ভারতীয় সেনাবাহিনীর খবর পাকিস্তানে পাচার করবে বলে ছ’বছর ধরে কলকাতায় থাকছিল সে। বানিয়ে ফেলেছিল এ দেশে থাকার ছাড়পত্র ভোটার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, এমনকী পাসপোর্টও। বিয়ে করেছিল মহেশতলার এক মেয়েকে। কলকাতায় এক প্রাক্তন সেনা অফিসারের ব্যক্তিগত গাড়ি-চালক হিসেবে চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু, শেষরক্ষা হয়নি। সম্প্রতি পাকিস্তান যাওয়ার ভিসা জোগাড় করতে গিয়ে দিল্লি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে পাকিস্তান গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর চর ৩৮ বছরের আসিফ হুসেন। আসল নাম আতাহার। করাচিতে বাড়ি।
আসিফ গ্রেফতারের পরে দিল্লি পুলিশের একটি দল সম্প্রতি মহেশতলার আক্রায় হানা দেয়। পুলিশ সূত্রে খবর, সেখানে আসিফের স্ত্রী, দেড় বছরের মেয়ে এবং দু’মাসের ছেলে রয়েছে। সেখান থেকে আসিফের বেশ কিছু নথি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছে দিল্লি পুলিশ। জানা গিয়েছে, ‘অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট’-এ আসিফকে ধরে নিজেদের হেফাজতে রেখেছে দিল্লি পুলিশ। চলছে জিজ্ঞাসাবাদ।
কে এই আসিফ?
|
আসিফ হুসেন |
তার সম্পর্কে যে তথ্য দিল্লি পুলিশের হাতে এসেছে, তা বেশ নাটকীয়। করাচিতে ডাকাতি করে বেড়াত আতাহার ওরফে আসিফ। সপ্রতিভ চেহারা দেখে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর নজরে আসে সে। ২০০৫ সালে মুলতানে তাকে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কী ধরণের ‘কোড’ থাকে, সেনা অফিসারেরা কী ধরনের বার্তা আদানপ্রদান করে প্রশিক্ষণ ছিল মূলত তা নিয়েই। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ঘুরে নেপালে পৌঁছনোর পর নষ্ট করে দেওয়া হয় আতাহারের পাসপোর্ট। আসিফ হুসেন নাম নিয়ে কাঁকরভিটা সীমান্ত দিয়ে সে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়ে।
আসিফকে জেরা করে জানা গিয়েছে, আইএসআই চেয়েছিল সে রাজস্থান বা দিল্লিতে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ুক। কিন্তু, কলকাতার বেলঘরিয়ায় আসিফের পিসির বাড়ি। ফলে, কলকাতায় গা-ঢাকা দিতে আসিফের সুবিধা ছিল। ২০০৬ সালে বেলঘরিয়ায় এসে আশ্রয় নেয় এবং ‘কাজ’ খোঁজার অছিলায় সে ঢুকে পড়ে খিদিরপুরে। আলাপ হয় নাভেদ নামে এক দাগি ডাকাতের সঙ্গে। দু’জনে যায় গোয়ায়। সেখানে একটি বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় আসিফ। নাভেদ পালিয়ে যায়। কয়েক মাস গোয়ার জেলে থেকে ২০০৭ সালের গোড়ায় আসিফ আবার কলকাতায় ফিরে আসে।
