। সেই কারণেই প্রধানমন্ত্রী নিজে আসরে নামার সিদ্ধান্ত নেন। সাত জন মুখ্যমন্ত্রীর লেখা চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে পাঠিয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নোটের উপর ভিত্তি করেই আজ ওই সাত জন মুখ্যমন্ত্রীকে জবাবি চিঠি পাঠিয়েছেন মনমোহন। মুখ্যমন্ত্রীদের প্রশ্ন ছিল, এনসিটিসি নিয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে আগে কেন আলোচনা করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর চিঠিতে জানিয়েছেন, “আপনারা হয়তো জানেন, এই ধরনের একটি কেন্দ্র তৈরির চিন্তাভাবনা ২০০১ সাল থেকেই চলছে।” মনমোহনের যুক্তি, মন্ত্রিগোষ্ঠীর রিপোর্টে গোয়েন্দা বিষয়ক একটি ‘জয়েন্ট টাস্ক ফোর্স’ তৈরির সুপারিশ করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার তা গ্রহণ করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা কাটাতে পি চিদম্বরম সাংবাদিক বৈঠক করতে পারেন। পরে আলোচনা করবেন মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গেও। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যুক্তি, কার্গিল-কাণ্ডের পর থেকেই গোয়েন্দা-তথ্যের আদানপ্রদান অবাধ করতে একটি জাতীয় কেন্দ্র গঠনের প্রস্তাব উঠেছিল। ২০০৮ সালে ২৬/১১-র হামলার পরে এই দাবি নতুন করে ওঠে। তখন থেকেই এ নিয়ে আলোচনা চলছে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে বা ডিজি-সম্মেলনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। সংসদের আলোচনাতেও সব দল এই প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে। আপাতত অবশ্য এনসিটিসি-কে আলাদা সংস্থার মর্যাদা না দিয়ে আইবি-র অধীনেই রাখা হয়েছে। ইউএপিএ আইনের যে ধারায় এই সংস্থাকে রাজ্যের এলাকায় তল্লাশি চালানোর বা কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সিআরপি-র মতো আধাসেনা বা অন্যান্য কেন্দ্রীয় পুলিশ বা তদন্তকারী সংস্থারও সেই ক্ষমতা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী অভিযানে গিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীও প্রয়োজনে কোথাও তল্লাশি চালাতে পারে বা কাউকে গ্রেফতার করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাস-দমন ছাড়া অন্য কোথাও এই ক্ষমতা কাজে লাগানো হবে না। প্রধানমন্ত্রীর চিঠির পর মুখ্যমন্ত্রীদের সেই কথাটাই বোঝানোর চেষ্টা করবেন চিদম্বরম। মনমোহন-সরকারের এই প্রচেষ্টা কতটা সফল হয়, সেটাই দেখার! |