এ বার খিদিরপুর এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে আসিফ। মহেশতলা এলাকার এক কাউন্সিলরের সার্টিফিকেট নিয়ে ভোটার কার্ড বানায়। বানিয়ে নেয় ড্রাইভিং লাইসেন্সও। ২০০৭ সালে মহেশতলার সেই কাউন্সিলর ছিলেন প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা রমণী নস্কর। তাঁর কথায়, “নিশ্চয়ই কেউ এসে আমাকে বলেছিল যে ও এখানে অনেক দিন ধরে আছে। তাই সার্টিফিকেট দিয়েছি।” কাদের সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে, সে সংক্রান্ত নথি কাউন্সিলররা রাখেন না বলেও তিনি জানিয়েছেন। পুলিশ সূত্রে খবর, আইএসআই-এর তরফ থেকেও আসিফের হাতে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, সেটি ছিল রাজস্থানের। সেখানে গিয়ে আসিফের থাকতে যাতে অসুবিধা না হয়, তার জন্যই ওই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আসিফ জানত কলকাতায় ওই লাইসেন্স কোনও কাজে আসবে না। ২০০৮ সালে মহেশতলার এক যুবতীকে বিয়ে করে তাঁরই বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করে আসিফ।
জানা গিয়েছে, মাঝে মধ্যেই পাকিস্তান থেকে তাকে অর্থ পাঠানো হত। ভারতে থাকার পরিচয়পত্র পাওয়ার পরে সম্প্রতি সেই অর্থের পরিমাণ বেড়ে মাসে প্রায় পনেরো হাজার টাকা হয়েছিল। তবে সরাসরি পাকিস্তান থেকে নয়, সৌদি আরবে থাকা আসিফের কাকার মাধ্যমে সেই টাকা পাঠাত আইএসআই। এ কারণে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও খুলেছিল আসিফ।
কলকাতায় থেকে প্রাক্তন সেনা অফিসারদের ঘনিষ্ঠ হওয়াই ছিল আসিফের প্রধান ‘কাজ’। সেই উদ্দেশ্যে দমদম ও বারাসত এলাকায় দুই ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে সে। তাঁদের এক জন ছিলেন প্রাক্তন সেনা অফিসার। নিজের লক্ষ্যে সে কতটা সফল হচ্ছে, তার বিস্তারিত বিবরণ সে মাঝেমধ্যেই ইন্টারনেট মারফত পাঠিয়ে দিত পাকিস্তানে। পাশাপাশি পুরনো পেশার টানও সে এড়িয়ে যেতে পারেনি। ২০১১ সালে টিটাগড় থানা এলাকায় আবার একটি ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ে সে। আবার জেল খাটে। এর মধ্যেই ২০১১ সালে সে পাকাপাকি পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলে। মাত্র ছ’মাস আগে প্রাক্তন সেনা অফিসার অমিতাভ কুমারের গাড়ির চালক হিসেবে চাকরিও জুটিয়ে নেয়।
অমিতাভ কুমারের সঙ্গে মঙ্গলবার ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমার স্ত্রী-র কোনও পরিচিত ব্যক্তির মারফত আসিফকে আমরা চাকরিতে রেখেছিলাম। খুব ভাল ব্যবহার ছিল। সময় মতো ডিউটিতে আসতো। কিন্তু, এত কিছু তো বুঝতে পারিনি।” গত ছ’মাসে আসিফের কোনও প্রশ্ন বা ব্যবহার থেকে কোনও ধরনের সন্দেহও মনে জাগেনি অমিতাভবাবুর। দিন দশেক আগে লম্বা ছুটি নিয়ে সে চলে যায়। দিন তিনেক আগে তার স্ত্রী ফোন করে জানিয়ে দেন, আসিফ আর চাকরি করবে না। সে যে আদতে আইএসআই চর এবং এখন দিল্লি পুলিশের হেফাজতে, সে তথ্য জেনে আকাশ থেকে পড়েছেন অমিতাভবাবু। জেরায় আসিফ জানিয়েছে, তার কাজে ‘সন্তুষ্ট’ হয়ে তাকে পাকিস্তানে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে আইএসআই-এর মাথাদের সঙ্গে। সে কারণেই ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তান যাওয়ার ভিসা করাতে দিল্লি গিয়েছিল আসিফ। কিন্তু, আসিফের গতিবিধি সম্পর্কে আগে থেকেই খবর ছিল দিল্লি পুলিশের কাছে। দিল্লি নামার পর থেকেই ছায়ার মতো তার পিছু নেয় পুলিশ। ফেরার পথে ধরে ফেলে তাকে। |